একটি গল্প-টুকরো হারিয়ে
গেছে। নেহায়েত
বিচ্ছিন্ন একটি টুকরোই
শুধু নয়- সে ছিলো সদ্য
লেখা এক-প্যারা গল্পটার
প্রথম বাক্য। আর
গল্পটাও এর লেখক জয়ন্ত
ব্যানার্জীর জীবনের
প্রথম গল্প। কাজেই
বাক্যটা ছিলো প্রথমেরও
প্রথম। তাই তাকে হারিয়ে
অন্য বাক্যগুলো মা-হারা
শিশুর মতো এক রাশ
অবহেলা নিয়ে শুয়ে থাকে
সাদা কাগজের কাঁথায়।
জয়ন্ত না পারছে
মা-বাক্যটাকে খুঁজে
আনতে না পারছে লেখাটাকে
এগিয়ে নিয়ে যেতে। তাই
মাঝপথে বিচ্ছিন্ন ও
গুরুত্বহীন আটকে গেছে
শিশু-বাক্যগুলো।
ইংরেজিতে এম এ শেষ করে
কয়েক মাস কোন
চাকরি-বাকরি করবে না
বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এই সময়টায় লেখালেখি করে
ও দেখতে চায় কাজটা ওকে
দিয়ে হবে কি-না। বাবা
ধীরেন ব্যানার্জী একটা
বিদেশি এন জি ও’র
পরিচালক হিসেবে অবসরে
যাবেন চলতি বছরের শেষে।
ছোট ভাই সৃজন এবার ও’
লেভেল দেবে। মা অপর্ণা
একটা মেয়েদের স্কুলে
পড়াতেন। তবে এখন তিনি
ফুলটাইম গৃহিণী।
যথেষ্ট সচ্ছল এই
পরিবারটি শহরের
দ্বিতীয় সারির একটা
অভিজাত এলাকায় নিজেদের
ফ্ল্যাটে থাকে; একটা
টয়োটা এ্যালিয়ন গাড়িও
আছে। আজ বাড়িতে জয়ন্ত
এবং ওর বাবা ছাড়া আর কেউ
নেই। ওর মা গেছেন ওদের
মাসি’র বাড়িতে আর সৃজন
গিয়েছে ওর বন্ধু
অরিত্র’র বাসায়।
কাল রাতে লিখে ওঠার
কিছুক্ষণ পরেই বাক্যটা
মিলিয়ে যায় ওর ডাইরি
থেকে। এই উচ্চকিত
গুঞ্জনের শহরের
থিকথিকে বাতাস আর কর্কশ
রোদের ভেতরে আজ সারাদিন
হেঁটে হেঁটে তাকে
খুঁজেছে জয়ন্ত। কেমন
একটা পাগল পাগল মায়া
পড়ে গেছে বাক্যটার উপর।
একবার পৃথিবী-বিখ্যাত
এক লেখকের জীবনীতে ও
পড়েছিলো যে সেই লেখক
শহরের বিভিন্ন
ক্যাফেগুলোতে ঘণ্টার
পর ঘন্টা বসে থাকতেন।
উদ্দেশ্য ছিলো সমাজের
নানা কোণ ও বাস্তবতা
থেকে আসা মানুষগুলোকে
পর্যবেক্ষণ ও তাদের কথা
শোনা।
সদ্য প্রেমিকা হারানো
উশকোখুশকো
এ্যালকোহলিক প্রেমিক,
ক্লিন-শেইভ্ড্
চিক্কণ-থুতনির
কেতাদুরস্ত ব্যবসায়ী
উদ্যোক্তা, জীবনের সাথে
প্রতিনিয়ত বোঝাপড়া করা
সিঙ্গেল মা, জরায়
আক্রান্ত জীবনের শেষ
সিঁড়িগুলো’র একটিতে
বসা বৃদ্ধ-বৃদ্ধা,
সেদিনই লে অফ হওয়া
ক্রুদ্ধ- হতাশ যুবক,
ধনী’র পুতুপুতু
দুলাল-দুলালী, ব্যর্থ
কবিসহ কতো বিচিত্র সব
মানুষ আসতো সেই
ক্যাফেগুলোতে; তাদের
কথা বলার ঢং, তাকানো,
কথোপকথনের ভাঙা টুকরো
বা হাসির গুঁড়ো লেখক
লক্ষ্য করতেন জীবন-মরণ
তীক্ষ্ণতায়। এই
মানুষ-ভজন ছিলো তার
জীবন দর্শনের চর্চা
যাতে ছড়িয়ে থাকতো
অতীত-বর্তমানের নানা
খন্ড-চিত্র। ওগুলো
ছেঁকে লেখক খুঁজে নিতেন
তার নতুন ফিকশনের
ভ্রূণ-বাক্য বা লিখতে
থাকাটা’র
ডালপালা-বাক্য।
তবে সেই লেখক খুঁজতেন
না-জন্মানো নতুন নতুন
সব বাক্যদের আর জয়ন্ত
খুঁজছে জন্মেই হারিয়ে
যাওয়া একটি মাত্র
বাক্যকে। কোথায়
খোঁজেনি তাকে! মোড়ের
চা-শিঙ্গাড়া-পুরি-ভাতের
দোকান থেকে শুরু করে
আবাসিক হোটেলের সদ্য
কৈশোর পেরোনো গণিকার
অনভ্যস্ত জড়োসড়ো বসার
ভঙ্গিতে!
