কেন যে রাকা এত ভুল
করে!ছোটো ভুল , বড় ভুল ।
মজার ভুল , মাশুলের ভুল ।
রাকার জীবন হরেক ভুলে
ভরা।ওর চারপাশের মানুষ
কখনো সেই ভুল উপভোগ করে ,
কখনো তাতে বিরক্ত হয়
।রাকার ভুলের গল্প
রাতের খাবার টেবিলে
রোজকার মজা।সেসব
কাহিনীতে কখনো - সখনো
বেনোজল যে না ঢুকে পড়ে
এমন নয় ।আসলে রাকার
ভুলের ছদ্মবেশে প্রায়ই
অন্যদের ভুল রেহাই পেয়ে
যায় ।
রাস্তাঘাটে রাকা হর -
হামেশাই চেনা মানুষকে
চিনতে পারেনা , আবার
পরিচিত মনে করে অচেনা
লোকের সঙ্গে হেসে হেসে
গল্প জুড়ে দেয় । সেবার
অফিসে সারা দিনমান ধরে
এক ভদ্রলোকের দরকারী
কাজ উদ্ধারে সাহায্য
করেছিল। দুদিন বাদে সেই
ভদ্রলোক যখন রাস্তায়
মুখোমুখি হয়ে ধন্যবাদ
জানাচ্ছেন ,রাকা অদ্ভুত
আচরণ করেছে ,আদৌ ওঁকে
চিনতেই পারেনি ।
আজকাল রাকা এ ব্যাপারে
একটু যেন বেশীই স্মার্ট
হয়ে গেছে । সেদিন
রিক্সা থামিয়ে এক
ভদ্রমহিলা কে হাসিমুখে
–
এইযে , কেমন আছো ? বাব্বা
কতদিন বাদে দেখলাম , বেশ
স্লিম হয়েছো তো
!...ইত্যাদি একনাগাড়ে
বলার পরেও সে মহিলার
চোখের বিভ্রান্তি
যায়না । রাকা লহমায়
বুঝে নিয়েছে । তক্ষুণি
অভিমান গলায় ফুটিয়ে
বলেছে - চিনতে পারনি
তো!থাক আর চিনতে হবেওনা
।পরে মনে মনে মজা
পেয়েছে । মরো এখন মাথা
হাঁটকে !একা রাকাই কেন
শুধু নিজেকে দুষবে!
রাকার স্বামী রবিন বলে
,কোনোদিন দরজা খুলে
অফিসফেরত রবিনকেই রাকা
হয়তো বলে বসবে - কাকে
চাচ্ছেন ?
অফিসে রিক্রিয়েশন
ক্লাবের বার্ষিক
অনুষ্ঠান । লিখিত
বক্তব্য পাঠ করবেন রাকা
সেনগুপ্ত ।ব্যাগ হাতড়ে
হাতড়ে একগোছা সাদা কাগজ
কেবল উঠে আসে
হাতে।অগত্যা রাকা সাদা
কাগজ হাতেই তাৎক্ষণিক
বক্তৃতা দিতে থাকে
জ্বলে যাওয়া গাল দুটো
নিয়ে ।
গতমাসে রবিন যখন গৌহাটি
গেল , ট্রেনে খাবারের
বাটির ঢাকনা খুলে
আক্কেল গুম্ । টিফিন
কৌটো ভর্তি ঝিরিঝিরি
করে কুচোনো মোচা
।রবিনের মায়ের হাতের
শিল্পকর্ম । ভোরের
ট্রেন বলে আগের রাতে
মাখোমাখো ডিমের ডালনা
রেঁধে টিফিনকৌটো করে
ফ্রিজে রেখেছিল রাকা ।
এ তারই পরিণাম ।যত্ন
করে ফয়েলে জড়ানো নরম
গরম রুটি আর কুচোনো
মোচা রবিন বাটি শুদ্ধ
আছড়ে ফেলেছে
বাইরে।ফিরে এসে যখন
রাকাকে ডাক্তারের কাছে
নিয়ে যেতে চেয়েছে , সে
কেঁদে কেটে একসা । -
আ্মায় তুমি পাগল পেলে ?
