নভেম্বর ২২, ১৮৯৪ ।
ব্রিটেনের ঠান্ডাকে
হার মানাতে ফায়ার
প্লেসের আগুনটাকে
খানিকটা উস্কে দিয়ে
পিটার টেট বসলেন চিঠিটা
লিখতে – কোনো এক
আহাম্মক পেরি’র
উদ্দেশে । লোকটার
স্পর্ধা আকাশ ছুঁয়েছে !
তার গুরু প্রবাদপ্রতিম
লর্ড কেলভিন যখন বলেছেন
, পৃথিবীর বয়স মেরেকেটে
দশ কোটি বছর , তখন এই
অজ্ঞাত কুলশীল পেরি
তাতে সন্দেহ প্রকাশ
করেই শুধু থেমে থাকেনি ,
সে বিষয়ে প্রখ্যাত
নেচার পত্রিকায়
ছাপাবার চেষ্টাও নাকি
করছে !
জন পেরি , পেশায়
ইঞ্জিনিয়ার, লর্ড
কেলভিনের প্রাক্তন
ছাত্র । খট্কাটা পেরির
সেদিনই লেগেছিল , যেদিন
চৌষট্টিতম British Association For The
Advancement of Science – র সভায়
রবার্ট শেশিল তাঁর
সদর্প বক্তৃতায়
মহামান্য লর্ড
কেলভিনের গণনাকে
সিলমোহর লাগিয়ে Evolution by
Natural Selection-র তত্ত্বকে নাকচ
করেছিলেন । কাজে লেগে
পড়লেন পেরি । সংগ্রহ
করলেন নানাবিধ
ভূতাত্ত্বিক তথ্য ।
লর্ড কেলভিনের পুরো
পেপারটা আপাদমস্তক পড়ে
ফেললেন বার কয়েক । চোখে
পড়ল বেশ কিছু ত্রুটি।
সেগুলোকেই চিঠির আকারে
সযত্নে লিখে অন্যান্য
বিজ্ঞানীদের সাথে লর্ড
কেলভিনকেও পাঠালেন এক
কপি । কিন্তু সে চিঠির
কোনো জবাব আসেনা । শেষে
পেরি লর্ড কেলভিনকে
পাকড়াও করলেন মুখোমুখি
, ট্রিনিটি কলেজের
ডিনারে । কিন্তু
পাত্তাই দিলেননা
কেলভিন । যদিও
ত্রুটিগুলো যথার্থ ,
কিন্তু তিনি লর্ড
কেলভিন , সব ত্রুটির
উপরে তার অধিষ্ঠান !
তিনি যা বলবেন – তাই
বেদবাক্য !
১৮৬২ সাল ।
তাপগতিবিদ্যার আকাশে
এক উদীয়মান সূর্য –
উইলিয়াম থমসন । দীর্ঘ
কয়েক বছরের চেষ্টায়
তিনি খুঁজে পেয়েছেন
পৃথিবীর বয়স ।
সম্ভাবনাটা তিনি অনেক
দিন আগেই খুঁজে
পেয়েছিলেন – ফরাসী
বিজ্ঞানী ফ্যুরিয়ারের
তাপ পরিবহন সংক্রান্ত
ব্যাখ্যায় । ততদিনে
ভূবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন
খনিতে ঘুরে ঘুরে
দেখেছেন যে পৃথিবীর
তাপমাত্রা যত গভীরে
যাওয়া যায় , ততই বাড়ে ।
থমসনের যুক্তি ছিল সহজ
– পৃথিবী শুরুতে উষ্ণ
ছিল । তার পৃষ্ঠ ক্রমশ
ঠাণ্ডা হয়েছে । কিন্তু
অভ্যন্তর উষ্ণই আছে ।
ফলে যদি জানা যায় যে
ভূপৃষ্ঠের এই ঠাণ্ডা
হতে কত সময় লেগেছে ,
তাহলেই জানা যাবে
পৃথিবীর বয়স । কিন্তু
তার জন্য তাকে জানতে
হবে তিনটি বিষয় – ( ১ )
প্রাথমিকভাবে পৃথিবীর
অভ্যন্তরের তাপমাত্রা
কত ছিল , ( ২ )গভীরতার সাথে
পৃথিবীর অভ্যন্তরে
তাপমাত্রা কি হারে বাড়ে
এবং ( ৩ ) ভূমণ্ডলের তাপ