শুরুতেই ও গেলো ওদের
বাড়ি’র গলি’র মাথা’র
চা-শিঙাড়া-পুরি’র
দোকানটাতে। সকালের ঐ
সময়টাতে দোকানটায়
লোকজন ছিলো না তেমন। বড়
একটা তেল-ডোবা কড়াইতে
এক কোঁকড়া-চুল যুবকের
ঘাম-চকচকে পেশল হাতে
ঝাঁক বেঁধে ভাজি
হচ্ছিলো ঘিয়ে রঙের
মুচমুচে শিঙাড়াগুলো।
কড়াইয়ের পাশেই
কালি-ঝুলি মাখা
স্যান্ডো গেঞ্জি পরা এক
ছোকরা শিঙাড়ার কাই
ডলছিলো দুই হাত দিয়ে।
দোকানের সামনে দিয়ে
একটা বিশ-বাইশ বছরের
মেয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো
তখন। মেয়েটাকে দেখেই
ছোকরাটা তখন বার বার
উপুড় হওয়া ও আবার সোজা
হওয়ার ভঙ্গি করে
কাইগুলো ডলার গতি
বাড়িয়ে দিলো হঠাৎ-ই।
ছোকরা শিস দিতে দিতে
শিঙাড়া ভাজতে থাকা
যুবকের দিকে তাকিয়ে
ইশারায় মেয়েটাকে
দেখালো; এরপর বাঁ চোখ
টিপে হাসতে হাসতে বললো...
‘উ...স্তা...দ...গরম ভাত
খামু...গরম তরকারি
দিয়া...সাথে দেশি মুরগির
ঝোল...’
বলাই বাহুল্য যে
বাক্যটাকে পাওয়া গেলো
না ওখানে।
পরের গন্তব্য ছিলো
শহরের সেরা পাঁচ তারা
হোটেলগুলোর একটি।
হোটেলের পুল সাইড ফুড
কোর্টে বসে ম্যাঙ্গো
জুস আর ব্রাউনির অর্ডার
দিয়ে চারপাশে তাকালো
জয়ন্ত। কিছু বিদেশি
অতিথি’র পাশাপাশি বেশ
কিছু দেশি নারী-পুরুষও
ছিলো ওখানে। জয়ন্ত’র
পাশের টেবিলে বসেছিলো
এক মাঝ-বয়েসি দেশি
পুরুষ ও অপেক্ষাকৃত কম
বয়েসি একটা মেয়ে। তাদের
কথোপকথনের টুকরোগুলো
থেকে বোঝা গেলো গেলো যে
দু’জনের মাঝে দীর্ঘ সময়
ধরে পরকীয়া চলছে।
পুরুষটার স্ত্রী
প্রবাসী হলেও মেয়েটার
স্বামী দেশেই থাকে।
বিয়ের প্রায় পাঁচ বছর
হয়ে গেলেও ওদের বাচ্চা
হচ্ছিলো না। সমস্যা
মেয়েটার স্বামীর।
কিন্তু মেয়েটা আজ সকালে
জেনেছে যে সে দেড় মাসের
গর্ভবতী। মেয়েটা
বলছিলো যে বাচ্চাটা তার
পরকীয়া প্রেমিক
পুরুষটার। তাই সে এখন
তার স্বামীকে ছেড়ে
পাকাপাকিভাবে
প্রেমিককে বিয়ে করে
আলাদা হতে চায়। কথাও
সেরকমই ছিলো। কিন্তু
পুরুষটা এখন আর সেটা
মানতে চাইছে না। অথচ
তার চোখের চোরা অপরাধী
দৃষ্টি দেখে পরিষ্কার
বোঝা যাচ্ছিলো যে
মেয়েটার পেটের
বাচ্চাটা তারই।
এদিক-ওদিক তাকিয়ে গলা
খাদে নামিয়ে সে
বলছিলো-
‘এই বাচ্চা’র দায়িত্ব
আমি নেবো না। তুমি ভেবে
দেখো কার সাথে কী করসো।
তুমি তো তোমার
হাযব্যান্ডের সাথেই
লয়াল থাকতে পারো নাই।
হাউ ডু আই ট্রাস্ট ইউ?’
