প্রথম দৃশ্য
রাত নটা। এখন প্রতিটি
টেলিভিশনের একটি বিশেষ
চ্যানেলে আজকের সেরা
খবর গুলো পড়া চলছে। এই
খবর শোনবার জন্য বিজন
বাবু অপেক্ষা করে
থাকেন। যদিও টিভিতে
শুধু শোনা হয়না। দেখা ও
শোনার কাজ একই সাথে হয়
মানে অডিওভিস্যুয়াল
রাউন্ড আরকি।
"দাদাগিরি"তে এই
অডিওভিস্যুয়াল
রাউন্ডটি দেখতে বিজন
বাবু খুব পছন্দ করেন।
ইচ্ছে থাকলেও তিনি আর
কোনোদিনই কুইজ জাতীয়
প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ
করতে পারবেন না। শরীর
দেবেনা। শেষবারের
হার্ট অ্যাটাক তার একটা
পাশ অকেজো করে চলে
গেছে। যদিও সৌভাগ্যবশত
মুখটা ঠিক আছে। কথা
বলার ক্ষমতাটা কেড়ে
নেয়নি। সত্তর বছর বয়সটা
এইযুগে এমন কিছু বয়স
নয়। কিন্তু প্রকৃতি
তাকে সঙ্গ দিতে নারাজ ।
খবর পড়ে যে মেয়েটা ,
এককথায় অপূর্ব
সুন্দরী। কন্ঠস্বরও
মায়াময়। তার মুখে খবর
শোনার আলাদা আগ্রহ আছে
বলেই বিজন বাবু
প্রতিদিন এই সময়টির
জন্য অপেক্ষা করে
থাকেন। খবর পড়া প্রতিটি
মেয়েই সুন্দর দেখতে হয়।
এটা একটা স্ট্র্যাটেজী
, যাতে বিজন বাবুর মত
দর্শক খবর দেখতে আগ্রহী
হয়। সত্যি কি 'দিনকাল'
পড়লো!
দ্বিতীয় দৃশ্য
অফিস থেকে বেরোতে
বেরোতে ১০টা বাজলো।
কলকাতায় এটা কোনো রাত
নয় বটে , তবে এখন বাস
ট্রাম কমে আসে। নিউজ
চ্যানেলের গাড়িটা
প্রতিদিনই সুমনাকে
ড্রপ করতে যায়। কিন্তু
আজ একজন নতুন ড্রাইভার
কাজে জয়েন্ট করেছে। তার
সাথে এখনো আলাপ জমেনি।
তাই এত রাতে তার সাথে
গাড়িতে করে যেতে একদমই
কমফোর্ট ফিল করবেনা
সুমনা। একটা ওলা
রিজার্ভ করে নিয়েছে সে।
এই গাড়িগুলো বেশ।
গড়িয়ায় পদ্মশ্রী
সিনেমাহলের কাছে তার
ফ্ল্যাট। পিছনে
কিছুদূর গেলে কবীর
সুমনের বাড়ি। মাঝে মাঝে
উনি ভোরের দিকে রেওয়াজ
করেন। সুমনা শোনে। খুব
মন দিয়েই শোনে।ভোরে
চারিদিকের হল্লা কম
থাকে বলেই শোনা যায়।
গান তার কাছে একটা
আলাদা জগৎ। খুব ইচ্ছে
ছিল গান নিয়ে কিছু
করার। কিন্তু ...
ওলার ড্রাইভার চিৎকার
করে বললো ,' ম্যাডাম এসে
গেছে আপনার বাড়ি'। এই
কথাটা এতো চিৎকার করে
বলার মত কিছু না।
কিন্তু ড্রাইভার এমন
করলো কেন? মনে মনে বেশ
বিরক্ত হয়ে গাড়ি থেকে
নেমে ভাড়া মিটিয়ে সুমনা
তাদের
অ্যাপার্টমেন্টের
দিকে এগিয়ে গেল।
তৃতীয় দৃশ্য
বেশ খানিক্ষণ ধরে কলিং
বেল বাজছে। রকেট কোথায়
গেছে ? সৈকত ফিরেছে
নিশ্চয়ই। বিজন বাবুর
পক্ষে সিড়ি ভেঙে
হুইলচেয়ার নিয়ে নামা
অসম্ভব।
- রকেট ! অ্যাই রকেট ।
দাদাবাবু ফিরেছে। দরজা
খোল। কোথায় গেলি?