অফিসে ঢুকলেই ‘ কেউ
ভোলেনা কেউ ভোলে ... ’
কিংবা ‘ ভুল সবই ভুল , এই
জীবনের পাতায় পাতায় যা
লেখা সে ভুল’ এসবে ও রাগ
করেনা , মেনে নেয়
।অফিসের কাজের হাজারো
ভুল ওরাই তো মেরামত করে
দেয় ! ভুল মেরামত করতে
রাকাও আজকাল কম ওস্তাদ
হয়নি।জন্মদিনের
নিমন্ত্রণে গিয়ে
ইউনিভার্সিটিতে পড়া
টুটুর হাতে বড়সড়
বার্বিডল তুলে দিয়ে
সুন্দর করে বলেছিল ,
শৈশবটাকে যেন কখনো
হারিয়ে ফেলোনা । টুটু
যে নিশানের মেয়ে নয় , বোন
একথা রাকা বেমালুম ভুলে
গিয়েছে ।
এত কিছুর পরেও রাকা
কিন্তু কখনো ওর ভুলকে
ভুল বলেনা ।সেগুলোকে
সমর্থন করার হাজারো
যুক্তি থাকে ওর কাছে ।
যেমন ... স্টীলের আলমারীর
ভেতর আধপচা পটলের
টুকরো কেন ? - বা রে ,
সেদিন কুটনো কুটতে
কুটতে পেপারওলার পয়সা
দিলামনা !ওরকম হতেই
পারে ।
...হারানো চশমা ফ্রীজের
ভেতর ? - কি করব ? তখুনি তো
চোখটা কেমন চুলকে উঠল ।
... নাটকের টিকিট সঙ্গে
নিতে ভুলে গিয়ে ফের
টিকিট কিনে নাটক দেখে
ফেরার পর ব্যাগের ভেতর
থেকেই কেমন করে সে
টিকিট বেরোয় ? – বাব্বাঃ
, তুমি গেটে দাঁড়িয়ে যা
তাড়াহুড়ো করছিলে ! বড়
চেনের ভেতর যে ছোটো চেন ,
সেটা খোলার সময়ই তো
দিলেনা তার আগেই তো ... ।
কিংবা ... তরকারি পুড়ে
ঝেঁজে গেল কেমন করে
বৌমা ? - ওঃহো আপনাকে তো
বলাই হয়নি মা !জানেন তো
ওবাড়িতে না কাল চোর
এসেছিল । মাসীমার কাছে
সে কান্ড শুনতে শুনতেই
তো...
এসবতো রাকার
দৈনন্দিন।কিন্তু আজ
কয়েক ঘন্টা আগে থেকে
পরি আপ্রাণ চাইছে
নিজেকে ভুল প্রমাণ করতে
।সেটা করতে না পারলে সে
যে অসহ্য মানসিক
অস্থিরতায় ছিঁড়ে টুকরো
টুকরো হয়ে যাচ্ছে
।নিশ্চয়ই ... এ সত্যিই
তার
ভুল । কিন্তু এত অটুট
যুক্তি কেন সামনে রাখছে
তার মন !কেন সেই
মুহূর্তে সে অন্যমনস্ক
হয়ে পড়েনি !কেন তার
স্পষ্ট চোখ অমোঘ প্রমাণ
হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে
!
আজ দুপুরে ওরা ক’জন
মিলে অফিস থেকে বাইরে
গিয়েছিল টিফিন
করতে।রাকারা যেখানে
বসেছিল তার উলটো দিকে
দুটো পর্দা ঢাকা কেবিন
।বয় আসছেনা দেখে প্রীতি
গেল কাউন্টারে অর্ডার
দিতে ।রিংকু আর মিতা
ওদের কি এক কমন সমস্যা
নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত
।রাকার চোখ চলে গিয়েছে
কোণাকুণি কেবিনের হাফ
পর্দার নীচে দু জোড়া
পায়ের দিকে।প্রথমে মজা
পেয়েছে ।তারপর চমকে উঠে
টান টান হয়ে
বসেছে।সিঁটিয়ে নিজেকে
গোপন করেছে থামের আড়ালে
। ফ্যানের হাওয়ায় উড়ে
ওঠা পর্দার ফাঁকে চেনা
চশমার ফ্রেম ,কোঁকড়ানো
চুল ,চিবুকের লাল
জড়ুলটা । না ,নিজের
মানুষকে চিনে নিতে এসব
প্রমাণের কোনো প্রয়োজন
হয়না । অবিশ্বাসী মন
তবু বৈসাদৃশ্য খুঁজে
বেড়াচ্ছিল ।গাঢ় রঙে
রাঙানো নখের পা হাইহিল
ছেড়ে চেপে বসেছে
স্যান্ডেল শ্যু এর ওপরে
। ক্রমশঃ এক হচ্ছিল
শরীর দুটো। অতিপরিচিত
আফটার সেভ লোশনের গন্ধ
অন্য একটা উগ্র মদির
গন্ধের সঙ্গে মিশে ভেসে
আসছিল । গা গুলিয়ে
উঠছিল রাকার। একবার হাত
চলে গেল ব্যাগের ভেতর ,
আঁকড়ে ধরল মোবাইল ফোনটা
।কিন্তু না , পারলনা
।হাত নিজের বশে
নেই।কাঁপছে থর থর
করে।বসে বসে প্রচন্ড
ঘামছিল রাকা ।
ওদের পছন্দের জিনিস
ওখানে পাওয়া যায়নি ।
যায়নি ভাগ্যিস! ওরা চলে
গিয়েছিল অন্য দোকানে ।
একটা শ্লথ সরীসৃপের মত
শরীর টেনে রাকাও
বেরিয়ে এসেছিল ।কিন্তু
টিফিন করা আর হয়ে ওঠেনি
।ফাইলে মারাত্মক একটা
ভুল করে এসেছে এই
অজুহাতে ফিরেছে অফিসে
।
যথাসাধ্য চেষ্টায় রাকা
স্বাভাবিক থেকেছে ।
নিজেকে বুঝিয়েছে এ ভুল !
