১
চাঁদ কৃষ্ণাকে
ভালোবাসে। কৃষ্ণা
বারান্দায়। উল্টোদিকে
চাঁদ পাড়ার দোকানে। চা,
কফি, টুকটাক স্পেশাল,
ফ্লেক। তবে কৃষ্ণা
চাঁদকে চেনে না।
কৃষ্ণার বাবা, সুশোভন
সোনার দোকান সামলে, কী
একটা কাজে দুদিন বাইরে
যাবে, বলেছিল। নিজের
দোকান বন্ধ রেখে চাঁদ
ওইসময়টা কৃষ্ণার
বাড়িতে। ঢুকে আর
বেরোয়নি। বেশি কিছু
হয়নি। কৃষ্ণাই ভয়
পেয়েছিল। চাঁদ বলেছিল,
কিসনা, এই কিসনা।
কৃষ্ণা ছিটকে সরে গেছিল
ভয়ে। দুতিনবার ঠোঁট
ঘষতে বাইরে জুতোর
আওয়াজ। সদর পেরিয়ে
লোকটা কথার খেলাপ করে
ঘরে ফিরেছে। আগেই। চটি
দেখেনি। আজকেও টেনেছে,
লজ্জায় রাগে কৃষ্ণা
বলেছিল। কে রিস্ক নেয়?
চাঁদ এই ছুট, ওই ছুট।
তারপর থেকে কৃষ্ণার
কথামতো কৃষ্ণা চাঁদকে
চিনবে না। সামনাসামনি।
চাঁদ ন্যাড়া গোপালকে চা
দিলে থুতু পড়ে পাশ
থেকে। চায়ে ভাসে।
ন্যাড়া গোপাল সেটাই
খেয়ে নেয়। চাঁদ জানে ওর
মাথাটা নেই। হাসিটা
আছে। চাঁদ পয়সা চায় না।
বড় একটা দোকান থেকে
পার্টির লোকেরা লেঠেল
লাগিয়ে ভেঙে দিল। কী
যেন শালা সৌন্দর্যায়ণ।
চাঁদ দেখেছে, পোস্টারে
ছিল। দেখে দেখে মুখস্থ
হয়ে গেছে। চাঁদ জানে
দোকানটার মতো সে নিজেও
শেষ হয়ে যাচ্ছে। আলো
কমে আসছে। মা দেখতে
দেখতে শেষ হয়ে আসছে।
শরীর। ভাইয়ের পরীক্ষা।
কে জানে কী করবে। তবে
পড়ে, এটাই বড় কথা। চাঁদ
এখন সকাল থকে বিকেল
অবধি থাকে। বাপ বলেছিল
পুরোটাই থাক। এখন বেশি
বিক্রি দরকার। বসানোর
লোক পাওয়া যায় না।
বেঞ্চ নেই। দাঁড়িয়ে কজন
খাবে? টোস্ট করত। ছেড়ে
দিল। পারল না। রাতে আর
দোকান করে না চাঁদ।
শুধু ...। মনোহর দত্ত।
কাউন্সিলর। কিসনা, ওরে
কিসনা। বাপটাকে পটা না।
সুশোভনের সঙ্গে দহরম
মহরম মনোহরের। অনেক
বলেছে কৃষ্ণাকে। ধুস।
এবার ওকেই যা করার করতে
হবে। ইচ্ছে হয় চায়ে
কিছু মিশিয়ে সটকে দিই।
বলেছিল জায়গাটা ফিরিয়ে
দেবে, ভোট মিটলে। কে
জানে। কৃষ্ণা বলেছে
স্টেশনে থাকতে।
পালাবে। ব্যাগ গোছানো।
মায়ের গলার হারটা নেবে।
বাপ লুকিয়ে কোথায়
রেখেছে, জানে। ওটা ওর।
