১
বিছানায় ছিটকে উঠে বসে
তিন্নি । একটু আগে
ঘুমের মধ্যে আবার মরে
গেল সে । দরদর করে ঘামতে
ঘামতে তিন্নি স্বপ্নটা
মনে করবার চেষ্টা করল ।
গলির ঠিক সেই মোড়টায়
এসে সে থেমে গিয়েছিল,
যেখান থেকে ঘুম শুরু হয়
। খুব সাবধানে এইবারে
ডান দিকে না ঘুরে ঠিক
বাঁদিকেই পা বাড়িয়েছিল
। কিন্তু ভুল , ভুল হয়ে
যায় বারবার ... কি মনে হতে
চোখ বুজে তিন্নি পা
বাড়ায় ,
আর ঘুম !
ঘুমটা ঠিক যেন ওঁত
পেতেছিল গলির মুখে , মোড়
ঘুরতেই তিন্নিকে একদম
গিলে ফেলল ।
২
বিয়েতে কে যে একটা টর্চ
গিফট্ করেছিল খেয়াল
করতে পারে না তিন্নি ।
পুরোনো ব্যাগ গোছাতে
গিয়ে সেটা হাতে পড়ে
যায়। খুলে দেখে , ভিতর
ঠিক গুণে গুণে দুটো
গুলি রাখা , দেওয়ালের
দিকে টর্চটা তাক করে
ট্রিগার টেপে তিন্নি ,
দেওয়ালে আলোর বল আছড়ে
পড়ে । স্যুইচ অফ করে
শক্ত মুঠোয় টর্চ আঁকড়ে
বসে তিন্নি কিসব যেন
ভাবতে থাকে ।
“ ওর নাম রাখবো আলো ”
“ ব্যাক ডেটড , ... আর যদি
ছেলে হয়? ”
“আলো – ই ”
“ ছেলের নামও আলো ?! ”
“ আলো তো আলোই , তার আবার
জেন্ডার কি ! ”
“যা ভালো বোঝো , ”
তিন্নির পেটে হাত রেখে
আশমান ঘুমিয়ে পড়ে ,
তিন্নি ঘুমোতে পারে না ,
সে দেখে তার পেটের ওপর
রাখা আশমানের হাত আলোয়
আলো হয়ে যাচ্ছে , তীব্র
আলোয় চোখ রেখে তিন্নির
ঘুম আসে না ।
প্রথম দিন তার হাতে
একটা লাটাই ছিল , ঘুড়িটা
উড়ছিল পত পত করে , গলি
দিয়ে দৌড়ে আসছিল তিন্নি
, সামনেই একটা মোড়।
রাস্তা চলে গেছে দুই
দিকে । কেন জানি
ডানদিকেই পা বাড়াল
তিন্নি । আর দুম করে
ঘুমের মধ্যে ঢুকে এল ।
অন্ধকার ঠান্ডা একটা
ঘুম , পায়ের তলায় আর
রাস্তা থাকলনা , গলিটা
কোথায় যেন গুম হয়ে যায় ।
লাটাইটাও কোথায় চলে গেল
, ... এক অন্ধকারের মধ্যে
তিন্নি ঘুড়ির সুতো ধরে
দাঁড়িয়ে পড়ে। সুতো সোজা
উঠে গেছে ওপরে । ঘুড়িটা
সেখানে স্থির দাঁড়িয়ে
আছে তিন্নির মতই ,
অন্ধকারে । সুতো ছেড়ে
দেয় তিন্নি , সুতো সহ
ঘুড়িটা স্থির হয়ে
অন্ধকারে ঝুলতে থাকে ।
তিন্নি বোঝে এখানে
কিচ্ছু নেই , আলো নেই ,
হাওয়া নেই , সময়ও না ।
তিন্নি বোঝে সে মরে
গেছে , অথবা জন্মায় নি ।
সুতো ছেড়ে অন্ধকারে
হাঁটতে শুরু করে তিন্নি
। সামনে কিছু নেই ।
কোথাও কিছু নেই ।
৩
মেঝেতে একরাশ পেঁয়াজ
