(১)
ফোন বাজছে সুদৃশ্য
ড্রয়িংরুমে ।
- হ্যালো ।
- মিসেস সেনগুপ্ত ?
- হ্যাঁ ।
- আপনার স্বামী কথা
বলবেন ।
বিমলেশের সন্ত্রস্ত
গলা ।
- রূপসা , আমার স্টাডির
ড্রয়ারে কোনও চেক আছে ? ...
। নেই ? বেডরুমের
ড্রয়ারটায় ? ... । নেই ?
আলমারির লকারে ? ... আছে !!
একটা জরুরি পেইমেন্ট
আছে , চেকটা আনতে ভুলে
গেছি ! প্লীজ চেকটা নিয়ে
আমার অফিসে চলে এস ।
- তোমার তো এরকম ভুল হয়
না !!
বিমলেশ ফোনটা কেটে দেয়
।
(২)
পা ভিজিয়ে
প্রিন্সেপঘাট ।
বিকেলের শেষ রোদে
পাগলামি । অফিস থেকে
বেরিয়ে পড়ে বিমলেশ ।
হাঁটার অভ্যাস না
থাকলেও অসুবিধে হয় না ।
বৃষ্টি কতকিছুর সাক্ষী
। আজ হিসেবের বাইরে
নিজেকে খোঁজা । গত
সাতদিনের জমা কথা ,
স্ত্রীকে এড়িয়ে যাওয়া ।
প্রথম
অ্যানেভার্সারিতে
এরকম বৃষ্টিতেই
ভিজেছিল সে আর রূপসা ।
আজ ফিফথ । প্রচণ্ড
মানসিক চাপে তা ভুলে
গেছে! সে সিগারেট ধরায় ।
এই গাছটার নিচেই সেদিন
রূপসার সাথে ...
বিমলেশ আদ্যপান্ত
কর্পোরেট মাল্টি -
ন্যাশনালে সিনিয়র
ম্যানেজার । সকালে অফিস
, রাতে ফেরা । লাঞ্চ ,
ডিনারের ঠিকানা শহরের
নামীদামী রেস্তোরাঁ ।
হিসেবী যাপন । তবু
সময়বিশেষে বিমলেশ
বেহিসেবি , বেপরোয়া
হয়েছে । একটা টেন্ডার
ডিলিংএর মিটে মিঃ
আহলুওয়ালিয়ার সাথে
রেষারেষি লাগে । বড়
টেন্ডার ছিনিয়ে নিতে
সেদিন ও বেপরোয়া হয়ে
উঠেছিল । অফিসে সবার
মুখে সিনিয়র
ম্যানেজারের জয়ধ্বনি ।
বিমলেশ বারো কোটি টাকার
টেন্ডার এনেছে , অফিস
তাকে বোনাস , আরও কি কি
যেন দেবে ! সবই ঠিক চলছিল
... তবু ...
(৩)
আজ নিয়নে বৃষ্টি লেগেছে
। আলো - আঁধারিতে
বৃষ্টিভেজা বিমলেশ ।
স্যুট , টাই , খালি পা ,
হাতে ল্যেদার বুটে মোজা
। সারা গায়ে জল টপটপ ।
জুতো , মোজা পড়তে পড়তেই
ভাবে , বাড়ি ফেরার সময়
এসবের কি প্রয়োজন ? অথচ ‘
বাড়ি ’ তাকে এইরকম
দেখতেই অভ্যস্ত ।
এভাবেই সে বেরোয়ে
অফিসের ঠিকানা লেখা
অডিতে । এভাবেই তার
ফেরার পথ আগাম
নির্ধারিত ।
মানুষের ডাকে সম্বিৎ
পায় বিমলেশ । দু - তিনজন
ভাঙা উনুনে ভেজা কাঠ
জ্বালাতে ব্যাস্ত ।
বিমলেশ উত্তাপের আশায়
এগিয়ে আসে । বৃষ্টিভেজা
দেশলাইয়ে আগুন নেই , তাই
লাইটার এগিয়ে দেয়।
অস্বস্তি মেখেই
আশ্বস্ত হয়ে বসে
মানুষগুলোর পাশে ।
লোকগুলো সন্ত্রস্ত ।
এরা বিমলেশের বাড়ির
সামনের ফুটপাথে রুটি
পাকায় । সকালে দাঁতনের
ফাকে বিমলেশকে গাড়িতে
দেখে । আবার রাতের
উনুনে জল ঢালার সময়ে
তার প্রত্যাবর্তনের
সাক্ষী । হঠাৎ খেয়াল হয়
ফোন বাজছে ।
- হ্যালো ?
