--------------------------
সুচেতা আজ দুদিন হল
কোমায়। শুভ ওর কাছে বসে
আছে। ইণ্টেনসিভ কেয়ার
ইউনিটের শীততাপ
নিয়ন্ত্রিত কেবিন।
সন্ধে করে অফিস থেকে
ফিরছিল সুচেতা । সাধারণ
একথা সেকথার চালচিত্র
বুনে যখন শুভ ভারি গলায়
বলতে যাবে সেই কথাটি,
সুচেতা বলে উঠলো, “ঈশ
অনেকদিন বাদে গোল চাঁদ
আমার ডান পাশের আকাশে
আমার সঙ্গে সঙ্গে চলেছে
। কতদিন চলে নি এমন। না
আমিই বাঁ দিকে ফিরে
থেকেছি শুভ? রাতের এমন
একটা ভীষণ আলাদা ভাষা
আছে!” ঠিক এই জায়গায় তার
কেটে গেল! সুচেতা দেখল
না কখন তার বাঁ দিক দিয়ে
এক রাক্ষুসে লরি এগিয়ে
এসেছে ।
এখন কোন ডাক কানে যায় না
ওর । মায়ের “ও মা মা গো”,
বাবার “সোনা মা রে” ।
তাই শুভ ডাকছে না কথা
ব’লে আর। মানুষের ভাষা
বোঝার জায়গাটা সুচির
ঘুমিয়ে পড়েছে। অথচ
প্রাণ তো আছে ।
ভেন্টিলেটর বাদেই
নিঃশ্বাস চলছে ।
মস্তিষ্ক চালাচ্ছে
হৃৎপিণ্ডকে। রক্ত রোমে
রোমে পাঠিয়ে দিচ্ছে
স্নেহ। ত্বক চিকচিকে।
কি ভাবে জানি মুখটা
সুচির কেমন মায়াকাড়া
ভঙ্গী করছে। যেন কোথাও
বেড়াচ্ছে সুচি । আজ
সাতদিন হয়ে গেল সুচি
মুখ তুলল না , শুভর কত কি
বলার ছিল, শুনল না , তখন
শুভর মনে হল, যদি কোন
অন্য ভাষায় কথা বলা যায়,
অন্য কোন ভাষা যদি
শোনে। মনে হল সুচি
বলেছিল, রাতের একটা
ভাষা আছে ।
“রাতের ভাষা কেমন সুচি?
অন্ধকার তাই সেজেগুজে
লাভ নেই। বেল ফুলের
গন্ধ তাই ছুটে চলল
পতঙ্গের দিকে। আর তার
সাদা নরম পুরু পাপড়ি
পাঠালো সিগন্যাল। দেখ
সুচি, সেই বেলের একটা
থালা রাখলাম তোর কাছে।
এই যে কোমার অন্ধকার ।
তুই হয়তো খুঁজিস আমায়।
দেখ আমি তোর স্নায়ুকোষে
কোষে, বেলের গন্ধের
সেতু পাঠালাম। চিনে
চিনে ফিরে আয়।
ছাতিম ফুলও আনলাম সুচি।
গন্ধ চিনে চিনে পা ফেল।
দেখ সিকাডাদের আওয়াজ
রেকর্ড করা আছে এই
খানে। সেই যারা সতেরো
বছর মাটির তলায় থেকে
একবারে একসঙ্গে উঠে আসে
আকাশের নীচে। আর
একসঙ্গে ডাকে
সঙ্গিনীদের। তাদের সেই
আকুল ঘন ঝিঁঝিঁ শব্দ।
দেখ আমরা যেন বেড়াতে
এসেছি। সেই পাহাড়ে।
রাত্রিবেলা তুই আর আমি।
ফুলের গন্ধে গন্ধে পা
ফেল। সিসাডার
নিম্নাঙ্গ কোন তালে
তালে তার সঙ্গিনীর
জন্যে বেজে ওঠে।
অনেকদূরে অনেকদূরে
ছোটে সেই আওয়াজ। মেটিং
কল। এই অন্ধকারে আমিও
তোর জন্যে দাঁড়িয়ে।
আমারো সবখানটা কেঁপে
কেঁপে উঠছে সুচি। চাঁদ
তোর পাশে পাশে
যাচ্ছিলো। কতরকম
অদরকারি কথা শব্দে
শব্দে চিনে চিনে আমরা
সেখানে এসে
দাঁড়িয়েছিলাম।
এই যে ঝিঁঝিঁর শব্দ এরই
প্রতিফলন কি ঝিঞ্ঝোটি
রাগ? রাতের দ্বিতীয়
ভাগে, বিলম্বিত একতালে
যে আস্তে আস্তে তোর
বিনুনির মতো খোলে? যার
বিশ্রান্তি সা, পা, ধা
এর আরোহে। ঝিঁঝিঁ
পুরুষটিও কি অমনি
বিশ্রাম নেয়? ডাকার
মাঝে মাঝে? জেগে ওঠ
সুচিইইই!
দাঁড়া লাগাই সেই গান।
সেই বন্দিশ। আরও একটু
হাল্কা করে প্রাণ নিংড়ে
গাইছেন মেহদি হাসান।
“গুলোঁ মেঁ রঙ্গ ভরে,
বাদএ নওবাহার চলে, চলে
ভি আও কে গুলশনকা
কারোবার চলে”। ভাব,
এখানে ব্যবসায়ী ফুলেরা!
আচ্ছা যদি একটু খুলে
দিই তোর মাথার উপরের
জানলাটা । তোর ত্বকে,
মৃদু মৃদু লোমের
জঙ্গলে, কেমন
মর্মরধ্বনি ওঠে সুচি?
