ষোড়শ শতক । নদীয়া ভেসে
গেল বুঝি বা ! না , গাঙে
বান আসে নি ।
প্রেম এসেছে ,
মহাসমারোহে । সে কি
দৃশ্য ! একই দাওয়ায় বসে
আদ্বিজচণ্ডাল
অন্নগ্রহণে রত ।
ডাকাতের সর্দার
উদ্বাহু সংকীর্তন করছে
, গালে ঝরে পড়ছে
ভাললাগার শুদ্ধতোয়া ।
রথ টানছে ধনিক , তার
পেছনেই মুচির ছেলের
পেশি ফুলে উঠছে । সকাল
সন্ধ্যা শুধু নামগান ,
শুধু লীলাকীর্তন ।
আনন্দ , আনন্দ , আনন্দ ।
দূরে নেচে চলেছে
সুকুমার মানুষটি ,
শিশুর মত মুখে । মস্ত বড়
পণ্ডিত , ডাকাবুকো ছেলে
... মায়ের কোল আঁধার করে ,
যুবতী বউ কাঁদিয়ে
সন্ন্যাসী হয়েছে সে ।
তারই ডাকে সবাই মিলেছে
। হিন্দু ব্রাহ্মণদের
চোদ্দরকম ঘটাপটা নেই ,
মুসলমানদের জাত বদলের
হাতছানি নেই , বৌদ্ধদের
আলোআঁধারি রকমারি
মন্ত্রতন্ত্র নেই –
একেবারে সহজ ব্যাপার ।
শুধু কৃষ্ণ বল , সঙ্গে চল
। কেউ উঁচু নয় , কেউ নিচু
নয় । সবাই এক । সবার জন্য
এক নিয়ম , এক আচার , এক
সমাজ । সবার জন্য সবাই ।
কে বাছবিচার করছে ? ওকে
বাদ
দাও ... ওর মন নেই । কে
দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে ?
ডেকে নাও , ওরই আছে ।
“ নীচ জাতি হৈলে নহে
ভজনে অযোগ্য ।
সংকুল বিপ্র নহে ভজনের
যোগ্য ।।
যেই ভজে সেই বড় অভক্ত
হীন ছাড় ।
কৃষ্ণ ভজনে নাহি
জাতিকুলাদি বিচার ।। ”
এই যে কৃষ্ণ , যাকে ওই
মানুষটি তুলে আনছেন
সচলতার উপায় হিসাবে ...
তিনি কোনও হিন্দু দেবতা
নন । তিনি ভাগবতের
কৃষ্ণ নামে বটে, আচারে
নন । তিনি বংশী বাজান ।
প্রেমে মাতেন রাধার
সঙ্গে , অনুষঙ্গ হয়ে
গোপিনীরা নাচতে থাকে ।
তিনি মূর্ত প্রেম , যাকে
সুফি খোঁজে ইবাদত – এ ,
সাধু খোঁজে সাধনায় ,
গৃহী খোঁজে গার্হস্থে
আর ঘরছাড়া খোঁজে
সর্বত্র । তিনি ভারতের
সর্বকালের সেরা
রোমান্টিক হিরো ।
চতুর্ভুজ নন ,
দশাবতারের এক নন ,
পার্থসখা নন ,
লক্ষ্মীকান্ত নন ।
“ চেতোদর্পণমার্জ্জনং
ভবমহাদাবাগ্নিনির্দ্ব
াপনং
শ্রেয়ঃ
কৈরবচন্দ্রিকাবিতরং
বিদ্যাবধূজীবনম্ ।
আনন্দাবুধিবর্দ্ধনং
প্রতিপদং
পূর্ণামৃতাস্বাদনং ,
সর্দ্বাত্মস্নপনংপরং
বিজয়তে
শ্রীকৃষ্ণসংকীর্ত্তনম
্ ।। ”
আর যে মানুষটি এই এক
নামকে বিপ্লবের মন্ত্র
করে তুললেন , তিনি
চৈতন্য । নামের মতই
অমোঘ । কৃষ্ণনামমাত্র
সম্বল করে , জনমনোহারী
ব্যবহারে , সপ্রেম
স্পর্শে জাগিয়ে তুললেন
গনচেতনা । পিছিয়ে পড়া
কাঁধে হাত রাখলেন ,
উদ্ধত কাঁধেও । কেউ
নম্র হল বিনয়ে , কেউ ঋজু
হল ভরসায় । এ পর্যন্ত
কোনও ভুল নেই ।
এরপর , ১৫৩৩ সাল , ২৯শে
জুন । শ্রীক্ষেত্র ।
আষাঢ় সপ্তমী শুক্লা ।
কী হল কেউ বলতে পারে না ।
কেউ বলে, “ জগন্নাথে লীন
প্রভু হইলা আপনে ।। ” (
লোচনদাস ) কেউ আবার মনে
করেন , রথের দিন পা কেটে
যাওয়ায় টিটেনাস
ইনফেকশন । কারা যেন
আবার দেখেছে , নীল
সমুদ্র দেখে কৃষ্ণনামে
মাতোয়ারা চৈতন্য ছুটে
গেলেন । শেষ বারো বছর
নিজেকে পুরোপুরি রাধা
ভেবেছেন কিনা !
