এতদিনে আমাদের সবার
জানা হয়ে গেছে, ভাষার
লিখিত রূপের মধ্য দিয়ে
নয়, এমনকি তার
সাহিত্যের মধ্য দিয়েও
নয় –একটি ভাষা টিকে
থাকে মানুষের মুখের
ভাষায়। যারা ভাষার
প্রাণবাবু হিসাবে
সাহিত্যের দিকে ইঙ্গিত
করেন, তারা ভুল করেন।
সাহিত্য সেই ভাষার
নিরবচ্ছিন্ন
ব্যবহারের একটা দলিল
হতে পারে, হতে পারে সেই
ভাষা ঠিক তার ‘আগের
মুহুর্ত পর্যন্ত কতটা
স্বাস্থ্যবান ছিল’ তার
একটা দলিল; কিন্তু তা
কোনও মতেই সেই ভাষাটির
বর্তমান স্বাস্থ্যকে
নির্দেশ করে না।
সংস্কৃত সাহিত্য
মণিমুক্তোয় ভারা;
ল্যাটিনের ক্ষেত্রেও
তাই। কিন্তু এই দুটি
ভাষার বর্তমান অবস্থা
সকলেরই জানা। ভাষা
বেঁচে থাকে মানুষের
মুখের ভাষার ‘ইতর’ ও
‘স্বাদু’ ব্যবহারের
মধ্যে দিয়ে। এবং ভাষার
সঙ্গে এই কারণেই
রাজনীতি অর্থনীতি ও
ধর্মের গাঁটছড়া বাঁধা
হয়ে থাকে অন্দরে
অন্দরে। পৃথিবীর সব
ধর্মের
ধর্মগ্রন্থগুলিই লেখা
হয়েছ এক একটি
‘পবিত্রতম’ ভাষায়। সেই
ভাষা Chosen Few –এর ভাষা। ফলে
ক্ষমতার কেন্দ্রটিকে
প্রসারিত করতে চাইলে,
বা ক্ষমতার
কেন্দ্রটিকে দখল করতে
চাইলে সব থেকে আগে
আক্রমণ করা দরকার
ভাষাকেই। ‘ভাষা-দখল’ যে
পরিমান ডিভিডেন্ড দিতে
পারে, অন্য কিছুই আর
তেমনটা পারে না। এই
কথাটা শাসকে বোঝে,
চতুরেও বোঝে। শুধু
আমাদের বুঝতেই কিছুটা
দেরী হয়ে যায়।
আর এই পথেই ভাষা-হাঙরের
হাঁ-এর মধ্যে প্রতিদিন
একটু একটু করে তলিয়ে
যায় এক একটি ছোট ছোট
ভাষা।
প্রতিটি ভাষার মধ্যেই
থাকে একটি প্রতিরোধী
ক্ষমতা। সেই
ক্ষমতাটিকে ঝড়ের-মুখে
প্রদীপের মত দু’হাত
দিয়ে রক্ষা করে সেই
ভাষায় কথা বলা
নিম্নবর্গের
মানুষেরা। আমার
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও
ইতিহাসের চলন দেখে
নিশ্চিন্তে বলতে পারি,
ডুবন্ত জাহাজ থেকে সব
থেকে আগে যেমন ইঁদুরেরা
পলায়ন করে, একটি ভাষা
আক্রমণের মুখে পড়লে বা
তুলনামূলক ভাবে বড় কোনও
ভাষা তাকে গিলে খেতে
এলে, সব থেকে আগে সেই
ভাষাটিকে ছেড়ে দেয়
উচ্চবর্ণের মানুষে।
এবং ঠিক উলটো দিকে
দাঁড়িয়ে থাকে
নিম্নবর্গের
মানুষেরা। তথাকথিত
enlightened মানুষেরা,
আর্থিকভাবে
তুলনামূলকভাবে
স্বচ্ছল মানুষ ভাষার
লিপিটিকে পাঠ করেন
বেশী। কিন্তু আক্রমণের
মুখে সেই পাঠ ভুলে
বিকল্প পাঠের দিকে চলে