দুতিনটে শাড়ি নেবে। কী
রঙের জানতে চাইল। তারপর
ট্রেনে করে অনেক দূর।
এই দোকানে কী হবে। চা
বেচে কদ্দুর? কথা হয়ে
গেছে। বিয়ে। কৃষ্ণার
বিয়ে। চব্বিশে। তার দশ
দিন আগে। অমরকে চা
খাওয়াতে হবে। অমর। বাবা
রাজনীতি করে। সময় নেই।
অমর একাই ফাইনাল করেছে।
হবু শ্বশুরের প্রাণের
পাত্র। কৃষ্ণাকে দেখে
গেছে। আর একবার আসবে।
কথা বলতে। ফাইনাল
সেটলমেন্ট। সেই অমরকেই
খাওয়াবে চা। ভুলভাল
কিছু একটা দিয়ে। তারপর
স্যাঙাতগুলো দিয়ে
বেস্পাট প্যাঁদানি।
অমর যেন আর এমুখো না হয়।
অমর। চাঁদ অমরের কথা
ভাবে। দেখতে হ্যান্ডু,
কম কথা বলা, তোতলা অমর।
চাঁদের সেদিন দোকান
খোলা। চাঁদ দেখতে
পাচ্ছে। চোখ বুজলেই।
ট্রেন ঢুকবে। স্টেশন।
কৃষ্ণা বসে আছে। চাঁদ
আসবে ...
গাছগুলো আগের মতোই আছে।
তবে চাঁদকে দোকানটা
বাড়াতে গিয়ে দুটো আরও
ছোট গাছ কাটতে হয়েছে।
গাছ কাটতে ভালো লাগে
না। হেবি ব্যথা লাগে।
বুকে। টাকাও খসেছে।
সুশোভন স্যান্যাল রোজ
চা খায়। টোস্ট শুরু
করেছে। এই মাস থেকে চপ।
আম, পটল, ক্যাপসিকাম।
পসার জমছে। মা’টাকে
দেখতে হচ্ছে বেশি করে।
এখনও মরেনি। ডাক্তার
বলেছে কলজেয় জান আছে।
ভাইটা র্যাঙ্ক করল।
দোকানে বসে। চাঁদ জোর
করে বাড়িতে পাঠিয়ে
পড়ায়। এইচ এস আছে না ...?
কৃষ্ণার সঙ্গে বিয়ের পর
দেখা হয়নি। শুনেছে
সিমলা গেছে হানিমুনে।
কিন্নর, কল্পা। সব। ওর
বরের সঙ্গে। বর। অমর।
অমর দত্ত। মনোহর দত্তের
ছেলে। চাঁদ জানত। অমরকে
বলতে হয়েছিল।
প্ল্যানটা। ছেলেটা
ভাল। বলেছিল হয়ে যাবে।
কথা রেখেছে। কাউন্সিলর
বাপ দোকানটা করে
দিয়েছে। স্টেশন থেকে
একা বাড়ি ফিরে কিছুই
বোঝেনি কৃষ্ণা। ভাইরাল,
ভাইরাল। জ্বর। বগলে
পেঁয়াজ ঘষে, এই বলে, ওই
বলে পরের সাত দিন দোকান
করেনি চাঁদ। দুদিন যাক।
দোকান বড় হোক। যা দাঁও
মেরেছে মেক আপ হয়ে
যাবে। পুরনো ডেটেই বিয়ে
হয়েছিল কৃষ্ণার।
শুনেছে বিয়ের সময়ে
কান্নাকাটি করেনি
কৃষ্ণা। থম মেরে গেছিল।
কয়েকদিন পর কে যেন
একবার নাম জিজ্ঞেস করলে
বলেছিল, কৃষ্ণা। কৃষ্ণা
ডাট।
এটুকুই ...
