ঠিক জিনিসটা যে
কি আজ অবধি ঠিকঠাক বুঝে
উঠতে পারলাম না , তো ভুল
নিয়ে ভুলভুলাইয়ায় পথ
হারানো বাদ দিয়ে আর কিই
বা করতে পারি ! অগত্যা
বিষয় খুঁজতে থাকি।
নাছোড় সম্পাদকের সঙ্গে
বেশ একপ্রস্থ ঝগড়াও হয়ে
যায়।
--- কে বলে দিল কোনটা ভুল
আর কোনটাই বা ঠিক ?
--- কেন , তুই বুঝি কোন ভুল
কাজ করিস না জীবনে ?
--- সর্বনাশ ! আমি যা
ভুলভাল কাজ করি সেগুলো
তো আমি ঠিক ভেবেই করি।
লোকজন ভুল ভাবলে তার
দায় আমার নিতে বয়েই
গেছে। আর ভুল মানে ঠিক
কি বলতে চাইছ ? ভ্রম,
ভ্রান্তি নাকি
অসাবধনতা জনিত
দূর্ঘটনা?
---- উফফ্ ! বিরক্ত না করে
পাশ্চাত্যের
সাহিত্যকদের জীবন নিয়ে
লেখ না কিছু।
---- আচ্ছা সাহিত্যিকদের
জীবনের ভুল মানে কি ?
অমুকে কেন কবিতা না
লিখে গল্প লিখছে বা উনি
কেন একই কথা বারবার
লেখার ভুল
করছেন ... এই জাতীয় কিছু?
তো সেটা যদি ওনারা নিজে
ভুল বলে মনে না করেন আমি
বলার কে বাপু ? আমি কোন
জাজমেন্ট দিতে পারবো
না। ধরো কেন ভার্জিনিয়া
উলফ পকেট ভর্তি নুড়ি
কুড়িয়ে হেঁটে হেঁটে
জলের ভিতর নেমে গেলেন ,
বা সিলভিয়া প্লাথ কেন
গ্যাসের বার্ণারে
নিজের মুখ ঢুকিয়ে
দেওয়ার ভুল করলেন... ?
কেনই বা ও’হেনরি
ব্যাঙ্ক তছরুপের
তদন্তের ভয়ে আত্মগোপন
করে থাকলেন ...! এইসব ? তো
এগুলো ভুল কে বললো?
---- তাহলে যা খুশি কর।
কিন্তু লেখাটা দে।
ভুল খুঁজতে
থাকি। আর এই কাজটা আমার
মোটেই ভালো লাগেনা। যে
কারনে পরীক্ষার খাতা
দেখার সময় তিনআনা ভুলের
পাশে একআনা ঠিক দেখলে
নম্বর দিয়ে ফেলি। যদি “
ভুল ” কথাটিকে
সম্প্রসারিত করে দেখি
তাহলে হয়ত এই বন্ধনীর
মধ্যে সেই বিষয়গুলিও
চলে আসবে যাদের বলি “
অনৈতিক ” , বলি “ অপরাধ
”,
“ অমানবিক ” , “ অন্যায় ”
ইত্যাদি ইত্যাদি। এই
সমস্ত বন্ধনীকৃত
বিষয়গুলিই আসলে একটা
প্রেক্ষিতে ভুল হিসেবে
মান্য । যদি সত্যি বলে
সত্যি কিছু থেকে থাকে।
নির্দিষ্ট সামাজিক ,
সাংস্কৃতিক , মানসিক,
অর্থনৈতিক পরিবেশে ,
নির্দিষ্ট এক
স্থানিকতায় ও কালের
সীমায়
গ্রাহ্য । ঠিক – ভুল ,
সাদা – কালো , সভ্য -
অসভ্য ইত্যাদি
( “ লাল-সবুজ”
পশ্চিমবঙ্গের বাইরে আর
কোথাও এই তালিকাভুক্ত
নয় অবশ্য ) binary - বিপরীত এর
প্রবণতায় একটি আরেকটি
চলরাশির ভূমিকা নেয়
না। উপরন্তু একটির
উপস্থিতি আরেকটিকে
টিঁকিয়ে রাখে । এই
ধারণাগুলো বিনির্মাণ
করতে থাকলে পৌঁছনো যায়
একটা কেন্দ্রের
দিকে , একটা
পুর্বনির্ধারিত ধারণা ,
আদর্শ বা আইডিয়াল একটা
স্থির বিন্দুর দিকে ...
