চক্র - মানুষের প্রথম
আবিষ্কার । আদিকাল থেকে
বর্তমান অব্দি মানুষ
যতটা এগিয়েছে তার মূল
হাতিয়ার ; প্রাচীন থেকে
আধুনিক সব যুগে সে
অপরিহার্য । এমন কি
আমরা প্রগতির প্রতীক
হিসেবেও চক্রকেই বুঝি ।
বুঝি গতির প্রতীক
হিসেবে কারণ
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের
অনেক প্রাকৃতিক এবং
অপ্রাকৃতিক ঘটনাই ঘটে
চক্রাকারে । কাল ও
ভাগ্যের প্রতীকও সেই
চাকা । বহুচর্চিত ‘
হুইল অফ ফরচুন ’ তার
প্রত্যক্ষ প্রমাণ –
গ্রীক নাটক থেকে
ক্যাসিনো - সবখানেই
ভাগ্যের চাকা ক্রমাগত
ঘুরেই চলেছে । সাহিত্যে
প্লট – অবতারণা থেকে
সমাপ্তি - এগোয়
চক্রাকারে । চক্রাকারে
ঘোরে বেশিরভাগ কলকব্জা
। অতএব এ কথা
অনস্বীকার্য যে জীবনের
সর্বত্র চক্রের দাপুটে
উপস্থিতি – জাঁতাকল
থেকে জাতীয় পতাকা । মনে
পড়ে স্বাধীনতার
সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে
এক বিখ্যাত পত্রিকার
প্রচ্ছদের একটি ছবি –
একটি হাতে টানা রিকশার
হাতল ধরে ঝুঁকে পরা এক
কর্মক্লান্ত মানুষের
অবয়ব এবং তার রিকশার
চাকায় তিরঙ্গার
বর্নময়তা । স্বাভাবিক
ভাবেই প্রশ্ন ওঠে তাহলে
কি আমাদের স্বাধীনতা
মানুষের চিরন্তন
নিষ্পেষণের সাক্ষী হয়ে
থাকা আদিকালের চাকার
মধ্যে নিবদ্ধ? এখানে
অঙ্গাঙ্গী হয়ে ওঠে
চক্রের দুটি পৃথক অর্থ -
‘ হুইল ’ এবং ‘ সাইকেল ’।
বিশ্বায়ন ও তার সুফলের
ভাগীদার হয়ে উঠতে না
পারা জনসংখ্যার বৃহদংশ
এখনও যে চক্রে আবদ্ধ
তার অর্থনৈতিক পোশাকি
নাম ‘ ভিশিয়াস সাইকেল
অফ পভার্টি ’ । তিন বা
তার বেশি প্রজন্মের
মানুষ ক্রমাগত
নিষ্পেষিত হতে হতে ভুলে
যায় আগামী প্রজন্মের
কাছে আর্থিক ,
সাংস্কৃতিক , বৌদ্ধিক
উত্তরাধিকার পৌঁছে
দেওয়ার
অঙ্গীকার ।
আপাতদৃষ্টিতে সরকারী
সাহায্যপ্রাপ্ত
কৃষিক্ষেত্র লাল হয়ে
ওঠে দেশের কোনও না কোনও
প্রান্তের কৃষকের
রক্তে ; বন্ধ কারখানার
বিকল কলকব্জায় ঝোলে
শ্রমিকের লাশ।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম
এই চক্রে পিষ্ট হতে
থাকা মানুষ এক সময় ভুলে
যান তাঁদের মৌলিক
অধিকার কি কি , কাকেই বা
বলে স্বাধীনতা ।
শ্রমজীবী ছেড়ে আসা যাক
বুদ্ধিজীবিদের
প্রসঙ্গে । এঁরা সমাজের
সেই অংশ যারা
পূর্ণমাত্রায়
স্বাধীনতার সংজ্ঞা ও
নিজেদের অধিকার
সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ।
কিন্তু তাঁরাও কি
পূর্ণমাত্রায় স্বাধীন ?
নাকি কোনও অদৃশ্য
চক্রের ঘেরাটোপে বন্দী
?
