গাছেদের টাইম টেবিলে
সারাদিনের কতই না
ট্রেন! আসে যায়! আসে যায়।
কেউ কেউ দলছুট! বা
ক্লান্ত। দাঁড়িয়ে দু
দণ্ড জিরোয়। তেমন
তাড়া'তো কিছু নেই।
ধাক্কা দেওয়া,ফেলে দিয়ে
এগিয়ে যাওয়া! ছি! ছি!
মাটি,জল আর আলোর তো কম
নেই কিছু! খামোখা অত
উদ্বিগ্নতায় শরীর
খারাপ হয়। বুড়ো গাছ
ওদের গল্প শোনায়। ওরা
চুপ করে শোনে। আনন্দ
হলে পাতা ঝমকায়! বর্ষায়
বসন্তে উৎসবে মাতে।
অবশ্য ওদের প্রতিদিনই
উৎসব! মা গাছ মেয়ে গাছকে
বলে,খুকি আর যাই
করিস,মানুষ থেকে দূরে
থাকিস!
বুড়ো রেড উডে সুবিশাল
পাখি রাজ্য। এখানে যেমন
বৃষ্টি তেমন রোদ,ফুলের
ওপর বসে পাখিরা দোল
খায়। মিটিং করে। গান
শেখাতে নাইটিংগেল
দিদিমণি আসলে ওরা দল
বেঁধে গান গায়। খুব
শীতে ওরা দল বেঁধে
বেড়াতে পুবের পাহাড়ে।
সেখানে অনেক রোদ। কেবল
মানুষ দেখলেই মুখ
ভেটকায়! সেদিন ম্যাপল
গাছের কথায় তার
প্রেয়সীকে চিঠি পৌঁছতে
যাচ্ছিল ছোট টুনটুনি।
পথে মানুষ দেখে ফিরে
এসেছে! তাকে দাদু বলেছে
ওরা খুব খারাপ!
- কেন দাদু?
- ওদের খুব হিংসে।
অসূয়া! সারাটাক্ষণ ওরা
নিজেরা মারপিট দাঙ্গা
করে!
এত কথা ছোট টুনটুনি
বোঝেনি। কিন্তু
খারাপটুকু বুঝেছিল।
এখন অবশ্য বসন্ত! ওরা
নাচছে গাইছে খেলা
করছে...
পিটার উলেভেন কে
চেনেন?রিচার্ড কার্বান?
সুজেন শিমার্ড? জগদীশ
বসু?পিটার,
জার্মানফরেস্টার।
ইকোলজিস্ট।
রিচার্ডবোটানিস্ট,
কালিফোর্নিয়া নিবাসী।
সুজেন আমাজনের গভীর
জঙ্গলে কাটিয়ে দিয়েছেন
বছরের পর বছর। ওরা
বলেছেন, গাছেরাও
কথাবলে। ভাব এবং তরঙ্গ
বিনিময় করে। ম্যাপল
গাছরা আক্রান্ত হবার
আগে শঙ্কেত বিনিময় করে।
তথ্যের আদানপ্রদান করে
ওরা ছত্রাকদের
মাধ্যমে। আর আমাদের
জগদীশবসু,তার অব্যক্ত
নামক প্রবন্ধসংকলনে
গাছের কথায়,যা
লিখেছিলেন তা নিম্নে
তুলে ধরা হল।
একদিন বাড়ি আসিয়া
দেখি,খোকার বড় জ্বর
হইয়াছে; মাথার বেদনায়
চক্ষু মুদিয়া
বিছানায় পড়িয়া আছে।
যে দুরন্ত শিশু
সমস্তদিন বাড়ি অস্থির
করিয়া তুলিত, সে আজ
একবার চক্ষু খুলিয়াও
চাহিতেছে না। আমি তাহার
বিছানার পাশে বসিয়া
মাথায় হাত বুলাইতে
লাগিলাম। আমার
হাতেরস্পর্শে খোকা
আমাকে চিনিল এবংঅতি
কষ্টে চক্ষু খুলিয়া
আমার দিকে খানিকক্ষণ
চাহিয়া রহিল। তারপর
পায়রার ডাক ডাকিল। ঐ
ডাকের ভিতর আমি অনেক
কথা শুনিলাম। আমি
বুঝিতে পারিলাম,খোকা
বলিতেছে, ‘‘খোকাকে
দেখিতে আসিয়াছ? খোকা
তোমাকে বড়
ভালোবাসে।’’ আরওঅনেক
কথা বুঝিলাম, যাহা আমিও
কোনো কথার দ্বারা
বুঝাইতে পারি না।
যদি বল, পায়রার ডাকের
ভিতর এত কথা কি করিয়া
শুনিলে? তাহার উত্তর এই-
খোকাকে ভালবাসি
বলিয়া। তোমরা
দেখিয়াছ, ছেলের মুখ
দেখিয়া মা বুঝিতে
পারেন, ছেলে কি চায়।
অনেক সময় কথারও আবশ্যক
হয়না। ভালবাসিয়া
দেখিলেই অনেকগুণ
দেখিতে পাওয়া যায়,
অনেককথা শুনিতে পাওয়া
যায়।
আগে যখন একা মাঠে
কিংবাপাহাড়ে
বেড়াইতে যাইতাম তখনসব
খালি-খালি লাগিত। তার
পরগাছ, পাখী, কীট
পতঙ্গদিগকেভালবাসিতে
শিখিয়াছি। সে
অবধিতাদের অনেক কথা
বুঝিতে পারি,আগে যাহা
পারিতাম না। এই
যেগাছগুলি কোনো কথা বলে