মেয়েটা’র বড় বড় চোখের
স্থির-শান্ত দৃষ্টি
দেখে জয়ন্ত’র মনে পড়ে
গেলো ওদের গ্রামের
সুপ্রাচীন অশ্বত্থ
গাছটার কথা। সাদাটে
ধূসর ছায়া দিতো
গাছটা-বাইরে নিরিবিলি
ছিমছাম আর ভেতরে শত
বছরের জমা ঘন
ক্লোরোফিল-বিষাদ।
বাক্যটাকে পাওয়া গেলো
না এখানেও।
এরপর হাঁটতে হাঁটতে
একটা ঝিকিমিকি শপিং
মলের সামনে দিয়ে যাওয়ার
সময় পান খেয়ে ঠোঁট-লাল
করা একটা লোককে মলের
সিঁড়িতে বসে থাকতে
দেখলো জয়ন্ত; লোকটা
মোবাইলে ওপাশের কাউকে
বলছিলো-
‘শালা পুঙ্গির পো,
কাইলকার মধ্যে আমার
ট্যাকা না দিলে আমি
জাস্ট গুল্লি করুম
তোরে…প্রেম করতে পারোস,
মাগী লাগাইতে পারোস
খালি আমার ট্যাকাডাই
দিতে পারোস না। তোর
এইসব রসের কথা টিভি’র
টক শো তে গিয়া ক, শালা
বাইঞ্চোত!…’
এরপর হাঁটতে হাঁটতে
মেয়েদের হলের সামনে
পৌঁছে দেখা পাওয়া পেলো
শ্মশ্রুমণ্ডিত এক
তরুণের। দুপুর তখন
মধ্য-যৌবনে। তরুণটি
একটা কালো চাদর গায়ে
হলের গেটে মেয়েদের
আসা-যাওয়া দেখছিলো ও
কোন মেয়ের চেহারায় একটু
মমতা’র ছাপ দেখলেই দৌড়ে
কাছে গিয়ে বলছিলো, ‘আপু,
৩০৩ নাম্বার রুমে’র
মেহরীনকে একটা মেসেজ
দিতে পারবেন, প্লিজ? ও
আমার ফোন ধরছে না।
শুনেছি ওর বিয়ে ঠিক হয়ে
গেছে...আপু, প্লিজ...’। কেউ
তার মেসেজ পৌঁছে দিতে
রাজি হচ্ছিলো না। কেউ
কেউ হেঁটে চলে যাচ্ছিলো
কোন কথা না বলেই আর
বাকিরা বলছিলো, ‘সরি,
অন্য কাউকে বলেন।’
যুবকের কাতর
প্রার্থনারত মুখটাকে
মগজে ট্যাটু’র মতো
লাগিয়ে জয়ন্ত একে একে
ঝালমুড়ি-আমড়া-কাঁচের
চুড়ি সাজানো
ফেরিওয়ালাদের বুঝে
নেয়া ফুটপাত, ঠাণ্ডা
হলুদ আলোর সারি সারি
মন্থর গয়নার দোকান,
ধুলো-বিষণ্ণ পাবলিক
লাইব্রেরি, পাতালপুরীর
রাক্ষস-দুর্গ সদৃশ
সরকারী হাসপাতাল,
বিষণ্ন আভিজাত্যে ঘেরা
প্রাইভেট হসপিটাল,
খোলা-আকাশের নিচে ভাতের
বলক-তোলা কাঁচা ধোঁয়ার
অশ্লীল বস্তি,
আকাশ-চুমু-দেয়া
এ্যাপার্টমেন্ট পার
হয়ে এলো কিন্তু
বাক্যটাকে পেলো না
কোথাও; ক্লান্ত-হতাশ
চোখে যখন এদিক-ওদিক
তাকাচ্ছিলো ও, তখন হঠাৎ
করেই দেখা হয়ে গেলো
পাড়া’র এক আমুদে বড়
ভাইয়ের সাথে। সে
জয়ন্তকে নিয়ে গেলো একটা
আবাসিক হোটেলে’র
সদ্য-কৈশোরত্তীর্ণ এক
গণিকা’র রুমে। হলুদ
দাঁত বের করে হেসে বড়
ভাই যে গুরুত্বপূর্ণ
তথ্যটি জয়ন্তকে জানালো
তা হলো গণিকাটি একটা
‘ফ্রেশ মাল’ যাকে এখনো
কেউ ছোঁয়নি এবং জয়ন্তই
তাকে প্রথম ‘টেস্ট’
করতে পারে। জয়ন্তকে এই
বিরল সুযোগ করে দেয়ার
জন্য সে জয়ন্ত’র মুখ