নির্ঘাত্ এ তার ভুল । এ
হতে পারেনা- অসম্ভব !এ
হয়নি। একজনের সাথে
আরেকজনের চেহারার
সাদৃশ্য তো থাকেই ! নয়তো
রাকা এত ভুল করে কেন
!বাড়িতে ফিরে রাকা
অসহ্য মাথা যন্ত্রণায়
শুয়ে থেকেছে । অচেনা
আশংকায় অনবরত কেঁপেছে
বুক।কিন্তু চোখে
একফোঁটাও জল আসতে
দেয়নি ।ভুল দুঃখে কি
কেউ কাঁদে ?
রাতে খাবার টেবিলে মন
আর রণি যখন মাছ ছাড়া
মাছের ঝোল খেয়ে স্কুলে
যাবার বর্ণনায় মুখরিত ,
রাকা দুঃসাধ্য হাসিতে
মুখ সাজিয়ে বলেছে –
জানিস , আজ না এক
ভদ্রলোককে দেখলাম ঠিক
তোদের বাবার মত ! আমি তো
আরেকটু হলে ডেকেই
ফেলেছিলাম। – ধ্যাৎ !
সত্যি ?কোথায় দেখলে মা ?
-আমরা সবাই অফিস থেকে
টিফিন করতে গিয়ে ছিলাম
একান্তে কেবিনে।
হ্যাঁগো সত্যি! জানো !
একেবারে তোমার মত... এই
লাল জড়ুলটাও ছিল। ভাত
মাখতে থাকা হাতটা থেমে
গিয়েই আবার দ্বিগুণ
তৎপর হল । রাকার চোখ
এড়ায়নি । ও বলল - তুমি কি
গিয়েছিলে নাকি গো ?
অতিমাত্রায় স্বাভাবিক
থাকতে গিয়েই কি একটু
ঝুঁকে গেল মাথাটা ? না ।
পরক্ষণেই সামলে
নিয়েছে।
বলল- আরামেই আছো ,ভর
দুপুরে একান্তে কেবিন
।আমার এদিকে দম ফেলবার
ফুরসত নেই,অডিট চলছে,
কাকে দেখতে কাকে যে
দেখেছে ! একদিন একটা
কেলেংকারী না বাধিয়ে
ছাড়বেনা ।বুঝলি মন ,
এজন্যই ডাক্তার দেখাতে
বলি তোর মাকে ।খিল খিল
হাসিতে ভেঙ্গে পড়ে শিশু
দুটো । নিঃশব্দ হাসল
রাকাও । লোকটা নিজের
চারদিকে দেয়াল তুলছে ।
জানেনা দেয়ালটা কাচের
।
রাকা সঠিক বুঝতে পারল
সে ভুল জায়গায় দাঁড়িয়ে
আছে।ভুল মানুষকে
ভালবেসে ভুল সংসারে
গৃহিনীপনা করছে ।তার
আস্থা তার বিশ্বাস , এই
ঘর দেয়াল আসবাব সমস্তই
মিথ্যে । যে ভুলকে রাকা
কোনোদিনও স্বীকার
করেনি,মেনে নেয়নি
কক্ষণো , আজ ভেঙে টুকরো
হতে হতে সেই ভুলের
বর্মটাকেই প্রাণপণে
আঁকড়ে ধরল রাকা । আজকের
পুরো দুপুরটাকেই
অবাস্তব প্রতিপন্ন করে
বলে উঠল - ঠিক বলেছ গো ।
এবার একদিন যেতেই হবে
ডাক্তারের কাছে,আজকাল
আমার বড্ড ভুল হয়ে
যাচ্ছে !