না,ইহাদের যে আবার একটা
জীবনআছে, আমাদের মতো
আহার করে,দিন দিন বাড়ে,
আগে এ সব কিছুইজানিতাম
না; এখন
বুঝিতেপারিতেছি। এখন
ইহাদের মধ্যেওআমাদের
মতো অভাব,
দুঃখ-কষ্টদেখিতে পাই।
জীবনধারণ করিবারজন্য
ইহাদিগকেও সর্ব্বদা
ব্যস্ত থাকিতে হয়।
কষ্টে পড়িয়া ইহাদের
মধ্যেও কেহ কেহ চুরি
ডাকাতিকরে। মানুষের
মধ্যে যেরূপ
সদ্গুণআছে, ইহাদের
মধ্যেও তাহার কিছুকিছু
দেখা যায়। বৃক্ষদের
মধ্যে একে অন্যকে
সাহায্য করিতে দেখা
যায়, ইহাদের মধ্যে একে
অপরের সহিত বন্ধুতা
হয়। তারপর মানুষের
সর্ব্বোচ্চ গুণ
স্বার্থত্যাগ-গাছে
তাহাও দেখা যায়। মা
নিজের জীবন দিয়া
সন্তানের জীবন রক্ষা
করেন। সন্তানের জন্য
নিজের জীবন-দান
উদ্ভিদেও সচরাচর দেখা
যায়। গাছের জীবন
মানুষের জীবনের ছায়া
মাত্র। -
নোর্স মিথোলজিতে সেই
সমস্ত ব্যক্তিকে প্রবল
জ্ঞানী ভাবা হত,যারা
পাখীর ভাষা বুঝতে পারত।
দেবতা ওডিনের দুই প্রিয়
র্যাভেন ছিল,হুজিন ও
মুমিন। তারা সারা
দুনিয়া ঘুরে বিবিধ খবর
এসে তাঁকে জানাতো।
গ্রীক মিথোলজিতে
এপোলিনিয়াসের
কাহিনীতে জেসনের আর্গো
বলে এক জাহাজ ছিল
যা,পাখির ভাষা বুঝতো।
রাশিয়ান লোককথায়,
ভাসিলকে মনে আছে? যে
পাখির ভাষা বুঝতো।
ব্যবসায়ী বাপ সামনে বসা
নাইটিংগেলের করুণ ডাক
শুনে যখন বিরক্ত
হয়,জিজ্ঞেস করে ওরা কী
বলছে তুমি বুঝতে পারো?
পুত্র শঙ্কিত হয়ে
জানায়,ওরা জানাচ্ছে
আমার বাবা ও মা আমার দাস
হয়ে থাকবে। সেবা যত্ন
করবে আমার। ক্রুদ্ধ বাপ
সে কথা শুনে অত্যন্ত
বিরক্ত হয়ে ঘুমন্ত
সন্তানকে তুলে নিয়ে
সমুদ্রে ভাসমান জাহাজে
তুলে দেয়...
সালিম আলি বা অজয় হোম,
জগদীশ বসু,পিটার,সুজেন
বা রিচার্ড হয়ত
ব্যতিক্রম! সবজান্তা
মানুষ জাত হয়তবা বোঝে এ
মর্ত্য পৃথিবীর সকল
প্রজাতিরই আছে নিজস্ব
ভাষা ও উপলব্ধি। তারা
‘অনেক কথাই যায় যে বলে
কোনো কথা না বলে’। হয়ত
মানুষের ভাইব, লেন্থে
তা আসেনা! ওরা
কালেক্টিভলি
সংখ্যাগুরু। আদিমতম
ভূমিপুত্র বা কন্যা এই
ধরিত্রীর। কিন্তু
মানুষতো! সব জেনে বুঝেও
কালের নিরীখে অ-পরকে
মুছে দিয়ে স্বীয় চিহ্ন
রাখতে উদ্যত হয়! কিন্তু
যদি ইকোলজি সত্য
হয়,মহাকাল এক অমোঘ সত্য
হয়,তাহলে ওই দ্বেষ, আর
আমি সর্বস্ব মনুষ্য
প্রজাতির চরম অকল্যাণ
ডেকে আনছে কুঠার হাতে
কালিদাস সম মানুষ...
আর,সে কথাই আলোচনা
করছিলো ফড়িং
দিদিমা,বুড়ো বট,তরুণী
নদী,প্রৌঢ় টিলা,আর
আদিম কচ্ছপ! কিছু দূরে
গল্পে মশগুল
পাখি,পাখিরা আর পাহাড়
টাহাড়,রহস্যময়ী
অরণ্যকে ইমপ্রেস করার
প্রাণপণ চেষ্টায় চিতল
হরিণ নাচছে...
আমরা,যারা নিতান্ত
ঐহিকান আজ রাতে সেই সব
গাছ,গাছালি,পাখ
পাখালি,নদী অরণ্য বা
আদিম প্রাণের
আনরেকগনাইজড ভাইব ও
চেতনারাশিকে মানুষের
কথায় ডকুমেন্টেড করে
রাখার চেষ্টায়। কারণ আজ
২১। আজ মাতৃভাষা দিবস।
আর ওদের ও
ব্যথা,প্রেম,ভাষা আছে।
তাই,ঐহিক অনলাইনে
প্রকাশিত হল আরণ্যক।
বোকা দ্বেষ ও অসূয়া
সর্বস্ব মানুষের হিত ও
কল্যাণ কামনায় এ এক
অক্ষম চেষ্টা কি'না তা
অবশ্য ইতিহাস বলবে।
আপাতত অপেক্ষা...
২১ফেব্রুয়ারি,২০১৯
কলকাতা
ভারত