থেকে একটা গদগদ ধন্যবাদ
পাবার আশায় হাসি হাসি
মুখ করে ওর দিকে তাকিয়ে
থাকে।
জয়ন্ত যখন মেয়েটা’র
রুমে ঢুকছিলো, বিকেলটা
তখন ঘনিয়ে আসা
সন্ধ্যাকে ভেংচি কেটে
হারিয়ে যাওয়ার
প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।
মেয়েটা একটা পুরনো
আমলের খাটের ঠিক
মাঝখানে জড়োসড়ো হয়ে বসে
ছিলো। কুলকুল করে
ঘামছিলো বাচারি।
জয়ন্তকে যেন দেখতেই
পায়নি এমন ভঙ্গিতে সে
পাশে রাখা আদ্যিকালের
রেডিওটা হাতে তুলে
নিলো; নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে
স্টেশন পরিবর্তন করতে
লাগলো একের পর এক। এক
স্টেশনে বাজতে থাকা
‘রূপ দেখে তোর হইয়াছি
পাগল’ গানটা শিস কেটে
ভেঙ্গে পড়লো পরের
স্টেশনের নারীদের
অধিকার-সম্পর্কিত
অনুষ্ঠানে- ‘নারীরা এখন
নিজেদের অধিকার বিষয়ে
সচেতন হচ্ছে ও সমাজে
নিজেদের একটা অবস্থান
তৈরি করে নিতে পারছে…’
মেয়েটার রুম থেকে জয়ন্ত
বেরিয়ে এসেছিলো কয়েক
মিনিট পরেই। এখানেও
যথারীতি পাওয়া যায়নি
বাক্যটাকে।
তার ২৭ বছরের জীবনে এক
দিনে এতো হাঁটা কখনো
হাঁটেনি জয়ন্ত; এতো
অল্প সময়েও এতো জায়গায়
যায়নি।
বাক্যটা যেন
এ্যারোসোলের মত মিলিয়ে
গেছে বাতাসে- একপ্রস্থ
ভাবটুকুকে জামার মতো
পরে সে নাম লিখিয়েছে
চির-নিখোঁজদের
তালিকায়।
সারাদিনের ক্লান্তি
নিয়ে সন্ধ্যার মুখে
জয়ন্ত যখন বাড়িতে
ঢুকলো, তখন গুড়গুড়
শব্দে আকাশ কালো হতে
শুরু করেছে। প্রথম
পা’টা বাড়িতে ফেলতেই
চিন্তা-মাছ ওর মগজে
বুজকুড়ি তোলে-
‘চিন্তা কোরো না, আমি
খোঁজ লাগিয়েছি। আমার
সাথে মিলেই তো তুমি
লিখলে বাক্যটা। আমারও
তো একটা দায়িত্ব আছে,
তাই না? আজ রাতের মধ্যেই
তোমাকে একটা খবর দিতে
পারবো আশা করি।’
এই আশ্বাসে সান্ত্বনা
পায় না জয়ন্ত। ওর শুধু
মনে হতে থাকে বাক্যটা
নিখোঁজ থাকতে থাকতে এক
সময় অতীত হয়ে যাবে;
বাষ্প হয়ে যাবে
অক্ষরগুলোর ব্যথা ও
ঘাম। সেই প্রিয় অথচ মৃত
মানুষটার মতো- যার ঘাড়ে
হাত রেখে কাপের পর কাপ
রং চা উড়ে যেতো একসময়ের
গুচ্ছ গুচ্ছ
বিকেলগুলোয়। এটা ঠিক যে
এইসব অতীতের কিছু কিছু
চ্যাপ্টা হয়ে বই বা
নিদেনপক্ষে ডায়রির
পাতার ভাঁজে শুয়ে পড়ে;
কিছু বা আবার পোল
ড্যান্সারের ভঙ্গিতে
দাঁড়িয়ে যায়
ক্যামেরা’র শাটারের
বিপরীতে। কিন্তু সে তো
শুধু ঐ ‘কিছু
কিছু’-বাকিদের ভাগ্যের
শিকে তো আর ছেঁড়ে না।
হারিয়ে যাওয়া
গল্প-টুকরোটা কি ঐ
‘কিছু’দের দলে ভিড়তে
পারবে? কিংবা কখনো কি
ফিরে আসবে ভবিষ্যতের
কোন লেখকের কলমে?