যেতেও তাদের দেরী হয়
না।
খুব কাছ থেকে দেখা একটি
ঘটনার উল্লেখ না-করলে
ব্যাপারটা আমি ঠিক
বোঝাতেও পারব না। আমার
বাবা-জ্যাঠামশাইরা ও
পিসি, একটা সময়ে
নোয়াখালী থেকে এই
বাংলায় চলে আসতে বাধ্য
হন। ধীরে ধীরে
বাবা-জ্যাঠামশাইরা
কিছুটা থিতু হন। অবশ্য
থিতু বলতে যা বোঝায় ঠিক
তেমনটা নয়। দু’বেলা
দু’মুঠো খেয়ে পরে
বাঁচার লড়াই চালিয়ে
যেতেই হয়েছে তাঁদের।
তাঁরা কেউই দিকপাল
ছিলেন না। কেউকেটাও নন।
একটা স্তর পর্যন্ত
পড়াশোনা করতে হয়েছে
তাঁদের। সেটা সম্ভব
হয়েছিল পরিবারের এক
বট-গাছের মত মানুষের
জন্য। কিন্তু বড় হয়ে
বুঝেছি, সব থেকে কম নজর
দেওয়া হয়েছিল আমার
পিসির দিকে। দেশভাগ হলে
সব থেকে বেশী
ক্ষতিগ্রস্ত হয়
মেয়েরাই। এই কথাটা
আমাকে থিয়োরি পড়ে বুঝতে
হয়নি। তা সে যাই হোক, আমি
পিসির নোয়াখালীর
‘ডায়ালেক্ট’ এক-বর্ণও
বুঝতাম না।
বাবা-জ্যাঠামশাই-পিসি
যখন এক সঙ্গে বসে গল্প
করতেন, তখন আমি দেখতাম
বাবা-জ্যাঠামশাই
হাওড়া-হুগলী-বর্ধমানের
‘বাংলায়’ কথা বলে
যাচ্ছেন। পিসি বুঝছেন,
কিন্তু বলছেন
নোয়াখালীর ‘বাংলা।’
বাবা-জ্যাঠামশাইও
বুঝছেন সেই বাংলা,
কিন্তু বলছেন
তুলনামূলক
‘সফিস্টিকেটেড’ এক
ডিকশন। আমার ব্যক্তিগত
অভিমত, খারাপের মধ্যেও
‘অধিকতর খারাপ’
অর্থনৈতীক অবস্থা ও
প্রাতিষ্ঠানিক
শিক্ষার মধ্য দিয়ে
‘তথাকথিত ভাবে
আলোকপ্রাপ্ত’ হননি
বলেই আমার পিসি সব থেকে
দেরী করে তাঁর ভাষাকে
ছাড়তে চেয়েছেন। অথবা
বলা ভাল, একদমই ছাড়তে
চাননি।
আগ্রাসনবাদীরা এই
কথাটা বেশ ভাল করেই
অনুধাবন করে নিয়েছেন।
ফলে তারা জানেন,
হাজারটা
‘আলোকপ্রাপ্তের’ ঘরে
আক্রমণ নামিয়ে আনার
থেকে একজন নিম্নবর্গীয়
মানুষের ঘরে আক্রমণ
শানিয়ে তার রুট-টিকে
উপড়ে ফেলতে পারলে অনেক
বেশী ডিভিডেন্ড পাওয়া
সম্ভব। ভার্চুয়্যাল
রিয়েলিটি তাকে সেই
সুযোগটাই করে দিয়েছে।
ক্ষমতায়নের নামে আসলে
এটি ক্ষমতা হরণ করেছে
নিম্নবর্গীয় মানুষের।
‘রাজার ঘরে যে ধন আছে,
আমার ঘরেও সে ধন আছে’ –
মার্কা সিন্ড্রোম একটা
মারাত্মক ফাঁদ তৈরী
করেছে। ‘রাজাকে’
আক্রমণ করার পরিবর্তে
‘আমরা সবাই রাজা’ ধরণের
এক বাস্তবতা সৃষ্টি
হয়েছে। রাজা মুচকি
হাসেন এসব দেখে। তিনি
থাকেন সুরক্ষিত।
হাজার বছর আগে