নিন্দুকে এও বলে ...
খুঁজলে হয়তো মন্দিরের
আশেপাশেই মাটির নিচে
এখনও পাওয়া যেতে পারে
তাঁকে । আমরা জানি না কী
হয় এঁদের । সত্যিই
যীশুর পুনরুত্থান হয় না
তিনি আদৌ ক্রুশে
মরেননি, নেতাজির কি
হয়েছিল ... কেউ জানে না ।
যে সব মানুষ সমাজটাকে
এলোমেলো করে মিশিয়ে দেন
, কোনও জাত – ধর্ম - বর্ণ
রাখেন না , কোনও
ভিক্ষাবৃত্তির ধার
ধারেন না , তাঁদের কী হয়
কেউ জানে না । ভগত সিং
-এর লাশও তো জ্বলে গেছিল
লোকচক্ষুর আড়ালে । লোকে
জানল , চৈতন্যের
তিরোধান হয়েছে । মেনে
নিল । ভুল । প্রথম ভুল ।
কিন্তু ভুল কখন অপরাধ
হয় ? যখন তার কাজ কোনও
বিশেষ উদ্দেশ্যের
প্রণোদনা । চৈতন্য
গেলেন, কিন্তু রেখে তো
গেছিলেন এক
গণ-আন্দোলনের
উত্তরাধিকার ! রেখে
গেছিলেন তাঁর অগুন্তি
ভক্তদের , যাঁদের হাতে
বৈষ্ণব ধর্ম পেতে পারত
সঠিক গণ - অভিমুখ ।
কিন্তু তা আদৌ হল না ।
শ্রীরূপগোস্বামী
স্বয়ং মহাপ্রভুরই আদেশ
অনুসারে রসশাস্ত্র
নিরূপণ ও লুপ্ত তীর্থের
উদ্ধার-প্রচার করবেন
বলে বৃন্দাবনে আসেন ।
কিন্তু তিনি যাকে
বৈষ্ণব দর্শন বলে তৈরি
করলেন, তা আর যাই হোক ,
চৈতন্যের মনোবাসনা ছিল
না । গৌড়ীয় বৈষ্ণব
দর্শন তত্ত্বে
রাধাকৃষ্ণ আছেন বটে ,
কিন্তু তাঁদের
সর্বধর্মসমন্বয়ী
সত্ত্বা নেই ।
মহাপ্রভুর ধর্মকে
প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী
প্রমাণ করতে গিয়ে তিনি
হিন্দু ধর্মের আওতায়
বৈষ্ণবদের এনে ফেললেন ।
এতই মনোগ্রাহী ছিল সে
ব্যাখ্যা , যে তার পরে
কেউ আর তার থেকে সরে এল
না । এই ব্যাখ্যা থেকেই
বেরতে থাকল
অচিন্ত্যভেদাভেদ
তত্ত্ব , রাধাবাদ ,
রাগানুগা ভক্তিবাদ ... আর
সসম্মানে হিন্দুত্বকে
জায়গা ছাড়তে থাকল
চৈতন্যের সাধের
স্তরান্তরিত সচলতা ।
এমন পর্যায়ে চলে গেল
ব্যাপারটা – পরিভাষা না
জানলে আর বৈষ্ণব ধর্ম
বোঝা যাবে না ! যা ছিল
মূর্খ , নাস্তিক ,
ভিন্নধর্মীদের
প্রাণের জিনিস ... তা
কিছু তত্ত্বজ্ঞ
পণ্ডিতের কুক্ষিগত গূঢ়
সাধনায় পরিণত হল । কেউ
বাধা দিল না । কেউ কি দেয়
? রাজা দেখছেন
শ্রেণীবিহীন সমাজ
তাঁকে মানবে না ।
ব্রাহ্মণ দেখছেন
সমন্বয় তাঁদের ছাঁদায়
টান দেবে । মুসলিম
দেখছেন , নীচুতলার
মানুষকে ধর্মান্তরিত
করার সব ছুতো নষ্ট
হচ্ছে । চৈতন্য বেঁচে
থাকতে কুৎসা রটিয়েও
তাঁকে থামান যায় নি ।
মৃত্যুর পরেও নিছক
কুৎসা দিয়ে থামান যাবে
না । মহাপুরুষদের
জীবনের চেয়েও বেশি
কিংবদন্তী হয় জীবনের
উদ্দেশ্য । একজন যখন
ভুল করে তাকে সুবিধাজনক
দিকে চালান করেই দিয়েছে
... বাকিরা থেমে থাকে কেন ?
ভুল ছিল ... জমে জমে
প্রচণ্ড অন্যায় হয়ে উঠল
। নদীয়ার সিংহাসনে এলেন
শাক্ত রাজা
কৃষ্ণচন্দ্র । দুর্গা –
কালী - জগদ্ধাত্রীর
আরতির সিঁদুরে মুছতে
থাকল আদি বৈষ্ণবদের
শেষতম অভিজ্ঞান ।
অবশেষে কিছুটা তন্ত্র ,
কিছুটা বাউল দেহতত্ত্ব
এবং অনেকখানি
হিন্দুত্ব নিয়ে বিকৃত
হয়ে জেগে থাকল বৈষ্ণব
ধর্ম । উচ্চবর্ণের যে
মানুষরা এই হিন্দুত্ব -
মিশ্রিত ‘ অভিজাত ’
বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ
করলেন , তারা নিজেদের
পদমর্যাদা ভুলতে পারেন
নি । যারা মূল ধারা
টিকিয়ে রাখার চেষ্টা
করলেন , তারা সমাজ -
বহির্ভূত হয়ে গেলেন ।
বৈষ্ণবদের মধ্যে
শালগ্রাম শিলা পূজার
পদ্ধতি ঢুকে এল ।
স্মার্ত রঘুনন্দনের
বিধান চৈতন্যের
আদর্শের চেয়ে বেশি
মান্যতা পেল । এমনকি , ‘
গোঁসাইগিরি ’ অত্যন্ত
ভালো ব্যবসা হিসেবে
বিবেচিত হতে থাকল ।
কারণ খুঁজেছেন অনেকেই ।
শ্রীচারুচন্দ্র দত্ত
একটা জরুরি বিশ্লেষণ
করেছেন । দেখিয়েছেন ,
কিভাবে তত্ত্ব আস্তে
আস্তে প্রয়োগকে
আচ্ছন্ন করে ফেলে ।
চৈতন্যের যে
‘ applied ’ ধর্ম , যা কিনা
আদ্বিজচণ্ডালকে এক
সারিতে আনছে ...তাকে
তত্ত্বে ভুল সুরে
বাঁধার পরেই চ্যুতি
থেমে থাকে নি । ঐ ধর্মকে
নিয়মিত কার্যক্রমে
বেঁধে রাখা জরুরি ছিল ,
যা কেউ করেন নি । কাজের
স্রোত হারালে তত্ত্বের
বিকার অনিবার্য । ফলে
ভেতরে বাইরে ঝাঁঝরা হয়ে
চৈতন্যের সাধের বৈষ্ণব
ধর্ম ‘নেড়ানেড়ির
কীর্তন’ হয়ে বেঁচে থাকল
। ফুরিয়ে গেলেও হয়ত
লোকের কৌতূহল জাগত ।
থেকেও না থাকলে কেউ আর
প্রশ্ন করে না । আজ ২০১৪
সাল পর্যন্ত কোনও বাংলা
পাঠ্যপুস্তক প্রশ্ন
করল না – কেন এই চ্যুতি ?
কিসের এত ঔদাস্য ? বরং
কলেজে বেশি বেশি করে
সাজেশন আসে ‘ চৈতন্য
পরবর্তী বৈষ্ণব ধর্ম
আন্দোলন ’ – যার কিনা
অস্তিত্বই নেই কোথাও !
ফতেমা , রেহানরা মাথা
কুটে সেসব মুখস্থ করে ।
তারাও প্রশ্ন তোলে না ...
যবন হরিদাস যে
কৃষ্ণনামে মাতোয়ারা
ছিলেন , সে কৃষ্ণ
তত্ত্বে কোথায় ? যে নাম
নাকি শূদ্রের জিভে ,
যবনের কানে , চণ্ডালের
মনে রণন তুলে ভেদভাব
দূর করে ... তাকে কি করে
ধরবে রসশাস্ত্রে ,সদ্ -
চিদ্ -হ্লাদিনীর
পরিভাষায় ? আর কেনই বা
ধরবে ? যার মানসসন্তান ,
তিনিই কি ধরেছিলেন ?