আরোও কিছুক্ষণ পর রকেট
দরজা খুললো। মাঝে মাঝেই
এমন হয়। সন্ধ্যার দিকে
রকেট যে
রিক্সাওয়ালাদের সাথে
বসে গাঁজা টানে সে খবর
বিজন বাবু জানেন।
কিন্তু কিছু বলা যায়না।
আজকালকার চাকরবাকর কে
কিছু বল্লেই কাজ ছেড়ে
দেওয়ার হুমকি দেয়। এই
ভয়ঙ্কর ব্ল্যাকমেলের
কাছে আর কিছু ধোপে
টেকেনা। রকেট চলে গেলে
এই বাজারে আর একজন
সারাদিনের কাজের লোক
পাওয়া চাপের। কাজের
লোকেদের নাম সচরাচর
রকেট হয়না। ওটা ইয়ং
ছেলেপুলেদের থাকে।
কিন্তু পঞ্চাশ বছর বয়সী
কোনো কাজের লোকের নাম
রকেট এটা বেশ আনকমন।
সৈকত ঢুকেই বিজন বাবুকে
জিজ্ঞাসা করলো, "বহ্নি
ফেরেনি?"
- না । সত্যিই বৌমার যে
কবে একটু হুঁশ হবে! এত
রাত হল ... এখন দিনকাল
ভালোনা। কখন কি . . .
- আহ! বাবা। চুপ করোতো।
সবসময় নেগেটিভ কথা।
তোমার সাথে তো কথা বলাই
যায়না। অসহ্য!
বলে গটগট করে সৈকত
নিজের ঘরে ঢুকে গেলো।
আজ রমা থাকলে কি এসব কথা
শুনতে হতো! কেন রমা তার
আগে চলে গেল? যারা
সারাজীবন ঈশ্বরের
চিন্তায় কাটান তাদের
মনে হয় ওপরওয়ালা বেশি
ভালোবাসেন। আগেই ডেকে
নেন। চরম ঈশ্বর বিরোধী
প্রাক্তন কমরেড বিজন
বাবুকে ঈশ্বর
ভালোবাসেনা।
চতুর্থ দৃশ্য
সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে।
নিচের রাস্তায় এখন
ট্রাক চলাচল শুরু
হয়েছে। সারারাত
কোলকাতার রাস্তা
ট্রাকওয়ালাদের দখলে
থাকে । ছাদের ডানপাশটা
নির্জন। পাশে একটা বাড়ি
আর তার আশেপাশে জঙ্গল ,
গাছগাছালি। এখনো
কোলকাতায় যে সামান্য
জঙ্গল রয়ে গেছে এটি তার
মধ্যে অন্যতম। গোটা
ছাদে এই রাত এগারোটায়
একা একা ঘোরার একটা
আলাদা মজা আছে।
ট্যাঙ্কি গুলোর পাশে
একটা কোণ মত জায়গা।
সেখানে একগাদা মদের
বোতল। ফ্ল্যাটের
লোকেরা খেয়ে দেয়ে এখানে
ফেলে রাখে। অন্ধকার
বলে এখন দেখা যাচ্ছেনা
যদিও , কিন্তু আরোও একটু
খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যেত
সেখানে বেশ কয়েকটা
সিগারেটের মুথাও পড়ে
আছে। মদের সাথে
সিগারেটের একটা
আত্মীয়তা আছে নির্ঘাত।
সে ছাদের কার্নিশের
একদম ধারে দাঁড়িয়ে
নিচের পৃথিবী দেখছে।
আকাশে একটা পূর্নিমা।
আজ অনেকদিন পর চাঁদ
দেখছে সে। চাঁদের আলো
