নটে গাছটি মুড়োলো, আমার
কথা ফুরোলো...
কথারা বর্ণিল রাধাচূড়া
হয়ে একেকদিন অঝোরে
ফুটতে থাকে। কথারা কখনো
ধূসর। তরল, কঠিন,
বায়বীয়। হালকা অথবা
ভারী। কথারা ফুরিয়ে এলে
একপাশে তাদেরকে ঠেলে
পর্দা টেনে হুট করে কেউ
একজন রাত্রি নামিয়ে
আনলো। সে মানুষটাকে
তুমি চিনতে। অথবা বলতে
পারো, তুমি ভেবেছিলে,
তাকে তুমি জানো। তোমার
অতল পরিধিতে তার
রাজ্যপাট বিস্তৃত ছিল।
সে এখন দূরতম প্রান্তে,
ফুঁৎকারে বাতি নিভিয়ে
কোমরে দু’হাত জড়িয়ে
প্রেমিকাকে কাছে টানার
পূর্বমুহূর্তে সে
অবশ্য আজ একপলক ভেবেছিল
তোমাকে। তার ভূ-গোলকে
তোমার সার্বিক
অস্তিত্ব বলতে সেটুকু।
তার স্মৃতিকাতরতার
ভেতর তুমি এক ক্ষণিকের
দর্শনার্থী। জ্বলতে
চাওয়ার প্রবল বাসনায়
সেই একজনের মুখনিঃসৃত
দমকা বায়ুর প্রতি
যথারীতি মৃদু আপত্তি
জানালো ঘরের বাতির
সলতে। তারপর নিভে গেলো।
শহরের অন্যপ্রান্তে
নচ্ছার চাঁদের একটুকরো
আলো জানালা বেয়ে এসে
তোমার উন্মুক্ত শরীরে
দাবাবোর্ডের নকশা
আঁকছিল। লঘু পায়ে সরে
সরে, এক্কাদোক্কা খেলতে
খেলতে দেখছ কিভাবে বদলে
যাচ্ছে দাবার ছক। শরীর,
ত্বক, ঘাম। খোলা চুল।
ত্বক ফুঁড়ে শরীরের ভেতর
প্রবেশ করলে তুমি,
অন্তঃস্থ নিজেকে ঘুরে
ঘুরে বেশ দেখা যাচ্ছে।
প্রদক্ষিণ শেষে
আবিষ্কার করছ আরেক
পৃথিবী। সূর্য, হাওয়া,
কোমলগান্ধার। ঘরের পর
ঘর। শহরের পর শহর।
বিপন্ন জনপদ।
কোলাহলমুখর সরাইখানা।
অরণ্য, মরুভূমি,
সমুদ্র। শত যুদ্ধের
ভেতর অস্তিত্ব টিকিয়ে
রাখার কথা ভূমি মৃদু
কম্পন দিয়ে জানান দিয়ে
গেল। ধোঁয়াশা। নীল আলো।
চক্রাকার সিঁড়ি নেমে
যাচ্ছে অন্ধকারতম
পাতালে। সেখানে কেউ
চীৎকারে বলছে, “কেন
বেঁচে থাকব? একটা কারণ
তো দেখাও। একটা কারণ
দাও আমাকে। নীল ফুঁড়ে
আকাশে উড়ব আবার।”
সান্তনা দিতে গিয়ে তুমি
হেসে উঠলে, রাস্তা বেয়ে
হেঁটে চলতে চলতে
বহিঃস্থ দাবার ঘরে।
দু’ পৃথিবীতে মূলতঃ
খুব তফাৎ নেই।
রাত প্রলম্বিত হলে
হিস্টিরিয়াগ্রস্ত
দেয়ালঘড়ি টিক টিক আওয়াজ
তোলে। টিকটিকিটাও গলা
মেলায়, টিক টিক ঠিক ঠিক।
পাশ্বর্বর্তী
ফ্ল্যাটের
পক্ষাঘাতগ্রস্ত রহমান
সাহেবের গোঙানির আওয়াজ
পাওয়া যায়। রাস্তায়
কুকুরের অকস্মাৎ ঘেউ
ঘেউ, রাত্রিকালীন বাস
আর ট্রাকের হর্ণ।
অনাকাঙ্ক্ষিত এইসব
শব্দের প্রক্ষেপণে
তোমার নির্ঘুম
প্রলম্বিত হয়। অস্থির
তুমি জানালা খুলে
তাকিয়ে দেখো নীলচে
বেগুনি আকাশ। দিন আর
রাতের মাঝামাঝি প্রহর।
তোমার দিন আর রাতের
ব্যবধান খুব বেশি কী?