তবে বলার মতো আর দুটো
ব্যাপার রয়েছে। এক,
কৃষ্ণা চাঁদকে এখন আর
চেনে না। সামনাসামনি
চেনে না। সবার আড়ালেও,
না ...। দুই, কৃষ্ণা বাপের
বাড়ি খুব একটা আসছে না।
ওর বারান্দাটা, চাঁদ
দেখে, বাইরে থেকে, বড্ড
অন্ধকার। কেমন একটা ...
২
শুক্লা সুযোগ খোঁজে। এ
সুযোগ বারবার আসবে না।
চন্দ্রদা। কতদিন হল
টিউশন? সাড়ে ছ মাস? এই
এতগুলো মাসে একবারও মুখ
তুলে তাকাল না? ভগবানও।
শুক্লা রোজ দুবেলা ফুল
ছোড়ে। কথা বলে। একদিন
তাকাবেই। আর সেদিন
প্রাণ ভরে দেখবে। রোল
মডেল। শুক্লার
রাজপুত্তুর।
চন্দ্রদা। মেজদা
বলেছিল, চাঁদু। টিপ
পরলে দিব্যি মানাত রে ..।
ওর ফিক করে হাসার ভেতর
একটি মেয়ের ডুকরে
কান্না ছিল, লজ্জা ছিল।
দাদারা সেসব বুঝবে না।
নিজের দাদা না। তবু,
কোলেপিঠে বড় হওয়া। একটা
পাঁচিলের এদিকে ওদিকে
দুটো বাড়ির ছেলেমেয়ে।
তুতো দাদা, বোন। শুক্লা
জানে, চন্দ্রদা ওই
দাদাদের মতো না। কলেজের
সিনিয়র। বড় চুপচাপ।
মিহি গলায় কথা। সেবারে
পিকনিকে ঘাটশিলা।
ট্রেনে দুজোড়া চোখ।
সবেমাত্র নতুন টিউশনির
ধকল। চন্দ্রদা নিতে
পারেনি। বান্ধবীরা জোর
করে ওর পাশে বসিয়ে
এসেছিল। আড়ষ্ট পুরুষ।
ইঙ্গিতে কথা ছিল কি?
শুক্লা অতশত জানে না।
‘তাকাচ্ছেন যে বড়?’
একবার বলেই ফেলেছিল।
অসাবধানে হোঁচট খেয়েও
সতর্ক অন্যজন। ‘তোমার
শাড়িটা। হালকা সবুজ।
ভাল লাগছে’। তীব্র এক
সংকোচে সরে আসা। ভুল?
কাছে গেলে হত? তবে আসল
ভুলটা কত বড় করেছে, সেটা
ঘাটশিলা পৌঁছে বোঝা
গেছিল। দাদাদের একটা
গ্রুপ ওখানেই। গোল
পৃথিবী। আর তার ভেতর
ব্যাটম্যান, জোকার।
ঘোরাফেরা।
ধাক্কাধাক্কি। ‘কী রে,
তোরা এখানে?’ বুক ধক করে
উঠেছিল শুক্লার। তারপর
আড়চোখে ওদের চন্দ্রদার
দিকে তাকানো। শুক্লা
প্রমাদ গুনল। পিকনিকে
বুরুডি। ফুলডুংরি
পাহাড়ের ওপর কাঁটাগাছ,
জঙ্গল। রঙ্কিণী
মন্দির। একটা
পরিত্যক্ত হোস্টেল।
ফেরার পর একটাও কথা
বলেনি চন্দ্রদা।
গুটিয়ে গেছিল। টিউশনি
আসেনি মাসখানেক। মা
ছাড়াতে চেয়েছিল। আর
সেদিনই সদর খুলে আসতে
দেখে লোকটাকে। যেন
প্রথম দেখা। ভাগ্যিস।
তারপর, আবার স্বাভাবিক।
তবু, সেই মুগ্ধতা, সেই
ইশারাগুলো ভোলে কিকরে
শুক্লা। আজ পাড়ার
যাত্রা। বৃহস্পতির।
মায়ের বান্ধবীরা। তাড়া
দিয়ে নিয়ে গেল। রাতে
এখানে ফিরবে না বলে
দিয়েছে। ওবাড়ি থেকে
কাকিমা এসে শোবে। আজ
বৃহস্পতি। আজ
চন্দ্রদা।
শুক্লা শাড়িটা পাল্টে
নিয়ে বসেছিল। হালকা
সবুজ। সুগন্ধি।
বিকেলের দিকে একফালি
বৃষ্টি হয়ে গেছে।
ফিজিক্স। চন্দ্রদা
তত্ত্বের গভীরে ঢুকে
যায়। বৃষ্টি শুরু হয়
আবার। বাজ পড়ে না। জীবন
আর সিনেমা এক না।
কারেন্ট নেই। থাকে না
প্রায়ই। আজ মা ফিরবে না
বলেও তার ব্যতিক্রম হবে
নাকি? শুক্লা আলো আনে।
মোমের আলো। শুক্লা
এগিয়ে আসে ...