শরীরে লাগাতে ছোটোবেলা
তার খুব ভালো লাগতো।
বীরভূমের একটা গ্রামে
তার মামাবাড়ি।
সন্ধ্যার উঠোনে
ইজিচেয়ার পেতে বসা হত।
আকাশের তারা চিনিয়ে
দিতেন বাবা। ইজিচেয়ারে
শুয়ে আলোকোজ্জ্বল
অন্ধকার আকাশে তাকিয়ে
তাকিয়ে বাবা একটার পর
একটা সিগারেট খেতেন। সে
পাশে বসে থাকতো মোড়ায়।
মাঝে মাঝে দিদিমা মাসি
আর মা তেলেভাজা - চা এনে
দিতো। তেলেভাজা খেতে
বাবা কি ভালোই না
বাসতো। কত বিষয়ে যে
গল্প বলতে জানতেন বাবা।
তারপর ভারী গলায়
রবীন্দ্রসংগীত। বাবার
আকাশী রঙের পাঞ্জাবীতে
জোনাকি এসে বসতো।
পূর্নিমার চাঁদ গায়ে
লাগলে এখনো তার খুব
বাবার কথা মনে পড়ে।
গানের কথা মনে পড়ে। গান
এবার গাইতে পারবে সে।
গানের সুর আসতে আসতে
নামছে। নিচের পৃথিবীতে
নামছে। আগুনের পড়শমনি
এবার সে প্রানে ছোঁয়াতে
পারবে। একটা উজ্জ্বল
জ্যোতিষ্কের মত ব্যাথা
জেগে উঠছে সারা শরীর
জুড়ে উর্দ্ধপানে।
রাত সোয়া এগারোটাতে
কলকাতায় একটা উল্কাপাত
হলো।
পঞ্চম দৃশ্য
মনটা খুব খারাপ বিজন
বাবুর। সকাল বেলা বৌমা
আর সৈকত ঝগড়া করে অফিসে
গেছে। তাঁর মনে হচ্ছিল ,
এর জন্য হয়তো তিনিই
দায়ী। ওহ্ রমা! বৌমার
নাম সত্যিই 'বহ্নি' ,
স্বার্থক নাম। নামের
সাথে ব্যবহারের কোনো
পার্থক্য নেই। তার
সমুদ্রের মত বিরাট মনের
ছেলে সৈকত কেমন দিনকে
দিন খিটখিটে হয়ে উঠছে।
নাকি তিনিই বয়সের কারনে
খিটখিটে হয়ে উঠছেন! তাই
অন্যদের এরকম মনে
হচ্ছে! কিন্তু সৈকত তো
তার ছেলে। নিজের রক্ত।
সে এমন পাল্টে যাচ্ছে
কেন?
রকেট প্রতিদিন গাঁজা
টানে। কিসের সন্ধানে?
সে কিন্তু কোনো সময় রাগ
করেনা। শত বকাবকি
করলেও। তার মানে গাঁজা
খেলে কি রাগ কমে যায়?
মেজাজ ভালো থাকে? রকেট
কে কি বলবে যে তার জন্য
এক ছিলিম ও বস্তু নিয়ে
আসতে? নাহয় দুজন মিলেই
টানা যাবে! সন্ধ্যায় তো
বাড়িতে কেউ থাকেনা।
কিন্তু প্রাক্তন
সিপিএম নেতা শেষ
পর্যন্ত বাড়ির চাকরের
সাথে বসে গাঁজা টানবে?
রমা কি ভাববে? উহুঁ ,
আবার বাজে শব্দ ব্যবহার
করলেন তিনি। চাকর
শ্রেনী আলাদা? এই তার
মার্কসীয় দর্শন! মন
দোলাচলে দুলতে দুলতে
তার হঠাৎ মনে পড়লো যে
তিনি অর্ধেক
প্যারালাইজড। এসব কি
উল্টোপাল্টা ভাবছেন
তিনি!