- সাব , আপ কব নিকাল
গ্যায়ে ? জশন প্যাট সাব
আপকো পুঁছ র্য হে থে ।
বোলা কি আপ ...
বিমলেশ ভাবছে । সত্যিই
মনে পড়ছে না বিকেলে কখন
বেরিয়েছে! ফোনটা কেটে
গেছে ব্যাটারির অভাবে
।
একটু হুইস্কি পেলে ভালো
হত। রুটি পাকানেওলাদের
বলতেই তারা হাঁসে - ‘
বাংলা ’ আছে । বাংলা তো
বিমলেশ খায়না !
জিন্দগী , ক্যায়সি
হ্যায় পহেলি হাঁ ইয়ে ,
কাভি ইয়ে হাসায়ে... ।
করকরে ট্রানজিস্টারে
ছোটোবেলা লেগে আছে ।
বাবার একটা গানের কল
ছিল । কত রেকর্ড বাবার
কোলে বসে শুনেছে ! ভেজা
স্যুটটা রাস্তায় পেতে
ফেলে । বাংলা - ই সই ।
ধাতস্ত হতে পারছে না ।
সমস্যাটাও মেটেনি ।
রিয়ার কথা মনে পড়ছে ।
পাপা না ফিরলে ঘুমাতেই
পারে না ! ফোনটাও অফ !
বাড়ি যেতে ইচ্ছেও করছে
না । রুটি পাকানোর
উনুনের পাশেই শুয়ে পড়ে
। মাথার ওপর পরিস্কার
আকাশ । তারা ঝকমক করছে ।
তিনটে তারা জুড়ে ওরায়ন
’ স বেল্ট । রিয়া একদিন
টেরেসে এই তারা দেখিয়ে
বলেছিল ।
- পাপা , ইউ , মাম্মা এন্ড
মি ।
আরও বেহিসেবি হতে মন
চায় । একট সাদা গাড়ি
আসছে । তার গাড়ি ! হি ইস
কট ! হিস গেমস আর আপ !
স্যুটটা হাতে নিয়ে উঠে
দাঁড়ায় । গাড়ি থেকে মিঃ
দাশ আর একজন অফিসার
নামে ।
(৪)
বিয়ের আগে বিমলেশ যে
কোম্পানিতে কাজ করত ,
তার মালিক ছিলেন রূপসার
বাবা । স্বভাবতই চাননি
ইনফিরিয়র
সাব - অর্ডিনেটের সাথে
মেয়ের বিয়ে দিতে ।
সেদিন রূপসার গ্লাসগো
ইউনিভার্সিটি থেকে এম.
ফিল করে ফেরার দিন ।
রিসিভ করতে এয়ারপোর্টে
গিয়েছিল বিমলেশ ।
সেখানেই রূপসার বাবা
তাকে প্রোমোশন লেটার
এবং মোটা টাকার চেক
ধরিয়ে মুম্বাইয়ের
ব্রাঞ্চে পাঠানোর জন্য
মুম্বাইয়ের প্লেন ধরতে
বলেন। রাগে চেক ছিঁড়ে
ফেলে দিয়েছিল বিমলেশ ।
প্রোমোশনের লেটারের
পেছনে নিজের
রেসিগ্নেশন লিখে ফেরত
দিয়েছিল । না , উত্তরের
অপেক্ষা সে করেনি।
রূপসাও বাবার
মার্সিডিজে না উঠে ,
বিমলেশের সাথে
ট্যাক্সিতে ফিরেছিল
তার টু-বিএইচকে
ফ্ল্যাটে । তারপর বিয়ে
হল , রিয়া হল আর শুরু হল
বিমলেশের
নতুন জীবন ।
বিমলেশ আবার চেক ছিঁড়ে
ফেলেছে ! টেন্ডার জেতার
রাতে অফিসের কেবিনেই
পার্টিতে ছিল তার বস
মিঃ জেসন প্র্যাট ,
এলাহাবাদ ব্রাঞ্চের
মিঃ দাশ এবং মিঃ
আদজানিয়া। সাথে স্কচ ও
অন্যান্য দামি খাবার ।
বিমলেশ দেখাচ্ছিল
আহলুওয়ালিয়ার সাথে তার
রেষারেষির
ক্লাইম্যাক্স । কিভাবে
উত্তেজনার বসে
আহলুওয়ালিয়ার নিজের
টেন্ডার ফাইল ছিঁড়ে
ফেলে মিটিং থেকে বেড়িয়ে
যায় । বিমলেশ সেই অভিনয়
করতে গিয়ে টেবিলে রাখা
কিছু কাগজ আর টেন্ডারের
অ্যাডভান্স চেকটা
নেশার ঘোরেই ছিঁড়ে ফেলে
!