পরিবহন ক্ষমতা । এর
মধ্যে শেষের দুটির
ক্ষেত্রে তাঁর সেরকম
কোনো সমস্যা হল না ।
বন্ধু ফোর্বসকে নিয়ে
নানা পরীক্ষা করে
দেখলেন গড়ে পৃথিবীর
তাপমাত্রা ভূপৃষ্ট
থেকে প্রতি পঞ্চাশ ফুট
গভীরে গেলে মোটামুটি ১
ডিগ্রী ফারেনহাইট বাড়ে
। বিভিন্ন রকমের বালি
এবং পাথরের তাপ পরিবহন
ক্ষমতা মাপার পর সেটার
গড় নিয়ে সামগ্রিকভাবে
পৃথিবীর তাপ পরিবহন
ক্ষমতারও একটা মাপ
পেলেন তিনি । ফাঁপরে
পড়লেন প্রথম বিষয়টাকে
নিয়ে । কিন্তু তিনি
উইলিয়াম থমসন ,
উত্তরকালে যাঁকে সারা
পৃথিবী লর্ড কেলভিন
নামে চিনবে ! তাঁর
দূরদর্শিতা যে
অন্যন্যসাধারণ হবে
তাতো বলাই বাহুল্য ।
যদিও তাঁর চিন্তায়
তৎকালীন পৃথিবী
গোলাকার কঠিন , কিন্তু
প্রথমে তা অবশ্যই তরল
ছিল । অর্থাৎ পৃথিবীর
অভ্যন্তরের প্রাথমিক
তাপমাত্রা নিশ্চয়ই
বিভিন্ন শিলা , পাথর
ইত্যাদির গলনাংকের
কাছাকাছি হবে । বিভিন্ন
পরীক্ষা - নিরীক্ষার
পরে তিনি ধরে নিলেন সেই
তাপমাত্রাটি সাত হাজার
ফারেনহাইটের কাছাকাছি
হওয়ার কথা । এবার তো সহজ
গাণিতিক হিসেব ।
পৃথিবীর বয়স দাঁড়ালো –
দশ কোটি বছর !
আপাত দৃষ্টিতে যে
সমস্যার সমাধান ছিল
অসম্ভব , তারই সমাধান
করে দিলেন থমসন ।
চারিদিকে শোরগোল পড়ে
গেল । কিছু বিজ্ঞানী
পক্ষে মত দিলেন, কিছু
বিপক্ষে। তর্কটা জমে
উঠল। থমসন সাহেব কিন্তু
যা কিছু বিপক্ষ মতামত ,
সব তুড়ি মেরে উড়িয়ে
দিতে চাইলেন । এত কঠিন
এক সমস্যার এত
যুক্তিগ্রাহ্য ,
বিজ্ঞানসম্মত সমাধান –
তাকে কিছুতেই হারতে
দেবেন না তিনি ।
তাই বলে থমসনের চোখে
যারা ছিদ্রান্বেষী
ছারপোকার দল , তারা তো আর
হাত গুটিয়ে বসে থাকবেনা
। জন পেরি সেই দলেরই
একজন । তিনি দেখলেন ,
প্রথমত , তদনীন্তন লর্ড
কেলভিন , পুরোনো দিনের
থমসন সাহেব ,
পৃথিবীটাকে সমসত্ত্ব
গোলাকার বস্তু হিসাবে
ধরেছেন এবং তার
সামগ্রিক তাপ পরিবহন
ক্ষমতাকে সর্বত্রই
সমান বলে ধরে নিয়েছেন ।
দ্বিতীয়ত , তিনি তাঁর
বিশ্লেষণে কোনো প্রকার
তাপ পরিচালন পদ্ধতির
সম্ভাবনার কথা বিচার
করেননি । ফলে
সামগ্রিকভাবে
সমস্যাটির অতি সরলীকরণ
হয়েছে । তাছাড়া পেরির
কেবলই মনে হতে লাগল, যদি
পৃথিবীর অভ্যন্তরে
অন্য কোনো তাপের উৎস
থাকে , তাহলে সেই তাপও
নির্ঘাৎ পৃথিবীর
কেন্দ্র থেকে
বহির্মুখী প্রবাহিত
হবে । সেক্ষেত্রে থমসন
যে সময়ে পৃথিবী পৃষ্ঠ
ঠান্ডা হবে বলে হিসেব
করেছেন , তার থেকে অনেক
বেশি সময় লাগার কথা । কে
জানত , তার এই মনে হওয়ার
বাস্তবে পরিণত হতে আর
ক’দিন বাকি !