মাসখানেক পর আবার
এসেছিল চন্দ্রনাথ।
পড়াতে। কাকিমা
বলেছিলেন, এবার একটু
রেগুলার হও বাবা।
পরীক্ষাটা সামনে।
চন্দ্রনাথকে রেগুলার
হতে হবে। নিয়মিত।
শুক্লার মা, কাকিমা এখন
আর বেরোন না। বা
বেরোলেও খবর পায় না
চন্দ্রনাথ। শুধু ফোন
আসে, আজ এসো না চন্দ্র।
একটু বেরোচ্ছি ...।
কাকিমা বেরোবেন? আবার?
শুক্লাও কি? একলা? কোথায়?
কার কাছে? চন্দ্র জানে
তার আলো নেই। দেওয়ার
মতো কিছুই। ওর চলা,
হাঁটা, কথায় কিছু নেই।
‘এফিমিনেট’। প্যাঁক
খাওয়া। তাড়া করে
বেড়াচ্ছে। আজন্ম।
শুক্লা সেদিন এগিয়ে
এসেছিল। পাশের বাড়ির
ওপর থেকে ওর দাদাদের
আওয়াজ। চিকনি চামেলি।
মদ। আই পি এল। সেই
পিকনিক। চন্দ্রর
যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না।
ভাঙা হোস্টেলটা কারা
ভেঙেছিল? লোকাল লোকেরা
বলেছিল মাওয়িস্ট।
শেল্টার। দাদারা ডাকল।
চন্দ্র তৈরি ছিল। জানত।
মারধোর করবে। বলে দেবে,
জোর করে এসেছে। পেটালে
পেটাক। সয়ে নেবে। তার
বদলে, ওরা অন্যভাবে
তাকাল। চন্দ্র,
চন্দ্রকে ডাকল। কাছে ...
শুক্লা নির্বাক হয়ে
শুনেছিল। চন্দ্রদার
শরীর। কথা। কান্না।
অপারগতা। ওপরের ঘরে ওর
অগ্রজদের কণ্ঠ। অতীত।
পৌরুষ। মাথায় হাত
বুলিয়ে দিল শুক্লা।
কিছুক্ষণ পর উঠে চলে
গেল লোকটা। অপারগ।
সেমিস্টার পেরিয়ে
গেলেও চন্দ্রদা আসে।
শুক্লার ধারণার বাইরে।
কারেন্ট আগের মতোই
ইরেগুলার। টেবিলে
বইয়ের সমান্তরালে
শুক্লার শরীর।
চন্দ্রদার নিষ্পাপ
চোখে অভিসন্ধি থাকে না।
অক্ষর থাকে। তত্ত্ব
থাকে। বিজ্ঞানের।
শুক্লা তবু বুকের কাছটা
শাড়ি ঠিক করে নেয়। না
করলেও চলত। টেবিলের
এধারে নারী। ওধারে এক
পুরুষ। সেফ। অন্ধকারেও
...।