নিশ্চিতভাবে ভাষার
সংখ্যা বেশী ছিল।
প্রতিটি ইডিওলেক্টই
এক-একটি পৃথক পৃথক
ভাষা। এক একটি
জনগোষ্ঠীর সেই সব
ইডিওলেক্ট পাশাপাশি
থাকতে থাকতে একটি কমন
স্ট্র্যাকচার তৈরী
করে। এদিক থেকে দেখলে,
ভাষা যতখানি সমষ্টির
ঠিক ততখানিই ব্যক্তির।
হাজার বছর আগে জনসংখ্যা
অনেক কম থাকলেও, সেই সব
গোষ্ঠীর মধ্যে মিশ্রণ
কম ছিল। ফলে ছোট ছোট
জনগোষ্ঠীর মানুষেরা
সেই স্ট্র্যাকচরটিকে
সযত্নে রক্ষা করত।
রাজনৈতীক আগ্রাসন ও
ক্ষমতা দখলের প্রবণতা
যত বেড়েছে, ততই বেড়েছে
ভাষাকে আক্রমণ করবার
খেলা। আর একটি বিষয়ও
ভেবে দেখার। দিন দিন
আমাদের ইডিওলেক্টের
মধ্যে দূরত্ব কমে আসছে।
পৃথিবীর সব পাঁচতারা
হোটেলের অন্দরমহল যেমন
এক, আজ ভার্চুয়াল
রিয়েলিটির যুগে আমরা ও
আমাদের ভাষাও তেমন এক
হয়ে উঠছে।
ভাষাকে সুস্পষ্ট ভাবে
নিয়ন্ত্রন করে
রাজনৈতীক ও অর্থনৈতীক
ক্ষমতার দাপট। বাংলা
ভাষার ক্ষেত্রে যে
কথাটা খাটে, অন্য সব
ভাষার ক্ষেত্রেও সেই
কথাটাই ফিরে ফিরে আসে।
ভাষার ক্ষেত্রে
‘রাজধানীর’
ডায়ালেক্টকেই
প্রাধান্য দেওয়া হয়ে
থাকে। ফলে সেখানের
ডায়ালেক্টই ক্রমশ
ভাষার ‘মূলধারা’
হিসাবে পরিগনিত হয়ে
শুরু করে। একটি ভাষার
মধ্যে লুকিয়ে থাকা যে
হাজার আলোর বিচ্ছুরণ ও
রহস্য তা এভাবেই হারিয়ে
যায়।
ভাষার মধ্যে এই যে
বর্ণাশ্রম গড়ে ওঠা এর
ফল হয় মারাত্মক। যে
ভাষা নিজের মধ্যে
লুকিয়ে থাকা এই সব আলো ও
রহস্যকে মেরে ফেলে,
গিলে খায় সেই ভাষার
হাতেও লেগে থাকে রক্ত।
বাংলা ভাষার হাতেও সেই
রক্তই ফুটে আছে।
সুবর্ণরেখার দুই-তীরের
ভাষা, দাঁতন থেকে শুরু
করে কোচবিহার – এই
বিস্তীর্ণ অঞ্চলে
বাংলা ভাষার যে
বৈচিত্র্য ছড়িয়ে ছিল,
আমরা তাকে হত্যা করেছি।
‘আঞ্চলিক বাংলাভাষা’
নামে এক অশ্লীল
শব্দবদ্ধ তৈরী করেছি।
আমাদের এই
হত্যাকান্ডকে মান্যতা
দিতে আমরা হাতিয়ার
করেছি সুকুমার সেনের
মত’কে। যেন এর বাইরে আর
কিছু ভাবা ও বলার
অবকাশই নেই। এই মৌলবাদ
যে পরোক্ষে আমাদের
ভাষাকে দূর্বল করেছে
প্রতিদিন, সে কথা আমরা
ভেবে দেখিনি। ভাষার
মাৎস্যন্যায়ের দিকে
তাকিয়ে আজ যখন আমরা
আঁতকে উঠি, তখন মেনে
নেওয়া ভাল, আমাদের
ভাষাটিও অনেক ভাষাকে
গিলে ফুলে উঠেছে।
প্রতিদিন কিভাবে
কতগুলি ভাষা মৃত্যুর
দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তার
পরিসংখ্যান দেওয়ার আর
দরকার নেই। ইন্টারনেট
ঘাঁটলেই এই নিয়ে হাজার
হাজার তথ্য পাওয়া যাবে।
এটাই স্বাভাবিক ছিল।
এভাবে মরে যাওয়ার জন্য
ক্ষেত্র তৈরী করা
হয়েছিল বেশ কয়েক
দশকজুড়ে। লেখার মধ্য
দিয়ে ভাষা বেঁচে থাকে
না। সে বেঁচে থাকে
প্রতিদিনের ব্যবহারের
মধ্য দিয়ে। সেই
ব্যবহারের জায়গাটিকে
আজ দখল করে নিয়েছে
ইলেক্ট্রনিক্স-বার্তা
ও ইন্টারনেটের ভাষা। আজ
থেকে বছর পনেরো আগেও,
একজন মানুষের প্রতিদিন
যে পরিমান কথা বলার
দরকার হত, আজ তা হয় না।
অঙ্ক কষে দেখিয়ে দেওয়া
যেতে পারে, একজন মানুষ
দিনে একটাও কথা না বলে
দিনের পর দিন বেঁচে
থাকতে পারে। এবং তার
সমস্ত যোগাযোগগুলিকে
সে বজায়ও রাখতে পারে
আজ। কারণ তার হাতে
অসংখ্য অ্যপস। খাবার
অর্ডার দেওয়া থেকে শুরু
করে পাশের সহকর্মীর
সঙ্গে যোগাযোগ, সব
কিছুই সে করতে পারে
ইলেক্ট্রনিক্স
বার্তার মাধ্যমে।
মৌনীবাবার উদাহরণ ছাড়া,
আজ থেকে দু-দশক আগে এই
ব্যাপারটি কল্পনার
স্তরেও আনা যেত না। এবং
খুব বেশী খুঁটিয়ে দেখার
দরকার নেই, খালি চোখেই
দেখা যায়, পৃথিবীতে এই
ইলেক্ট্রনিক্স বার্তা,
ই-মেল লেখা হয় একটা কমন
প্যাটার্নে। এক কমন
সিন্ট্যাক্স মেনে চলা
হয়। খুব সীমিত পরিসরে
কাজ বুঝিয়ে দেওয়া ও
বুঝে নেওয়া ছাড়া সেখানে
আর অন্য কোনও পরিসর
রাখা হয় না।
আজ যে ভাষাকে মনে হচ্ছে
বড়-ভাষা, আসলে সেও
সুরক্ষিত নয়। সেই ক্রমশ
তলিয়ে যাচ্ছে সেই
দানবীর যোনির ভেতর।
আমি আজকাল মাঝে মাঝে
শিউরে উঠি সেই পৃথিবীর
কথা ভাবতে … সেই পৃথিবী,
যেখানে কোটি কোটি
মানুষ। কিন্তু কেউ কথা
বলছে না। রাস্তা-ঘাট
নদীর পাড় কোথাও মানুষের
মুখে কথা নেই। তার
চলে-ফিরে বেড়াচ্ছে। আর
তাদের সঙ্গে থাকা
যন্ত্র থেকে হাজার
হাজার বার্তা ছুটে
চলেছে প্রতি মিনিটে।
তাদের প্রত্যেকের ভাষা
এক।
শুধু দু’একজন পাগল
মাঝে মাঝে চিৎকার করে
উঠছে। কিন্তু তাদের
ভাষা বুঝতে পারছে না
কেউ। অথবা, যারাই সেই
একটি ভাষার বাইরে
অন্যভাষায় কথা বলার
চেষ্টা করছে তাদের
সবাইকে পাগল বলে
চিহ্ণিত করছে একটি
অ্যপ। ভূমকম্প পেরিয়ে
আসা ছেলে-মেয়ে ফোনও
করছে না। ‘মার্কড সেফ’
দেখে মা বুঝে নিচ্ছেন
তারা নিরাপদ।
এসব ভাবলেই দমবন্ধ হয়ে
আসে।