১৮৯৬ সালের ফরাসি বসন্ত
। আধুনিক
পদার্থবিদ্যার ভগীরথ
তাঁর ল্যাবে নিমগ্ন
আকস্মিক আশ্চর্য এক
আবিষ্কারকে বিশ্ব
বিজ্ঞানের সমতল ভূমিতে
নিয়ে আসার জন্যে । এ এক
আশ্চর্য প্রাকৃতিক
ঘটনা – এক মৌলের পরমাণু
নিজে নিজেই পরিণত হচ্ছে
অন্য মৌলের পরমাণুতে,
সেইসঙ্গে নিঃসৃত হচ্ছে
অবিরাম এক বিকিরণ ।
তেজষ্ক্রিয়তার সন্ধান
পেয়েছেন হেনরী বেকারেল
।
নড়েচড়ে বসল সমগ্র
বিশ্বের বিজ্ঞানীকুল ।
চলল বিস্তর পরীক্ষা
-নিরীক্ষা। সাত বছরের
মধ্যেই পিয়ের কুরী এবং
আলবার্ট ল্যাবোর্ডে
প্রমাণ করে ফেললেন –
রেডিয়াম লবণ
তেজষ্ক্রিয় বিকিরণের
মাধ্যমে ক্ষয়প্রাপ্ত
হয়ে উৎপন্ন করে
অজ্ঞাতপূর্ব তাপরাশি ।
চালর্স ডারউইনের পঞ্চম
পুত্র জর্জ ডারউইন ,
পদার্থবিদ । অনেকদিন
ধরেই তিনি চেষ্টা
চালাচ্ছিলেন কেলভিনের
দাবিকে ভুল প্রমাণ করার
। কারণটাও সহজবোধ্য ।
নইলে তাঁর বাবার
বিবর্তনবাদের তত্ত্ব
প্রতিষ্টিত হয় না ।
তিনি এবং আরও কিছু
বিজ্ঞানীর দল মিলিত
ভাবে এই নতুন
আবিষ্কারকে সামনে রেখে
বলতে শুরু করলেন ,
তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ
পৃথিবীর অভ্যন্তরে
একটি বড় শক্তির উৎস হতে
পারে যা কেলভিন তাঁর
বিশ্লেষণে ধরেননি ।
অর্থাৎ যা পেরি বলছিলেন
সেই পালে আরো হাওয়া
লাগল । কিন্তু কেলভিনের
বহুকষ্টে বহুযত্নে
লালিত তত্ত্বে কামারের
ঘা বসালেন রাদারফোর্ড
।
আর্নেষ্ট রাদারফোর্ড ,
আধুনিক নিউক্লিয়ার
ফিজিক্সের জনক । একদিন
ক্যাম্পাসে একাই
হাঁটছিলেন , হাতে কালো
মতন একটা পাথরের টুকরো
। হঠাৎ দেখা সহকর্মী
বন্ধু অ্যাডামসের সাথে
। ভূবিজ্ঞানী
বন্ধুটিকে দেখেই তিনি
প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন , ‘
পৃথিবীর বয়স কত বলে মনে
হয় তোমার ? ’ আমতা আমতা
করে অ্যাডামস্ নানা
রকম পদ্ধতির উল্লেখ করে
বললেন সেই দশ কোটি
বছরের কথা । রাদারফোর্ড
হাতের পাথরের টুকরোটি
দেখিয়ে বললেন , ‘ আমি
নিশ্চিত এই
পিচব্লেন্ডের
টুকরোটির ( তেজষ্ক্রিয়
ইউরেনিয়াম মৌলের আকরিক
)বয়স সাত কোটি বছর ! ’
পরবর্তীকালে
রেডিওমেট্রিক ডেটিং
তেজষ্ক্রিয় মৌলের
বিভাজন লক্ষ করে বলে
দিতে পেরেছে পৃথিবীর