কাল কালবৈশাখী হচ্ছিল।
আজও হাওয়ায় তার ঠাণ্ডা
ছোঁয়া।
মনে কর সেই পাহাড়ে,
রাত্রি আরও বাড়লো।
পাতার মধ্যে দিয়ে যখন
হাওয়া চলল এরকমই শব্দ
হলো শোন। মনে হল যেন
টুপ করে কিছুটা গলন্ত
চাঁদ জলে ডুব দিলো।
হরিণরা তাদের
স্বভাব-ভীরু চোখ নিয়ে
কিভাবে পালালো। তাদের
পায়ের নীচের পাতা মড়মড়
করে উঠলো খুব আস্তে।
পিপীলিকাভুখেরা তাদের
মাঝখানের লম্বা আঙুল
দিয়ে ঠকঠক করে গাছের
ডালের দরজায় টোকা দেয়।
পোকা মায়েরা কি সেই
টোকাকে নিশির ডাকের মতো
ভয় পায় সুচি? তারা কি
তাদের বাচ্চাদের পাখার
ওমের নীচে রেখে ঘুম
পাড়ায়? বলে- এক ডাক, দু
ডাক, তিন ডাক দিলেও
যাসনি বাছারা। তাদের
ডানার সেই কম্পনের
সঙ্গীত। সুচেতা, সেই
গান! সেও কিভাবে কোনো
খ্যাপা আরণ্যক তুলে
নিয়ে রেখেছে বিশ্বের
জ্ঞানকোষের
অন্তর্জালে। তোর ত্বকে
হালকা ঠাণ্ডা হাওয়া,
কোন দূরের পাহাড়ের
স্পর্শ নিয়ে আসছে। আর
রাতের নানান ভাষা,
নানান গন্ধে, ছন্দে
ঘ্রাণে নেমে আসছে
আমাদের উপরে। আমিও চোখ
বন্ধ করে আছি। আর শুনছি
একপাশে ঝর্ণার কুলকুল ।
একটানা। নিরবচ্ছিন্ন।
অবিরাম! মানুষ বড় বেশী
দৌড়লো সুচি মৃত্যুর
থেকে। দৌড়ে দৌড়ে সে
ভুলেই যাচ্ছে যে মৃত্যু
আর ধাওয়া করছে না। শুধু
জীবনই এখন ভাষাহীন।
ক্ষণিকের বিদ্যুৎ চলে
গেলে সেই ভাষা ফিরে আসে
এক টুকরো আমাদের কাছে।
আমরা অবাক হয়ে দেখি,
টিউবলাইটের অন্য দিকে
সেই অসংখ্য নক্ষত্রময়
আকাশ। তার নীচে এই
অদ্ভুত কিছু উচ্চাশী
প্রাণ ধুকপুক ধুকপুক
করে চলেছে। সেই অজস্র
তারার থেকে আসা কত
নক্ষত্র দূরের আলোর
ভাষা। যা আমরা ভুলে
গেছি কবে। তুই বুঝিস কি
কখন বড় গাছটায় কাকেরা
ভিড় করলে অনেক
কাঠবিড়ালি একসঙ্গে
কুইক কুইক শব্দ তোলে?
আমি তো বুঝি না। আমরা আর
বুঝি না প্রকৃতির ভাষা
। সুনামি আসার আগে
সমস্ত প্রাণের মধ্যে
সাড়া পড়ে সুচি। আমরা
কান পেতে থাকি রিখটার
স্কেলে। ঝর্ণার
একনাগাড় কুলকুল
কুলকুল। আমাদের স্নায়ু
সেই জলের আওয়াজ চেনে,
বাঁধা সময়ের কল চেনে না
সেমতো । আরাম বাড়তে
বাড়তে সুখ গেলো সুচি।
আজ তোর দৌলতে গান্ধারীর
মতো আমি স্বেচ্ছা
অন্ধকারে বসে দেখি,
শব্দব্রহ্ম ধরা দিলেন
চেতনায় । উপশম এলো। যদি
একবার ওই উদার পায়ের
ছাপ রাখিস আমার বাড়িতে,
ছাদের ঘরে শুয়ে শুয়ে
শুনবো রাত্তিরে পুরনো
বাড়িটা স্বপ্নের মধ্যে
এপাশ ওপাশ ফিরে কেমন
কড়ি বড়গায় গোঙরায়।
উপরে সীমাহীন আকাশ। আর
পাশে সীমাময়ী তুই ।”
সুচির মনে হল সে যেন সেই
আদিম বাগানে । যাতে
মালীর ঝাঁট পড়েনি কখনো।
সেখানে সে লুকোচুরি
খেলছে । শুভ যেন এখনি
কিছু ফুল তুললো। বলছে
আয় আয় , ছোঁ ছোঁ। নইলে
পাবি না। আর গন্ধে
গন্ধে পা ফেলছে সুচি।
তার চোখে কানামাছির
রুমাল। তাই দেখতে
পাচ্ছে না কিচ্ছু । তবু
কি আশ্চর্য ভয় করছে না।
যেন কোথায় চাঁদ উঠেছে ।
চুমু খেয়েছে রুপোলি
নরম চুমু। তার ঘাড়ে
হাতে। যেন অনেক গায়ক
কেমন ঝিমধরা গান গাইছে।
কেমন আকুল করা। কাছেই
কোথাও জল। তেষ্টা
মেটানো। শুধু শুভ কই।
শুভ কই? আচ্ছা এবার যদি
চোখ খোলে ও? রুমালে
গিঁটটা যেন বড় জোরদার।
তবু দুষ্টু হাসি হেসে
হেসে ও গিঁট খুলছে।
এইবার ধরবে শুভকে।
ধরবেই! আর বলবে, জানিস
শুভ! রাতের এমন একটা
একদম নিজের ভাষা আছে!