ভারতীয় সংবিধান আমাদের
বাক ও চিন্তার
স্বাধীনতার মৌলিক
অধিকার দেয় তবে তা
শর্তসাপেক্ষে - আঘাত
করা চলবেনা কোনো ধর্মীয়
ভাবাবেগে । তাই সলমন
রুশদি , মকবুল ফিদা
হুসেন এর যাবজ্জীবন
দেশান্তরের শাস্তি
হয়। বারবার খণ্ডিত হয়
শিল্পীর স্বকীয়
ভাবনাচিন্তার অধিকার ।
কিন্তু মৌলবাদী নেতারা
যখন জনমঞ্চে উঠে
হুঙ্কার ছাড়েন যে
হিন্দুস্তান কেবল
হিন্দুদের জন্য বা
কাশ্মীরের বেশিরভাগ
জনগণ ইসলাম
ধর্মাবলম্বী হওয়ার
কারণে সেই প্রদেশের
পাকিস্তানের অংশ হওয়া
উচিৎ তখন তাঁদের কোন
শাস্তি হয়না । তাহলে
বলা যেতেই পারে যে
বাকসংযমের দায়
শুধুমাত্র শিল্পী ও
দার্শনিক সমাজের যাতে
দৃষ্টিভঙ্গির কোনও
বিপ্লব না ঘটতে পারে
কিন্তু ধর্মের নামে
প্ররোচনামূলক কথায়
নিজেদের
স্বার্থসিদ্ধির
ক্ষেত্রে বাকসংযম
বাহুল্য মাত্র ।
আসা যাক
ব্যক্তিস্বাধীনতার
কিছু ক্ষেত্রে।
পোশাকপরিচ্ছদ একটি
চিরকালীন বিতর্কিত
বিষয় । যার সাম্প্রতিক
শিকার চিত্রাভিনেতা
আমীর খান । তাঁর প্রায় -
নগ্ন ছবি নিয়ে উত্তাল
গোটা দেশ । কথা হচ্ছে এ
ঘটনা কিন্তু
বিরল নয় । আমাদের
চারপাশে বহু পুরুষ
প্রায়শই তাঁদের
উর্ধাঙ্গ অনাবৃত করে
জনসমক্ষে আসেন এবং মনে
করেন এ হচ্ছে তাঁদের
লিঙ্গগত এবং জন্মগত
অধিকার । এমনকি কেউ কেউ
তো জনসমক্ষে যৌনাঙ্গ
প্রদর্শন করে
মূত্রবর্জনকেও
অশ্লীলতা বা অপরাধ মনে
করেন না । অথচ এই ধরনের
মানুষেরাই একটি মেয়ে
বোরখা না পরলে তার শরীর
পুড়িয়ে দেন অ্যাসিড
দিয়ে অথবা জিন্স পরার
অপরাধে তাকে
মৃত্যুদণ্ড দিতেও
পিছপা হ’ননা । এর মধ্যে
সাম্প্রতিকতম সংযোজন
গোয়ার এক মন্ত্রীর
ঘোষণা যে গোয়ার কোনও
একটি বিশেষ বীচে বিকিনি
পরা চলতেই পারে তবে তার
জন্য দিতে হবে চার
অঙ্কের প্রবেশমূল্য !
অর্থাৎ নিজের শরীর
উন্মোচন করার অধিকার
তবেই মিলতে পারে যদি তা
হয় অর্থনৈতিকভাবে
লাভবান এবং অন্যের
বিনোদনের যোগ্য ! সেই
সময় বোধহয় উপস্থিত
যেখানে
ব্যাক্তিস্বাধীনতা
নিয়ে একটা নির্দিষ্ট
অবস্থানে আসাটা
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
। যদি কোনারক-খাজুরাহ
আমাদের ঐতিহ্য হয়,
তাহলে সম্মিলিত ভাবে
আমীর খানকে দুয়ো দেওয়ার
কোন জায়গাই নেই । জায়গা
নেই একই সঙ্গে
লুকিয়ে-চুরিয়ে নীল ছবি
অথবা পত্রিকা উপভোগ
করার এবং একটি মেয়ে
ধর্ষিতা হলে তার
পোশাককে দায়ী
করার । ব্যক্তির শরীর
তার নিজস্ব না সমাজের
এই তর্কের আশু মীমাংসার