বয়স চারশো পঞ্চাশ কোটি
বছর । রাদারফোর্ডই এই
পদ্ধতির প্রবক্তা ।
তেজষ্ক্রিয়তা
আবিষ্কারের পর কেলভিন
প্রথমে সেই নতুন বিষয়ে
আগ্রহ দেখান । যদিও
তিনি প্রথমে বিশ্বাস
করতে চাননি যে
তেজষ্ক্রিয় মৌলের
পরমাণুর ভিতর থেকে কোনো
প্রকার শক্তি নির্গত
হতে পারে । তাই
রাদারফোর্ড যখন বললেন
তেজষ্ক্রিয় মৌলের
পরমাণুতে অকল্পনীয়
পরিমাণে সুপ্ত শক্তি
সঞ্চিত আছে , তখন
কেলভিনের পক্ষে তার
বিরোধিতা করাই
স্বাভাবিক ।
রাদারফোর্ডের
স্মৃতিতে পরবর্তীকালে
ধরা পড়ে ১৯০৪ সালে
রয়্যাল ইনস্টিটিউশানে
তাঁর লেকচার দেবার
দিনটির কথা । যখন তিনি
বলেন , লর্ড কেলভিন তাঁর
তত্ত্বে নতুন কোনো
শক্তির উৎস না ধরে
পৃথিবীর বয়সকে
অনেকাংশেই সীমাবদ্ধ
করে ফেলেছেন ,
শ্রোতাদের মধ্যে থেকে
দু-জোড়া গন্গনে চোখ
তখন তাঁকে বিদ্ধ করছিল
।
বিজ্ঞান যখন ভাবতে শুরু
করে সে তার অভীষ্ট
লক্ষ্যে পৌঁছে গেছে,
তার আর নতুন করে ভাববার
কোনো প্রয়োজন নেই ,
বৈজ্ঞানিক
ব্লান্ডারের সূত্রপাত
সেখান থেকেই হয়।
উইলিয়াম থমসন ওরফে লর্ড
কেলভিন তাঁর প্রাথমিক
প্রচেষ্টাতে কোনো ভুল
করেননি । তিনিই ছিলেন
এই প্রায় অসম্ভব
ধাঁধাঁটির প্রথম
সমাধানকারী ।
তেজষ্ক্রিয়তার মতো
অনাবিষ্কৃত একটি
বিষয়কে তাঁর পদ্ধতির
অন্তর্গত করার সুযোগ সে
সময় ছিলনা । লভ্য
তথ্যকেই তিনি যতটা
সম্ভব কাজে
লাগিয়েছিলেন । কিন্তু
আরেকটু বিচক্ষণতা
বিজ্ঞান তাঁর মতো
প্রতিভার থেকে দাবি
করতেই পারত । সর্বোপরি
তাঁর ভুল ছিল অহমিকা ,
নিজের তত্ত্বের প্রতি
রক্ষনশীলতা । তিনি কোনো
যুক্তি , নতুন
আবিষ্কারকে অকুন্ঠ
চিত্তে স্বাগত জানিয়ে
নিজের আবিষ্কার বা
ধ্যান - ধারণাকে
আতসকাঁচের তলায় আনতে
চাননি । কাকতালীয়
ব্যাপারই বলা চলে - ১৯০৭
সালে মৃত্যুর পর লর্ড
কেলভিনের স্থান হয়
লন্ডনের ওয়েষ্ট
মিনস্টার আবেতে
আইজ্যাক নিউটনের
সমাধির পাশে । এতে যেন
পুরাতন নিউটোনিয়ান
ক্লাসিকাল ফিজিক্সের
একটি অধ্যায়ের বৃত্ত
সম্পূর্ণ হল , যেখানে
প্রথম ও শেষ পথিকৃৎ
পাশাপাশি কবরে শুয়ে
প্রত্যক্ষ করবেন
পদার্থবিজ্ঞানের এক
নতুন অধ্যায় –
কোয়ান্টাম ফিজিক্সের
অশ্বমেধের ঘোড়া !