ঈশ্বর বনে যাওয়া একটা
অস্তিত্বের দিকে । ফুকো
, দেরিদা , গ্যেডামার
কথিত কেন্দ্র ও
প্রান্তিকতার
তত্ত্বের দিকে ।
কেন্দ্রে সেই ক্ষমতা
জড়ো হয় যা ক্রমশঃ
প্রান্তকে অস্বীকার
করতে করতে তাকে ‘ অপর ’
করে তোলে। binary opposite এর
যুগলগুলির একটি সদস্য
তাই ধারণাগত ভাবে
নিজেকে জাস্টিফাই
করতেই থাকে । কেন্দ্র
তাই ঠিক , প্রান্ত ভুল।
এটাই প্রচলিত ও
প্রতিষ্ঠিত “ সত্য ”
হয়ে ওঠে। আমাদের দেখাটা
নির্দিষ্ট করে তোলে।
কিন্তু আসল কথা হলো “
কিভাবে দেখছি ”, “ কি
দেখছি’টা ততটা নয়
কিন্তু । এই দেখা বা
দৃষ্টিভঙ্গীর
বিভিন্নতাই ভুল প্রমাণ
করে সাহিত্যে বিভিন্ন
সময়ের নানা আন্দোলন ,
নানা তত্ত্ব ও ইজ্ম।
একেক সময় একেক
প্রেক্ষিতে একেক
দৃষ্টিভঙ্গি সগর্বে
প্রচলিত ধারনা ও রীতিকে
“ভুল” প্রমাণ করে।
গভীরে প্রোথিত
কালচারাল বা
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সময়
বিশেষে ও সভ্যতা বিশেষে
ভুল বলে নস্যাৎ করে
দিতেই পারে প্রতিষ্ঠিত
হাইপোথিসিস । কখনো “
দ্য কিং ইজ্ ডেড ”, কখনো
“ গড ইজ্ ডেড ”, তো কখনো
“ অথর ইজ ডেড ”। বদলে
বদলে যায় ভাষ্য ।
---- লেখাটা এগোলো ?
সম্পাদক মশাইয়ের ফোন ।
---- নাহ্। আমি অপারগ।
---- কি আশ্চর্য ! তোর
আশেপাশে লোকজনের জীবনে
দ্যাখ না
উঁকি মেরে ।
---- বলো কি ? অধিকারভঙ্গের
নোটিস ধরাবে তো এবার !
--- আরে তুই কি আর বুঝতে
দিবি ? কায়দা করে ধর
ব্যাপারটা।
----- দূর...!
---- বেশ , দূর হলাম।
কিন্তু লেখাটা দে মা
জননী!
সে তো দেবো , ওদিকে ,
ছেলে হুমড়ি খেয়ে জানতে
চাইছে ...আচ্ছা ভূগোলের
নতুন চ্যাপ্টারটা একটু
বুঝিয়ে দেবে মা ? আমি মনে
মনে ডিকনস্ট্রাক্ট
করছি... “ ভূগোল ” এর
মধ্যেই তো দেখছি একটা
আস্ত
“ ভুল ” লুকিয়ে আছে ।
অবিশ্যি বানানটা একটু
আলাদা । ---কি যে ভুলভাল
বকছো তুমি মা ! উফফ্ -
কিন্তু ব্যাপারটা
মোটেই ভুলভাল না । এই
স্থান , কাল , স্থানিক
সময় এগুলো দেখার
ভঙ্গীটা একেক যুগে
আগেরটাকে ভুল প্রমাণ
করেই এগিয়েছে। সাহিত্য,
চিত্রকলা বা অন্যসব
আর্টফর্মেই এই প্রভাব
দেখা যায় একদম সভ্যতার
প্রতিটি স্তরেই।
পাশ্চাত্য সমাজে এই
টাইম স্পেস বা সময় ও
স্থান কিভাবে একে
অন্যকে ভুল বলেছে যদি
খুঁজে দেখা যায় ( যদিও এই
অনুসন্ধান সংহত ভাবে
একটা নির্দিষ্ট
সাংস্কৃতিক
বিশ্ববীক্ষা বা
ওয়ার্ল্ড ভিউ বলা যায় ,
এর প্রকাশের ভিন্নতাকে
মান্যতা দিয়েই ) , তাহলে
দেখি সামন্ততান্ত্রিক
যুগে প্রভু ও তার
প্রাসাদকে কেন্দ্রে
রেখে পরিপার্শ্বের
পরিধিটিকে ধরা হয়েছে ।
ঈশ্বরের প্রতিভূ ( যে
ঈশ্বর আবার মহাবিশ্বের
প্রতিফলক ) এই প্রভুর
বন্দনাগান আর নানা
অপদেবতা ও তার সঙ্গীদের
বর্ণনাই ছিলো পৌরাণিক
কথা ও লোককথার বিষয় ।
এটাই ঠিক ও ধ্রুপদী বলে
মান্যতা পেত । মধ্যযুগে
মনে করা হলো এই বর্ণনা
হবে আরো
ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ।
নিটোল আঁকা একখানা ছবির
মত । ঠিক যেন ওপর থেকে
পাখির চোখে দেখা পৃথিবী
। স্বয়ং ঈশ্বর ওপরে বসে
দেখলে নাকি যেরকম
দেখবেন এই পৃথিবীটা ,
সেই প্রেক্ষিত থেকে
প্রকাশটাই পেল
মান্যতা । তারপর “
নবজাগরণ ” মহাসমারোহে
এসে এই সমস্তই
“ ভুল ” বলে ছুঁড়ে ফেলে
এই প্রথম ঘোষনা করলো
ব্যক্তি মানুষের
প্রেক্ষিত। অর্থাