কেউ তার জন্য অপেক্ষা
করত না কোনোদিন। তার
ধারণাতেও ছিল না কেউ
কারো জন্য অপেক্ষা করে
। সে অপেক্ষার সঙ্গে
জুড়েছিল বস্তুদের ।
ট্রেনের জন্য অপেক্ষা
করত, পেটে প্রবল
পায়খানার ভার নিয়ে
অপেক্ষা করত পায়খানা
ফাঁকা পাওয়ার, খিদা
বেলাগাম হয়ে গেলে ভাতের
অপেক্ষাও তার চেনা ছিল।
মানুষকে মানুষের জন্য
অপেক্ষা করতে শুধু একটি
জায়গাতেই সে দেখেছিল ---
হাসপাতাল। বড় চিকণ হয়ে
আসে মানুষের চোখ
হাসপাতালে অপেক্ষা
করতে করতে, সে খেয়াল
করেছিল । হাসপাতাল ছিল
তার পৃথিবীর সবচেয়ে নরম
সুন্দর এক অনুভূতি
যেখানে মানুষ নিজের
মানুষদের জন্য ঘন্টার
পর ঘন্টা অপেক্ষা করে।
সেই থেকে তার একটিই শখ
সে হাসপাতালে টানা
অনেকদিন ক্যাঁতরে পড়ে
থাকবে আর বাইরে
অপেক্ষায় থাকবে তার
নিজের মানুষজন। তারা
উদ্বিগ্ন হবে, ঘনঘন চা
খেতে যাবে, খিদা চোট
দিলে পিঁয়াজি আর মুড়ি
চিবুবে, জমির দাম নিয়ে
দু পুয়াক গপ্পাবে,
কোথায় কতটাকা জমালে কত
সুদ আসবে তা নিয়ে
আরেকবার চা খেতে যাবে,
বাজার তো আগুন বলে
ক্ষোভ উগড়াবে আর
অপেক্ষা করবে কখন
কোলাপসিবলটা টেনে খুলে
দিয়ে হাঁক আসবে--- “দু’জন
করে যান, আস্তে...” ।
স্বপ্নটা সে মনে মনে
যতবার রিহার্স করেছে
পরম এক প্রশান্তিতে ভরে
যেত মন। এমন এক
পরিতৃপ্তির অবস্থান
জুড়ে আসত যেখানে মারা
গেলে আর পুর্নজন্মের
কোনো আশ বা আশা কিছুই
থাকে না।
...এইসব সময় সে দেখতে পেত
রকমারি ফুল হাতে একটি
মেয়ে রাস্তা পার করছে...
ঠিক কবে থেকে সে এটার
অপেক্ষা শুরু করল তার
আর মনে পড়ে না। বোধহয় ,
তার কোনো এক আত্মীয়
মারা গিয়েছিল
হাসপাতালে, খুব ছোটো সে
তখন। মরার প্রায়
সপ্তাহখানেক আগে থেকে
তাকে নিয়ে তার নিজের
মানুষজন হাসপাতালে যেত,
সে অপেক্ষা করত কখন তার
জন্য বরাদ্দ ম্যাঙ্গো
বাইট পকেটে করে নিয়ে
আসবে তার আরেক আত্মীয়।
ম্যাঙ্গো বাইটের
অপেক্ষায় হাসপাতাল যেত
সে।
---- “আপনার কিচ্ছু
হয়নি”--- “এমনি এমনি চলে
এলেন”--- “একটা বেড আটকে
রাখলেন ৪৮ ঘন্টা!”---
“আপনি সিম্পলি
ডিসগাস্টিং একটা মানুষ,
সিক, নার্সিসিস্ট,
ওসিডিপনা চোদাবেন না”---
“ সবাইকে হ্যারাস করে
কি পেলেন বলুন তো?”---
এগুলো শুনতে শুনতে সে
দেখছিল বাইরে একটা
পাখি, চড়ুই-চড়ুই দেখতে
কিন্তু চড়ুই নয়, একমনে
তাকিয়ে আছে
হাসপাতালটার দিকে । তার
পাখিদের জন্য খুব কষ্ট
হচ্ছিল, পাখিদের কেউ তো
পাখিদের জন্য
হাসপাতালে অপেক্ষা করে
না। পাখিদের জন্য কি
তাহলে কোনো অপেক্ষা,
অপেক্ষা করে না? ভাবতে
ভাবতে সে ব্যাগ
গুছোচ্ছিল, বাড়ি ফিরতে
হবে তাকে । তার নিজের
জন্য খুব কষ্ট হল।
হাসপাতাল থেকে বাইরে পা
দিয়েই আবার সে স্বপ্নটা
মনে মনে রিহার্স করে
নিল।
...এইসব সময় সে দেখতে পেত
রকমারি ফুল হাতে একটি
মেয়ে রাস্তা পার করছে...
সেইবারের পর আরও বার
দুই-তিনেক সে হাসপাতালে
গেছে । ফেরত এসেছে ৪৮
ঘন্টার ভিতর। তার
চারপাশে কতলোক
হাসপাতাল গেল, থাকল
কতদিন! সে ঈর্ষা করত
এদের। আর করত অপেক্ষা।
একটি ওষুধ গন্ধের
বিকেলে তার জন্য
উদ্বিগ্ন হয়ে দেখা করতে
এসেছে তার মানুষজন ।
--- “ সেকেন্ড টেস্টেও
একই এসেছে”--- “ ডিফাইন্ড
কেস অফ কার্সিনোমা”---
“আগে সার্জারি, তারপর
কেমো”--- “হাসপাতালে
রাখতে হবে দিন কয়েক,
কেমো চলাকালীন ২৮ দিন
পরপর ভর্তি হতে হবে,
প্রায় সাত আট মাস সব
মিটতে মিটতে”--- “আপনার
সঙ্গে কেউ আসে নি কেন?”
তারপরেও ব্লা ব্লা
ব্লা করে কিসব বলছিল
ডাক্তারবাবু, সে আর গা
করে নি । সে জানে এবার
সত্যি সত্যি সে
হাসপাতালে ভর্তি হবে ।
আর কেউ না কেউ তার সঙ্গে
চিকণ সব বিকেলে দেখা
করার জন্য অপেক্ষা করবে
। তার নিজের মানুষজন সব
।
...সে দেখতে পেল রকমারি
ফুল হাতে একটি মেয়ে
রাস্তা পার করছে...