উত্তরটা ‘হ্যাঁ’ হলে
জয়ন্ত খুশি হবে হয়তো
কিন্তু ঠিক আনন্দিত হবে
না। কারণ ভবিষ্যতের
পাঠক চিনবে না ঐ
বাক্যের প্রথম লেখককে-
আলগোছে কৃতিত্বটুকু
পকেটে পুরবে ভাবীকালের
সেই লেখক।
ওর ভাবনা পড়তে পেরে
চিন্তা-মাছ ঘাই মারে,
কিছুটা বিরক্তির সুরে
বলে-‘বল্লাম তো একটু
ধৈর্য ধরো। এখনো তো
একটা দিন-ই পুরো পার হয়
নি। কী জানো তো তোমরা
মানুষেরা বেয়াড়া রকমের
অদ্ভুত। অতীতটা
বর্তমান থাকার সময় ওটা
নিয়ে যতোটা আদিখ্যেতা
করো, অতীত হয়ে যাওয়ার পর
ওটাকে ঠিক ততটাই ইগনোর
করো। অতীতচারিতাকে
তোমরা বলো পেছন ফিরে
‘দেখা’। তা বাপু শুধু
‘দেখা’ কেন? ‘শোনা’,
‘অনুভব করা’, ‘ছুঁয়ে
দেখা’ বা ‘স্বাদ নেয়া’
কেন নয়? তোমরা ধরেই
নিয়েছো যে এই শেষের
চারটা প্রথমটার সাথে
বাই ডিফল্ট চলে আসবে।
মানে একটা অপেক্ষাকৃত
উচ্চকিত ইন্দ্রিয়
নিজের গোপন ঝোলায় ভরে
নেবে অন্য তথাকথিত
অনুচ্চগুলোকে। মগজের
হাওয়া-ঘরে ভাসবে শুধুই
দৃশ্যের বুদ্বুদ;
শব্দচূর্ণ আর
দুঃখ-গুঁড়োরা থেকে যাবে
অলক্ষ্যে। কি বাজে
ধরণের ঐন্দ্রিক
সাম্প্রদায়িকতা
তোমাদের!’
অন্যান্য দিনের মতো
চিন্তা-মাছের এসব
উচ্চমার্গীয় যুক্তিকে
মৃদু হেসে খণ্ডন করার
মতো মনের অবস্থা আজ নেই
জয়ন্তের। সে আজ
প্রথম-সন্তান-হারা
পিতার মতোই
প্রথম-বাক্য-হারা লেখক।
প্রায় এক মাস ধরে একটা
ভাবনাকে জমাট বেঁধে
বেঁধে ওটাকে শেষমেশ
বাক্যে গুটিয়ে এনেছিলো
ও। আর বাক্যটা কি-না
এভাবে উধাও হয়ে গেলো!
চিন্তা-মাছকে ও
বিড়বিড়িয়ে বলে-
‘আজ আমার তর্ক করার মুড
নেই, চিন্তা-মাছ! তুমি যত
খুশি ঘাই মারো বা
বুজকুড়ি তোলো-আজ আমাকে
পাবে না। আজ আমি আমার
হারানো বাক্য-পুত্রকে
সারা শহর খুঁজে ফেরা
ব্যর্থ-ক্লান্ত পিতা...