নিয়ে বসেছে তিন্নি ,
একেক করে খোসা ছাড়াচ্ছে
, পেঁয়াজের পালক উড়ে উড়ে
যাচ্ছে ঘরের কোণায়
কোণায় । তিন্নির চোখ
লাল , টপ টপ করে জল ঝরে
পড়ছে ছুড়ির গায়ে , মসৃন
গা বেয়ে জল নেমে যাচ্ছে
পেঁয়াজের টুকরোতে ।
বিছানায় আধশোয়া আশমান
বলে ওঠে
“ কেন এমন হয় তিন্নি ? ”
মুখ তুলে তাকায় সে , তার
চোখ জলে ঝাপসা , আশমানের
মুখটা প্রচন্ড
কালো , - অন্ধকার মনে হয়
তার ।
“ কি হয় ? ”
“ পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে
রোজ বেশি করে কেঁদে
ফেলো ! ”
তিন্নি কিছু বলে না ,
কারেন্ট চলে যায় ।
অন্ধকার ঘরে ছুরি হাতে
বসে সে , কিছু দূরে আশমান
শুয়ে আছে । পাশেই রাখা
টর্চ জ্বালায় তিন্নি ,
দেশালাই খুঁজবে বলে ।
এদিক ওদিক দেখে তিন্নি
আশমানের মুখে টর্চের
আলো ফেলে । আশমান ভুরু
কুঁচকে বলে ,
“ কি হল ? ”
“আলো খুঁজছি ... ”
“ আলো দিয়ে ? ” ভুরু
কুচকেই হাসে আশমান ।
তিন্নিও অল্প হাসে ।
৪
আজ গলি দিয়ে টর্চ হাতে
দৌড়চ্ছে তিন্নি ,
সামনেই সেই মোড় , বাঁ
দিকে পা বাড়ানোর আপ্রাণ
চেষ্টা করেও সে আবার
ডান দিকেই ঢুকে পড়ে । ...
এবং সেই অন্ধকার ।
কিন্তু তিন্নি ভয় পায়
না , টর্চের ট্রিগার
টিপে ধরে ।
আলো কোথাও পড়ে না ,
অন্ধকারের মধ্যে
টর্চের আলো হারিয়ে যায়
। তবু আলো জ্বেলে
জ্বেলে তিন্নি এগিয়ে
চলে , এগিয়ে যায় ,
অনেকক্ষণ চলার পর দেখে
মাটিতে এক বিরাট নল পড়ে
আছে । নলের কাছে গিয়ে
দাঁড়ায় তিন্নি , সেখান
থেকে টপ টপ করে আলোর কণা
কালো মেঝেতে পড়েই
মিলিয়ে যাচ্ছে । হঠাৎ
নলটা নড়ে উঠে তিন্নির
নাভির সাথে আটকে গেল ...
আর অন্ধকারে কোথা থেকে
যেন জল নামতে লাগল ,
পিচ্ছিল
দুর্গন্ধযুক্ত জল জমে
জমে তিন্নিকে ডুবিয়ে
দিতে লাগল ।
তিন্নি বুঝল সে তার
মায়ের গর্ভে ফিরে
এসেছে। তিন্নি ডেকে
উঠল, “ মা ! ”
অন্ধকার কাঁপিয়ে একটা
বাচ্চা যেন তাকে ভেঙিয়ে
ডাকল , “ মা ! ”
একবার নয় , বারবার , “ মা
মা মা মা ” , অনবরত ডেকেই
চলল বাচ্চাটা মা বলে ।
তিন্নি বুঝল , ওটা আলোর
গলা । তার মা নয় , নিজের
সন্তানের গর্ভে , আলোর
গর্ভে ঢুকে পড়েছে
তিন্নি ।
ছিটকে ঘুম থেকে বেরিয়ে
এসে তিন্নি বিছানায় উঠে
বসে ।
“ কি হল ? ”
“ আশমান ,
ওর তো আলো হওয়া উচিত ছিল
, ও এত অন্ধকার !