প্রয়োজন কারণ এই চরম
নির্লজ্জ দ্বিচারিতার
চক্র যে তার থেকেও অশুভ
লিঙ্গবৈষম্যের চক্রকে
প্রাণ - বায়ু যোগায় তা
বোধহয় সন্দেহাতীত ।
লিঙ্গবৈষম্যের
চক্রকে একটু কাছ থেকে
খতিয়ে দেখা যাক ।
ভ্রূণহত্যার বিরুদ্ধে
এত প্রচার সত্ত্বেও
পরিসংখ্যান কিন্তু
বাড়তিরই দিকে । কারণ
ভ্রূণাবস্থা থেকে
মৃত্যু অব্দি প্রতিপদে
একজন মানুষকে সমাজ
দায়িত্ত্ব নিয়ে বোঝায়
যে নারীশরীর একাধারে
কতটা কাঙ্খিত ও
অকাঙ্খিত । নারীদের
জন্য আলাদা রীতিনীতি ;
দৈনন্দিন থেকে সামাজিক
- সব জায়গায় তাদের কাজের
ভাগও আলাদা । একজন
নারীর থেকে সমাজের
চাহিদা হল সে হবে রূপে
লক্ষ্মী , গুণে সরস্বতী ,
রন্ধনে দ্রৌপদী ,
কামকলায় রতি ,
পতিভক্তিতে সীতা এবং
সতীত্বে সাবিত্রী ; যদি
সে ব্যতিক্রম হয় তবে সে
‘ বারমুখী ’ , ‘ মদ্দা
মেয়েমানুষ ’ , ‘
ঘরজ্বালানী ’ এমনকি ‘
নষ্ট চরিত্র মন্দ মেয়ে
’ । জীবনের বিভিন্ন
ক্ষেত্রে নিজেদের বার
বার প্রমাণ করা
সত্ত্বেও ‘ গ্লাস সিলিং
’ এর আওতা মুক্ত হওয়া
যায়না কখনই । এমনকি
সন্তানধারণ ও
প্রতিপালনের
সিদ্ধান্ত অব্দি একজন
নারীর ব্যক্তিগত না,
তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া
সমাজের
দাবী । নারীবাদের
স্লোগান তুলে , মিছিল
করে সম্ভবতঃ এ সমস্যার
সমাধান হওয়ার নয় ,
মানসিক পরিবর্তন
একান্ত প্রয়োজন ।
সহনাগরিকের অধিকার
উল্লঙ্ঘন করে তার ওপর
নিজের মত চাপিয়ে
দেওয়াতে যে পৌরুষের
সার্থকতা নেই এটা
স্বীকার করার সময় হয়েছে
। তেত্রিশ শতাংশ
সংরক্ষণ কেবল ‘
ইক্যুইটি ’ প্রদানেই
সক্ষম , ‘ ইক্যুয়ালিটি ’
নয় । যে দেশে দু’দল
নাগরিক একই ভাবে
স্বাধীনতা ভোগ করতে
পারেন না উপরন্তু
একদলের দাবী ও অধিকার
সমাজের চোখরাঙানিতে
চাপা পড়ে , তার কি সত্যিই
নিজেকে স্বাধীন ও
বৃহত্তম গনতন্ত্র
হিসেবে গর্ব করা সাজে ?
স্বাধীনতার অন্যতম
বৈশিষ্ট্য স্বকীয়তা।
স্বদেশ , স্বরাজ
সম্বন্ধে অবহিত হলেও
স্বকীয়তা শব্দটি
অনেকেরই অপরিচিত । তাই
ব্যর্থ ও সার্থক অনুকরণ
ক্রমান্বয়ে ঘটেই চলে ।
বিবেকানন্দ ‘
পরিব্রাজক ’ গ্রন্থে
নব্য বাবুদের সম্বন্ধে
লিখেছিলেন “ সাধ করে
শিখেছিনু সাহেবানি কত ,
গোরার বুটের তলে সবই
হ’ল হত । ” হাল আমলের
অনুকরণপ্রিয়তা
সম্বন্ধে বলাই যায় যে
সেই ট্র্যাডিশন সমানে
চলছে । আমরা পরি ইংরেজ
বা আমেরিকান
কাপড় , মাখি ফরাসী
সুগন্ধ , ইতালিয় জুতো
পরে , কোরিয়ান ফোন কানে
গুঁজে চাইনিজ খেতে যাই