একটা বিরতি চাই
আমার...তবে স্বস্তির নয়,
শক্তির- অর্থাৎ বিরতি’র
পর আবার খোঁজা’র
শক্তির’।
মুখোমুখি হতেই ওর বাবা
জানতে চায় সারাদিন
কোথায় ছিলো জয়ন্ত। একটা
মুখস্থ জবাব দিয়ে এক
কাপ কালো কফি হাতে
জয়ন্ত ধপ করে বসে পড়ে
বারান্দায় পেতে রাখা
ইজি চেয়ারটাতে।
জানালার বাইরে নামতে
থাকা সন্ধ্যাটা ভিজছে
বর্ষার প্রথম বা
দ্বিতীয় এফ এম
বৃষ্টিতে। এফ এম বৃষ্টি
মানে যে বৃষ্টি রেডিও
জকি’র আহ্লাদিপনা ও
সংবাদ পাঠকের গম্ভীর
ঘোষণায় নিজের চেহারা বা
মেজাজ নিয়ে অনিশ্চিত
হয়ে পড়েছে। যেমন একটা
এফ এম স্টেশনে একজন
পুরুষ রেডিও-জকি গলায়
তরল রমণী-মোহন সুরের
গমক তুলতে তুলতে বললেন
‘উম্ম্...বর্ষার এই
উদাসী রিমিঝিমি
সন্ধ্যায় কী গান শোনাবো
আপনাদের? এক্ষুনি এস এম
এস করে জানান আমাকে।’
আবার ঐ একই রেডিও
স্টেশনে কিছুক্ষণ পর
রাশভারী সংবাদ পাঠক
মেঘ-স্বরে বললেন-
‘…এদিকে তুমুল
বৃষ্টিতে জনজীবন
বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে
তীব্র আকার ধারণ করেছে
যানজট।’
তবে জয়ন্তদের বিল্ডিং
এর সামনের রাস্তাটায়
বেশ একটা উৎসব উৎসব
আমেজ তৈরি হয়েছে-
গোড়ালি-ডোবা রাস্তাটায়
বৃষ্টি-জলের ঘোলা
ফোয়ারা তুলে ছপ ছপ করে
ছুটতে ছুটতে দু’টো
রিকশা প্রতিযোগে নামে:
ট্রিন ট্রিন ট্রিন বেল
বাজাতে বাজাতে একটা
আরেকটাকে পেছনে ফেলে
বৃষ্টি-বাতাসের আবরণ
ফুটো করে রাস্তার শেষ
মাথায় ছুটে যায়। দু’টো
ন্যাংটো বাচ্চা ছেলে
মুখ দিয়ে 'পর্র্র্'
শব্দ করে বাড়ির সামনের
রাস্তা-লাগোয়া
ড্রেনটার পাশ দিয়ে
এলোপাথাড়ি দৌড়াতে
থাকে। দৃশ্য দু’টো কয়েক
সেকেন্ডের বিরতিতে
জয়ন্ত’র লেখার
টেবিল-লাগোয়া জানালার
ফ্রেম কেটে বেরিয়ে
যায়।
এদিকে অপর্ণা ও সৃজন আজ
রাতে ফিরতে পারবে না
জানাতে একটু আগে ফোন
করেছিলো।
ফোনে বাবা’র সাথে ওদের
কথা হওয়ার সময় স্পিকার
চালু থাকায় জয়ন্ত শুনলো
ওর মা বলছেন ‘কী করে আসি
বলো তো! এই শহরে এমন
গলা-ডোবা বৃষ্টি বাপের
জন্মে দেখিনি...’।
অপর্ণার কথাগুলো যেন
অনেকদিন পর প্রিয় মাছের
ঝোল দিয়ে ভাত খাওয়ার
সময় লালায় আটকে আটকে
আহ্লাদী কসরতে বেরিয়ে
আসছিলো। তবে এই আনন্দকে
আড়াল করার একটা সচেতন
চেষ্টা ছিলো তার।
ওদিকে সৃজনের গলায়
ফুটছিলো বয়ঃসন্ধির চপল
রং। তবে মায়ের সাথে তার
পার্থক্য হলো এই
হঠাৎ-পাওয়া আনন্দকে সে
লুকানোর কোন চেষ্টা
করছে না একেবারেই। সে
জানে আজ বাড়িতে ফেরা
মানেই বিরক্তিকর
কোয়েশ্চেন পেপার সলভ
করা। ফোনে সে বাবাকে
বলছিলো ‘একেবারে
ক্যাট্স-ডগ্স-টাইগার
স-লায়ন্স বৃষ্টি
ড্যাড...ইট্’স অসাম।
অরিত্রদের বাসার
সামনে…লাইক নি-ডিপ রেইন
ওয়াটার জমে গেছে। আজ
রাতে তো বের হতেই পারবো
না...।’ কোন রকম বাধা
আসার আগেই আগাম
প্রতিরোধের বাক্যটাও
তৈরি ছিলো সৃজনের-‘এই
বৃষ্টিতে ভিজলে আই উইল
ডেফিনিটলি ক্যাচ আ
কোল্ড...সো ড্যাড
প্লিজ...’