- রকেট আমার ওষুধ নিয়ে
আয়।
ষষ্ঠ দৃশ্য
রাত নটা। এখন প্রতিটি
টেলিভিশনের একটি বিশেষ
চ্যানেলে আজকের সেরা
খবর গুলো পড়া চলছে। খবর
পাঠিকা সুমনা তরফদারকে
দেখলেই সারাদিনের
সমস্ত মন খারাপ বিজন
বাবুর চলে যায়। মেয়েটার
সৌন্দর্য তাঁর
কলেজজীবনের কথা মনে
পড়ায়। রমার সেই তরুণী
চেহারার সাথে কি
আশ্চর্য মিল সুমনার!
এইজন্যই তো বসে থাকা।
কিন্তু আজ মেয়েটাকে
দেখাচ্ছেনা কেন? তার
জায়গায় অন্য একজন মেয়ে
খবর পড়ছে। হঠাৎ এই নতুন
মেয়েটি পড়তে পড়তে বলে
উঠলো ," ফিরছি একটা
কমার্সিয়াল ব্রেকের পর
, সঙ্গে থাকুন , আপনাদের
সাথে আমি রমা , খবর
দিনকাল।"
কি আশ্চর্য! রমার মত
দেখতে মেয়েটি আজ নেই ,
অথচ 'রমা' নামটা আছে।
বিজন বাবুর মনে হল রমা
তাকে সত্যিই কতটা
ভালোবাসে। এখনো তাঁর
সাথে দিনে অন্তত একবার
হলেও কোনো না কোনোভাবে
দেখা করে যান। আগের
মেয়েটির কি হল সেটা
জানার আর আগ্রহ থাকলো
না বিজন বাবুর। তার মন
ভালো হয়ে গেছে।
কাট্
আখ্যানটি এখানে শেষ করে
দেওয়া যেতো। কিন্তু এই
দুঃসহ সময়ে দাঁড়িয়ে
আমাদের মনের দহন কার
কিভাবে কোন
পরিস্থিতিতে মেটে তা
জানা বড়ই দুরূহ ব্যপার।
প্রতিনিয়ত পৃথিবী জটিল
হচ্ছে , আর তার সাথে
পাল্লা রেখে মানুষের
মস্তিষ্ক। আসলে
মস্তিষ্কের জন্যই হয়তো
পৃথিবী জটিল হচ্ছে। যার
যেমন পার্স্পেক্টিভ
ভিউ। নয়তো সুমনার
সুইসাইডের কোনো কারন
পাওয়া যেত। তার ঘরে
ভ্যানিটিব্যাগের
মধ্যে একটা সুইসাইড নোট
পাওয়া যায় যাতে লেখা
ছিল "আমার মগজই আমার
সবচেয়ে বড় শত্রু" , কোন
পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে
সে এমন একটা ভয়ঙ্কর কথা
বলে দিল তা আর জানা
যাবেনা। বিজন বাবুই বা
সুখের কিভাবে সন্ধান
করেন তা এই ঘটনায়
পরিস্ফুট নয়। এইসব
মানুষেরা সবাই জটিল হয়ে
যাচ্ছে। এই 'সময়' আমাদের
কোন জায়গায় নিয়ে যেতে
চায়?
রিসেন্টলি কিছুদিন আগে
তামিল কোনো এক সংবাদ
পাঠিকার মৃত্যুর খবর
আমাকে নাড়া দিয়ে গেছে।
বিশেষত ঐ সুইসাইড নোট।
কি অসম্ভব সত্যি কথা
উনি লিখে গেছেন। এই
ঘটনার উপর ভিত্তি করে
এই কাঁচা সিনেমাটা
বানানো গেল। হ্যাঁ এটা
কাঁচাই। আমাকে একটা
কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে তোলার
কষ্ট দিচ্ছে আমার
পারিপার্শিক এবং এই
সময়।
কৃতজ্ঞতাঃ সুইসাইডের
ঘটনাটি আমায় আড্ডার ছলে
বলেছিলেন যে সাংবাদিক ,
অর্জুন
বন্দ্যোপাধ্যায়।