। তাতে দোষের কিছু ছিল
না যদি রাজ কপুরের
গানের কলির মতো এর
সঙ্গে বলা যেত “ ফির ভি
দিল হ্যায়
হিন্দুস্তানি ” ।
কিন্তু যেসব মানুষ
বিশ্বায়নের এই তথাকথিত
‘ সুফল ’ ও ‘ সুযোগ ’
থেকে বঞ্চিত তাদের
মনুষ্যপদবাচ্য ধরা হবে
না এ কেমন অবিচার ? কেন
ইংরেজ দেশ ছাড়ার ৬৮ বছর
পরেও যোগ্যতার বিচার
হবে ইংরেজি বলতে পারার
দক্ষতা
দিয়ে ? কেন বিলেতফেরত
ছেলেমেয়ের বাবা মায়ের
আচার - আচরণে থাকবে এমন
শ্লাঘা যেন পৃথিবীর
অন্য এক দেশ থেকে নয় ,
তাঁদের সন্তান
চন্দ্রলোক জয় করে এসেছে
? কেন সোচ্চার প্রতিবাদ
হবেনা যখন ভারতে
অবস্থিত কোন ক্লাব একজন
ভারতীয়র
প্রবেশাধিকারে
নিষেধাজ্ঞা জারি করবে
পাশ্চাত্য পোশাক না পরে
এলে ? এমনকি আমাদের
শ্বেতাঙ্গ প্রীতির
সচেতন ও অচেতন নিদর্শন
স্বরূপ বাজার ছেয়ে যাবে
ফেয়ারনেস প্রোডাক্টস
এ। এবং আমরা তারপরেও
নিজেদের ‘ পোস্ট
কলোনিয়াল ’ বলে গলা
ফাটাবো । এসব ঘটনা থেকে
একটা প্রশ্ন উঠে আসা
অনিবার্য – তবে কি ১৯৪৭
এর আগে আমরা শুধুমাত্র
ইংরেজদের দাস ছিলাম ;
বিশ্বায়নের পরে সব
রাষ্ট্রের দাস ? ‘
বসুধৈব কুটুম্বকম ’
নিঃসন্দেহে অত্যন্ত
মহৎ ভাবনা , কিন্তু চলনে
ও সর্বোপরি মননে
স্বকীয়তা বা বৃহদার্থে
স্বাধীনতা হারালে ,
তাকে সঠিক অর্থে
উপলব্ধি করা অসম্ভব ।
অতএব এ কথা বলাই যায় এ
দেশে স্বাধীনতা
একপ্রকারের ভ্রান্তি
মাত্র । যে জাতি কলুর
বলদের মতো বিভিন্ন
চক্রে আবদ্ধ তাদের কাছে
ক্রমাগত ঘুরে চলাটাই
উন্নতির ভ্রম সৃষ্টি
করে । যখন এটা উপলব্ধি
করাও হয় যে এই
স্বাধীনতা এক ছদ্ম
স্বাধীনতা তখনও আমরা এর
মাদকে আচ্ছন্ন থাকি - সে
মাদক কখনো রুমালে ঘসা
ডেন্ড্রাইট , কখনো
শিভাস রিগাল । সে
মাদকতা স্বাধীনতার
নামে স্বেচ্ছাচারের –
যাতে ব্যক্তি বা সমাজের
প্রকৃত উন্নতিসাধন
সম্ভব নয় কখনওই । এক
ক্ষয়িষ্ণু যুগের বিনাশ
আনতে কৃষ্ণ
কুরুক্ষেত্রের
যুদ্ধের আয়োজন
করেছিলেন অথচ নিজে
সুদর্শন - চক্র ধারণ
করবেন না বলেছিলেন ।
কিন্তু প্রবল পরাক্রমী
ভীষ্মের মোকাবিলা করতে
যখন বাকিরা হতোদ্যম তখন
উন্নতির ধারা অব্যাহত
রাখার জন্য আয়োজিত এই
মহারণকে পরিপূণর্তা
দিতে তিনি এক রথের ভাঙা
চাকা নিয়ে ভীষ্মের
প্রতিদ্বন্দিতা করতে
উদ্যত হ’ন । চক্রের
সার্থকতা তাই
নিঃসন্দেহে উন্নতির
জন্য । কিন্ত বর্তমান
পরিস্থিতিতে জাতীয়
পতাকা স্থিত অশোক চক্র
কি সত্যিই জাতীয়
উন্নতির প্রতীক হয়ে
উঠবে ? প্রশ্নটা কিন্তু
থেকেই যায়।