কালো কফির কাপে চুমুক
দিলে। পাশাপাশি পান
করছো আবছায়া
অন্ধকারকে। পান করছো
নৈঃশব্দকে। পান করছো
তোমার একাকীত্ব। পান
করছো সেই একজনের
আনন্দযজ্ঞকে। শহরটি
ঘুমিয়ে আছে তো আছেই।
স্বপ্নের ভেতর ইতস্ততঃ
নড়েছে এদিক ওদিক। দিন
মাস বছর শেষে
যুগান্তরেও ঘুম ভাঙছে
না তার। অস্থির তুমি
আকাশে কফির কাপের
তলানিটুকু, সেইসাথে
একমুঠো আলোকদানা
ছিটিয়ে শহরের ঘুম
অবশেষে ভাঙিয়ে দিলে।
সকালের রোদ্দুর কেটে
কবুতরের ঝাঁক উড়ে
যাওয়ার পর দেখা গেল,
একটি কবুতর দোতলার
কার্ণিশে বসে। কখনো
আনমনে হাঁটছে। দেয়ালের
ফেটে যাওয়া রেখাতে ঠোঁট
গুঁজে খুঁজছে -- হয়ত
অন্য এক সরণী। অথবা
খাবারের দানা। হারিয়ে
যাওয়া ছায়া। অথবা
রোমহর্ষক কোন অভিযান।
পাখিদের পৌরাণিক
আখ্যানে আছে হয়ত,
আকাশের সবচেয়ে উপরের
লাল মেঘ আর স্বর্ণালী
পাহাড় ঘিরে রেখেছে এক
সরোবরকে, যেখানে
মধুক্ষণে পরি নেমে আসে,
পা ভেজায়! সেখানেই
যাওয়া যাক নাহয়! নাকি
কোন অভিমানে ছেয়ে আছে
তার মন ? অথবা কেবলই সে
ভাবছে, বোকাচণ্ডীদের
দলছুট হলাম, কি মজা !?
“শৈত্য কাটছে না”--
শীতের দেশে বরফের চাই
দু’হাতে সরিয়ে এক
বিকেলে গীটার তুলে নিলো
স্বল্পবাক লাজুক
ছেলেটি। “যদি কোনোদিন
তুমি দু’হাত দিয়ে ঝিনুক
কুড়াও / নেই আমি, সেই
অল্প ভাঙা গল্পগুলোয় /
কার সাথে বলো শব্দ
ছুঁড়ে ফিরব বাড়ি /
মাঝরাতে আমি তোমার কথা
বলবো কাকে?” সঞ্চারী
ছুঁয়ে গান থামিয়ে সে
চুপচাপ। এই হিরন্ময়
নীরবতায় তুমি গানটিকে
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখো।
গান বৃক্ষের মতন। বুকের
ভেতর রোপিত হয়ে
মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
গানের কলিগুলো ধীরে
ধীরে প্রস্ফুটিত
হচ্ছে। সুরের মৃদু লহরে
কাণ্ডে কাণ্ডে পাতা
মেলে দিচ্ছে। এই সুর
ঘূর্ণমান, বলয় সৃষ্টি
করছে তোমাকে ঘিরে। চোখ
তুলে একসময় ছেলেটি
তাকায়, “আমার মাথায়
একবার হাত বুলিয়ে
দেবেন?”
তোমার দৃষ্টি বারান্দা
পেরিয়ে বরফে ছাওয়া
লাইলাক ট্রিতে। সবুজ
পাতার কুঁড়ি উঁকি
দিচ্ছে। তুমি দেখতে
পাও, নাতিশীতোষ্ণ দেশের
কবুতরটি মেঘদেশের
সরোবরকে আবিষ্কার করতে
পাখা মেলেছে। দেখতে
পাচ্ছো, গানের অ আ ক খ এর
বিন্যাস সমাবেশের সুরে
কৃষ্ণচূড়ার ডালে রঙ
লেগেছে। দেখতে পাচ্ছো
কি, অন্তঃস্থপুর থেকে
রঙচঙে বেলুন নিয়ে
আকাশের নীল ফুঁড়ে উড়ছে
কেউ? দ্যাখো, চুলে ফুল
গুঁজে বসন্ত উৎসবে
মেতেছে মেয়েরা।
যুগলবন্দীতে রাস্তায়
হেঁটে যাচ্ছে
প্রেমিক-প্রেমিকা। চোখ
বন্ধ করেও তুমি দেখতে
পাচ্ছো, সুরে সুরে
বসন্ত আসছে। ছেলেটির
মাথার চুল এলোমেলো করে
দিয়ে অতঃপর আহ্লাদি
তুমি, বলতেই তো পারো, “
আরেকটা গান গেয়ে
শোনাবে? তোমার মাথায়
তাহলে হাত বুলিয়ে দিতে
পারি।”