এভাবেই কি যুগে যুগে
খুন হয়ে যায় না ,
আন্দোলনের স্বপ্নগুলো ?
ভুল করে , ভুল বুঝে বা
বুঝিয়ে ?
যেমন এক রাত্রে লেনিনের
লেখা পড়তে পড়তে খুন হয়ে
গেছেন শঙ্কর গুহনিয়োগী
। যিনি স্বপ্ন
দেখেছিলেন সমস্ত
ছত্তিসগড় রাজ্যের
খনিতে শ্রমিকের রাজত্ব
প্রতিষ্ঠিত হবে । যিনি
একের পর এক সফল
আন্দোলনে ভেঙে
দিচ্ছিলেন মালিক
পক্ষের মেরুদণ্ড । তাঁর
আদর্শে গড়ে উঠছিল
নেশামুক্ত গ্রাম ,
স্বনির্ভর সমাজ ।
আদিবাসীদের সঙ্গে
নিজের মেধার ফারাক
বহুগুণ হলেও হার না
মেনে তাদের হয়ে লড়ে
গেছেন । বাইরে থেকে
সহযোগীদের ডেকে আনতেন ।
মতবিনিময় হত । লড়াই হত ।
এক কারখানার শ্রমিকদের
খাইয়ে - পরিয়ে বাঁচিয়ে
রাখত অন্য শহরের
শ্রমিকদল । যত মজবুত হত
মালিকের হাত , তত
শ্রমিক - ঐক্যের চাপ
বাড়ত । যদি মানুষটা অমন
অগোছালোভাবে খুন না হয়ে
যেতেন, হয়তো মানুষগুলো
জিতে যেত ,সত্যিই ।
খুনই হয়েছিলেন কিনা ,
সন্দেহ হয় । নতুন
বাড়িতে এসে নিজেই
বলেছিলেন – “ এই খোলা
জানলা দিয়ে ওরা আমায়
গুলি করবে । ” যেদিন
সকালে বুলেটপ্রুফ নেট
বসার কথা , তার আগের
রাত্রেই পল্টন মোল্লার
বুলেট তাঁর কাঁধ ফুঁড়ে
যায় , ঐ জানলা দিয়ে এসে ।
অথচ ইতিপূর্বে ভাড়াটে
খুনিরা এই মানুষেরই
পায়ে হাত রেখে বলে গেছে
... “ সাবধানে থাকবেন ,
আমাকে আপনার সুপারি
দেয়া হয়েছিল ।” শুনেছি ,
যখন ত্রিপাক্ষিক
চুক্তি নিয়ে
মালিক-শ্রমিক টানাপড়েন
চরমে , তখন নিজেই এক
সহকর্মীকে
জানিয়েছিলেন গভীরতম
দুঃখ । “আমি চাইলে
এখুনি এইসব মিটিয়ে দিতে
পারি , কিন্তু তাতে আবার
গুলি চলবে । আর কত
শ্রমিকের জান নেব ? ” হয়ত
ভেবেছিলেন,তিনি নিজে
শহীদ হলে দেশজুড়ে ঝড়
উঠবে । সেই ঝড়কে
কারখানার দিকে , খনি
অফিসের দিকে বইয়ে দেবে
সাথীরা । স্বপ্নের
ত্রিপাক্ষিক চুক্তি
স্বাক্ষর হয়ে যাবে ।
হয়তো তাই ... খোলা
জানালার দিকে পিঠ
ফিরিয়ে বসেছিলেন ! যার
জিপের ড্রাইভার জানতো
না তিনি কোথায় যাবেন ...