কথাগুলো বাড়িয়ে বলা নয়
একটুও। সৃজনের মাসি ও
অরিত্র দু’জনের বাসার
সামনেই একটা ছোটখাটো
হাতিরঝিল জলাধার তৈরি
হয়ে গেছে। গাড়ি তো গাড়ি,
রিকশার শরীরও অর্ধেকের
বেশি অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে
রাস্তায় জমে যাওয়া এই
দুধ-চা পানিতে।
এই উৎসব-মুখরতা জয়ন্তকে
স্পর্শ করে না একটুও।
সে গভীর রাত পর্যন্ত
বারান্দায় থম ধরে বসে
থেকে থেকে একটানা
বর্ষণের শব্দ ও
সারাদিনের ক্লান্তির
যুগলবন্দীতে একসময় ইজি
চেয়ারেই ঘুমিয়ে পড়ে।
প্রায় শেষ রাতে ওর ঘুম
ভাঙে চিন্তা মাছের
লেজের বাড়িতে-
‘এই যে ওঠো। তোমার
গল্প-টুকরোটাকে পাওয়া
গেছে।’
অস্পষ্ট গোঙানির মতো
শব্দ করে চেয়ারের হাতল
থেকে মাথা তোলে জয়ন্ত।
লাল চোখে শোনে
চিন্তা-মাছের কথা।
রাত প্রায় তিনটা।
চিন্তা-মাছ যে জায়গার
কথা বলছে সেটা শহরের
শেষ প্রান্তে। রাত শেষ
হতে এখনো প্রায় ঘন্টা
দু’য়েক বাকি। সেটা
সমস্যা না। সমস্যা হলো
এই কয়েক ঘন্টা আগেও
বৃষ্টি’র পানিতে থৈ থৈ
করছিলো গোটা শহর। এখনো
যদি তাই থাকে কী করে
পৌঁছুবে ওখানে? তবু
বাক্যটাকে উদ্ধার করতে
তাকে যেতেই হবে। গাড়ি
না গেলে প্রয়োজনে হেঁটে
যাবে। তৈরি হয়ে,
ড্রাইভার-দারোয়ানকে
ডেকে তুলে গাড়ি বের করে
জয়ন্ত দেখলো বৃষ্টির
পানি নেমে গেছে
অনেকটাই। বাড়িটাও
খুঁজে পাওয়া গেলো খুব
সহজেই। বাড়ি বলতে একটা
কানা গলি’র ভেতর এঁদো
নর্দমা’র পাশে একটা
ছোট্ট টিনের ঘর। ভেতরে
জ্বলতে থাকা এনার্জি
বাল্বের মিটমিটে সাদা
আলো দরজার ফাঁক গলে
রাস্তায় এসে পড়ছে।
‘আপনাকে এক কাপ রং চা এর
বেশি কিছু দিতে পারবো
না। দুঃখিত।’ জয়ন্তকে
বল্লেন ঐ ঘরের একমাত্র
বাসিন্দা। তিনি একজন
গদ্যশিল্পী। নাম গওহর
বৈদ্য।
‘না না আপনি ব্যস্ত
হবেন না। আমি কিছু খাবো
না। আমি আসলে আপনার
কাছে এসেছিলাম একটা
কাজে…’
‘হ্যাঁ, বলুন’
‘আমার নাম জয়ন্ত
ব্যানার্জী। টুকটাক
লেখালেখির চেষ্টা করি।
কাল রাতে আমার একটা
গল্প-টুকরো হারিয়ে
গেছে। ইন ফ্যাক্ট ওটা
আমার প্রথম গল্পের
প্রথম বাক্য। আজ
সারাদিন পুরো শহর চষে
বেড়িয়েছি কিন্তু খুঁজে
পাইনি বাক্যটাকে। এরপর
জানলাম যে ওটা আপনার
কাছে আছে। কিছু মনে না
করলে ওটা যদি কাইন্ডলি
একটু ফেরত দিতেন! আমি
তাহলে আমার গল্পটা
এগিয়ে নিতে পারতাম।
প্রথম বাক্যটার জন্য
বাকি বাক্যগুলো আটকে
গেছে মাঝপথে।’
‘কোন বাক্যটা বলেন তো
ভাই!’