এত অন্ধকার কেন আশমান !
কেন অন্ধকার ! ”
তিন্নির মাথায় হাত
বুলোতে থাকে আশমান, “
শুয়ে পড়ো , কাল স্কুল আছে
...
শুয়ে পড়ো ”
৫
স্কুল থেকে ফেরার পথে
ক্লিনিকের সুধাদির
সাথে দেখা হয়ে যায়
তিন্নির ।
“ ভালো তো ? ” মহিলা
তিন্নির চোখে চোখ রেখে
জানতে চান ।
তিন্নি হাসে ।
“ বাড়ি ফিরছো ? ”
“ হ্যাঁ ”
“ চলো , আমিও যাবো ওইদিকে
”
সুধাদির সাথে নিশ্চুপ
চলতে থাকে তিন্নি ।
“ আশমান বাড়িতে ? ”
“ না ”
“ অফিস খুলেছে ওর ? ”
“ হ্যাঁ খুলেছে ”
সুধাদি কি যেন ভাবতে
থাকেন ,
“ ডিসেম্বরের শুরুতেই
খুলেছে ” তিন্নি বলে ।
“ সেকি ! তুমি তো
নভেম্বরের শেষে
ক্লিনিকে এসেছিলে , না ?
”
“ উনত্রিশে নভেম্বর ”
আর কিছু বলে না তিন্নি।
সুধাদিও চুপ করে হাঁটতে
থাকেন। বটতলায় এসে
সুধাদি বললেন, “ এবার
আমি বাঁ দিকে যাবো ,
তিন্নি , ভালো থেকো । ”
“ সুধাদি , ”
সুধাদি ফিরে দাঁড়ান , “
বলো ... ”
“ ওই অবস্থায় সুধাদি ...
আশমান নভেম্বরেও বাড়ি
বসে ... আলোকে পৃথিবীতে
আনা ওই অবস্থায় অসম্ভব
ছিল সুধাদি ” তিন্নির
গলা আটকে আসে ।
সুধাদি এগিয়ে এসে
তিন্নির কাঁধে হাত
রাখেন, “ ভুল হয়েছে
তিন্নি , বড় ভুল হয়ে গেছে
, কিন্তু তার জন্য দায়ী
তুমি নও,- সময়। ”
তিন্নি মুখ তুলে তাকাতে
পারে না, “ আমি আসি
তিন্নি , ভাল থেকো ”
সুধাদি চলে যান ।
গলি দিয়ে হাঁটতে থাকে
তিন্নি , সুধাদি একটু
আগেই বাঁদিকে হেঁটে
গেছেন । জেনে বুঝে
তিন্নি ডানদিকে ঢুকে
আসে , অন্ধকার মেঝেতে
স্কুলের ব্যাগ নামিয়ে
রাখে । ঘুড়িটা এখনও
সেইখানেই ঝুলছে যেখানে
সে তাকে ছেড়ে গিয়েছিল ।
আরো কিছুটা এগিয়ে নাড়ির
সামনে এসে দাঁড়ায়
তিন্নি । তার সামনে
মেঝেতে শুয়ে পড়ে সে ,
নাড়িটা এসে তিন্নির
নাভিতে লেগে যায়।
অন্ধকার মেঝেতে বুকের
কাছে পা মুড়িয়ে আলোর
গর্ভে শোয় তিন্নি । কি
কারণে যেন তার খুব
কান্না পেয়ে যায় ।
তিন্নির চোখ জলে ঝাপসা
হয়ে মেঝেতে সেই জল জমতে
শুরু করে , তার আবছা
দৃষ্টির পিছনে অন্ধকার
পাতলা হতে থাকে ।
একসময় তিন্নি বোঝে
অন্ধকার আর নেই , তার
চোখে এখন শুধুই আলো
ঢুকে আসছে ।