সপ্রশংস হাততালির
মধ্যেই বিমলেশ বুঝতে
পারল , এ ভুল কিছুতেই
রেক্টিফাই করা সম্ভব না
। বিমলেশ ক্লান্ত ভেবে
সবাই ঠিক করে , নেক্সট ডে
বিমলেশ টেন্ডারের
ডক্যুমেন্টস মিঃ জেসন
প্র্যাট এবং মিঃ
আদজানিয়ার কাছে জমা
দেবে । চেক এমাউন্ট ছিল
পঞ্চাশ লাখ । বিমলেশ
ভেবে নিল , নিজের দোষ
স্বীকার করে সময় চেয়ে
নেবে । বলবে চেক
মিসপ্লেস করে ফেলেছে ।
হি উইল পে দ্য এমাউন্ট।
আজ বিকেলেই। মানসিক
চাপে বাড়ি থেকে চেকটা
আনার কথা মনেই রইল না ।
বিকেলে ড্রাইভার
পাঠিয়ে আনিয়ে নেবে
ভেবেছিল । বৃষ্টিটা এসে
সব এলোমেলো করে দিল ।
(৫)
রিয়া ঘুমিয়ে পড়েছে।
লাস্ট থ্রি আওয়ার্স
ওয়্যার রোলারকোস্টার ।
অফিসে যেতেই মিঃ
প্র্যাট প্রশ্ন করেন ।
- আই নো দ্য ট্রুথ । ইউ
কেম অ্যান্ড
অ্যাডমিটেড ইউর
মিস্টেক । উই গেভ ইউ
টাইম । নাও টেল মি চেকটা
আজ সাবমিট করলে না কেন ?
- স্যার , সেদিন ...
- ছিঁড়ে ফেলেছ তো ?
পরেরদিনই আমি স্টেপ
নিতাম । বাট আই থট ইউ
ডিসার্ভ সেকেন্ড চান্স
। আজ পালালে কেন ?
- নট ইন প্রপার সেন্স ।
চেকটা বাড়িতে । প্লীজ
সেন্ড মাই ড্রাইভার টু
ব্রিং ইট ।
- ইউ আর লুকিং আ বিট
আনহ্যাপি ।
- ইয়েস স্যার । আই ডিড আ
মিস্টেক । ডিউ টু
ট্রিমেন্ডাস মেন্টাল
প্রেসার , আই ফরগট দ্যাট
টুডে ইজ মাই ফিফথ
অ্যানেভার্সারি ।
- ইজ ইট ! দেন কল ইউর ওয়াইফ
টু ব্রিং দ্য চেক । উই মে
এরেঞ্জ আ লিটল পার্টি
ইন হার অনার ।
অফিসেই ছোটোখাটো
সেলিব্রেশন হল । বিমলেশ
, রূপসা , রিয়া , বিমলেশের
কলীগরা এবং বসেরা ।
রিয়া তো
মিঃ প্র্যাটের কোল থেকে
নামতেই চাইছিল না ।
রূপসা চেক নিয়ে এসেছিল
। বিমলেশকে তবুও
চিন্তিত দেখে মিঃ
প্র্যাট এগিয়ে এলেন ।
- ফরগেট ইট সেনগুপ্তা ।
ইউ ডিড নাথিং বাট আ
মিস্টেক । উই নো ইউর
ডেডিকেশন । আমরা জানি
তুমি ইচ্ছে করে করোনি ।
বাট আই মাস্ট ওয়ার্ন ইউ ,
এরকম এরর মাফ করা হবে না
। বাই দ্য ওয়ে , তোমার
গার্ল কমপ্লেন করল তুমি
ওকে একদম টাইম দাও না !
ইটস এ বিগার মিস্টেক !
টেক এ স্মল ভ্যেকেশন ।
ইউ নিড ইট । সি ইউ নেক্সট
উইক ।
শরীরটা এলিয়ে দিল
বিমলেশ । রূপসা মাথায়
হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ।
জানলার বাইরে বৃষ্টি ।
আজ বহুদিন পর দুটো মন
আবার বৃষ্টি ভিজল । ভুল
থেকে জল গড়িয়ে দুই
চোখের পাতা ভারী হতে
হতে , রাত নেমে এল চার
হাতে ।