জয়ন্ত বললো।
‘ও ঐটা! কিন্তু ঐটা তো
ভাই আমি আপনার কাছ থেকে
আনিনি। কাল রাতে
বৃষ্টি’র পর বাক্যটাকে
আমি আমার বাড়ি’র
সামনে’র ডুবে যাওয়া
রাস্তাটায় খুঁজে
পেয়েছি। আরেকটু হলেই
নালায় পড়ে যেতো।’
এরপর দীর্ঘ আলাপচারিতা
দুই লেখকের মধ্যে।
শেষমেশ গওহর বৈদ্য যা
বললেন তা এরকম:
‘এই বাক্যে আমার বহু
বছরের অভিজ্ঞতার
নির্যাস পোরা আছে।
শুধুমাত্র এরকম একটি
বাক্যের অপেক্ষায় আমি
দু’বছর কিছু লিখিনি। আর
আপনি মাত্র লেখা শুরু
করেছেন। এরকম একটি
বাক্য লিখতে আপনার আরও
অন্তত: কয়েক বছর বা
নিদেনপক্ষে কয়েক মাস
অপেক্ষা করা উচিৎ।’
জয়ন্ত তাকে অনেক
বোঝানোর চেষ্টা করে যে
কেউ কেউ পাঁচ বছরে যে
মানের লেখা লিখতে পারে
অন্য কেউ হয়তো পাঁচ
মাসেই সেটা পারতে পারে।
সৃষ্টিশীলতার
ক্ষেত্রে সময়ের এমন
সরলীকরণ চলে না। সতেরো
বছর থেকে লিখতে শুরু
করে পুরো অর্ধ দশক
লিখেও তেমন কিছুই
সৃষ্টি করতে পারেন নি
এরকম লেখক যেমন আছেন,
তিপ্পান্ন বছর বয়সে
প্রথম প্রকাশিত হয়ে
অমরত্ব লাভ করেছেন এমন
লেখকও আছেন। দূরে যাবার
দরকার নেই-খোদ বাংলা
সাহিত্যেই এই দু’রকম
লেখকই আছেন।
কিন্তু গওহর বৈদ্য যেন
সব বুঝেও এসবে কর্ণপাত
করার পাত্র নন। তিনি
তার মতেই স্থির থাকে
বলে গেলেন-
‘তিল তিল করে যে
বাক্যের রসদ আমি খুঁজে
নিয়েছি আমার যাপিত জীবন
থেকে তা শুধু আপনি
প্রথম লিখেছেন বলে আমার
কাছ থেকে ছিনতাই করে
নিয়ে যেতে পারেন না। এই
বাক্যের উপর আমার দাবি
আপনার চেয়ে অনেক বেশি।
এরকম বাক্যের জন্য তথা
লেখালেখি’র জন্য আমি
অনেক ত্যাগ স্বীকার
করেছি। চাকরি ছেড়েছি,
বিয়ে করিনি, বছরের পর
বছর থেকেছি এবং এখনো
থাকছি বস্তি’র মতো এই
ঘরে। আর আপনি কী ত্যাগ
করেছেন শুনি! যদি
সত্যিই আপনার লেখার
ক্ষমতা থাকে এরকম
আরেকটা বাক্য লিখুন ও
ওটার কপিরাইট নিজের
নামে করে নিন। বাড়ি বয়ে
এসে বাক্য ফেরত চাইবেন
না দয়া করে। কিন্তু আমি
জানি আপনি সেটা পারবেন
না। তাই কোনরকমে একটা
বাক্য লিখে সেটা হারিয়ে
ফেলে পাগলের মতো এতো
রাতে ছুটে এসেছেন আমার
কাছে। লেখালেখি অতো সহজ
নয়, বুঝলেন স্যার! নিজের
একটা স্টাইল খুঁজে পেতে
অপেক্ষা করতে হয় বছরের
পর বছর।’
বাক্যটা উদ্ধারে
ব্যর্থ হয়ে গওহর
বৈদ্য’র বাড়ি থেকে বের
হয়ে জয়ন্ত দেখে আকাশ
ফর্শা হতে শুরু করেছে।
ভোরবেলা রাস্তা ফাঁকা
পেয়ে জয়ন্ত’র গাড়িটা
সকালের ফুর ফুর বাতাসের
ঠান্ডা-ভেজা শরীর ছিদ্র
করে ছুটে চলেছে। ওর মুখ
দেখে মনে হচ্ছে যে ও
বুঝে উঠতে চায় যে ও কি
বাক্য-ছিনতাইয়ের শিকার
না-কি ও নিজেই
বাক্য-ছিনতাইকারী। তবে
গওহর বৈদ্য’র বলা
‘অপেক্ষা’ শব্দটা ওর
খুব ভেতরে কোথাও ধাক্কা
দিয়েছে।
এখন কি তাহলে শুধুই
অপেক্ষা?
ওর রাত-জাগা চোখ দু’টো
আস্তে আস্তে মুদে আসতে
চায়। ওদের অপেক্ষা এখন
শুধুই একটা মখমল
বিছানা’র।