কি সহজে মৃত্যু তাকে
জেনে ফেলেছিল ! ঝড়
উঠেছিল তারপর । সত্যিই
। কেডিয়া – সিমপ্লেক্স -
বি.কে . - দের অভিমুখে
তাকে নিয়েও গেছিল ।
কিন্তু সেই ভুল ।
চুক্তির টেবিলে
সাংগঠনিক দ্বন্দ
প্রকাশ করে ফেলায় এক
পলকে সব শেষ হয়ে গেল ।
নিজেদের ব্যাখ্যাকে
সবার ওপরে রাখার জন্যে
অনেক বিনিদ্র চোখের
স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে
দিয়েছিলেন কয়েকজন । আর
কোনোদিন মাথা তুলে
দাঁড়াতে পারেনি
ছত্তিসগড়ের শ্রমিক
আন্দোলন । আজ আমরা সবাই
জানি, কিভাবে নিয়োগীর
স্পর্ধার রেশটুকু মুছে
দিচ্ছে ও রাজ্যের সরকার
। জানছেন বিনায়ক সেন ,
সোনি সরি । সেদিন যারা
সহযোগী ছিলেন , আজ তাদের
অনেকেই শাসক দলের
অগ্নিময় চোখ হয়ে উঠেছেন
। যারা পারেন নি, তারা
মুছে গেছেন । অনুপ সিং
নিরুদ্দেশ । শহীদ
হাসপাতাল চলছে কোনরকমে
। শঙ্কর গুহনিয়োগীর
সন্তানেরা যার যার মত
আলাদা আলাদাভাবে
চেষ্টা চালাচ্ছেন ।
ছত্তিসগড় মুক্তি
মোর্চা আজও সুধা
ভরদ্বাজের নেতৃত্বে
কাজ করে চলে, কিন্তু সেই
সংগঠন নেই আর । যে বিপুল
শক্তি নিয়ে এক পা আহত
অবস্থাতেও একা মানুষটি
ভিলাই-দল্লিরাজহারার
মালিকপক্ষের ত্রাস হয়ে
উঠতেন , তা আজ কারোর
নেই । আজও সে দেশে খাদান
দখল করতে আসছে জিন্দাল
। রোজ আদিবাসীরা মারা
যাচ্ছে । মাঝে মাঝে
নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে
তরতাজা তরুণ - তরুণী ।
কিন্তু নানা মতে টুকরো
হয়ে ভেঙে গেছে আন্দোলন
– একটা ভুল ব্যাখ্যা
যেন প্রতিটি কশেরুকা
গুঁড়িয়ে দিয়েছে । ভিলাই
অফিসে আজ শুধু তাকিয়ে
আছেন গুহনিয়োগিজী ,
কলাদাসজীর ভাইয়ের আঁকা
ছবি হয়ে ।
হয়তো গাফিলতি ওই তরফেও
ছিল । এত ক্রান্তদর্শী
মানুষ ... কেউই দেখতে
পাননি যে ওদের পর কেউ
নেই । ‘ One Man Army ’ ছিলেন
দুজনেই । একা হাতে সমাজ
পাল্টাতে গেছিলেন ।
ভেবেছিলেন , ভবিষ্যৎ
নিজের পথ চিনে নেবে ।
কিন্তু ... ভুল ।
চৈতন্যের ধর্মের
চ্যুতির পর কেউ তাঁর
ছাত্রদের উত্তরীয় চেপে
ধরেছিল কিনা জানা নেই ।
কিন্তু ত্রিপাক্ষিক
চুক্তি বাতিল হবার পর
একজন মানুষ মাটিতে আছড়ে
পড়ে কেঁদেছিলেন । সামনে
নিথর দাঁড়িয়েছিলেন
চুক্তি বানচাল করে
দেওয়া এক সহকর্মী ।
তিনি শেষমেশ কাঁপা গলায়
জানিয়েছিলেন ... এই প্রথম
তাঁর সিদ্ধান্তকে কেউ
পাত্তা দিয়েছে , তাই
অগ্রপশ্চাৎ না ভেবেই
শ্রমিকস্বার্থবিরোধী
সিদ্ধান্ত নিয়ে
ফেলেছেন । সহকর্মীদের
স্বীকৃতি দিতে খেয়াল না
করা নেতার ভুল ছিল
নিশ্চয়ই । কিন্তু কেউ
তো এগিয়ে এলেন না পতাকা
হাতে নিতে ! পূর্বজের
ভুল কে
শোধরায় , উত্তরাধিকারী
ছাড়া ? কেউ তো হয়ে উঠল না
আন্দোলনের মুখ ! দুটো
অসাধারণ জীবন তো বটেই ,
অসাধারণ মৃত্যু ব্যর্থ
হয়ে গেল । বাংলা
সাহিত্যের ইতিহাস আজ
চাইলেও পাল্টানো সম্ভব
নয় । ভুলটুকু স্বীকার
করে নেওয়া যায় বড়জোর ।
আজ আর মহাপ্রভু জন্মান
না ... ঘেন্নায় বোধ করি ।
মানুষজনও ‘ money ’ ব্যতীত
অন্য কোনও নামে উন্মত্ত
হয় না । কিন্তু একটা
আদর্শের চুরি হয়ে যাওয়া
এবং তার প্রতিবাদ না
করা... এ ভুল আজও হয় । হয়েই
চলে । আগামীর ইতিহাস না
পাল্টানোকে কী নাম দেবে
মানুষ ? ভুল ? “স্বপ্নের
সব পথই ভুল ছিল...?”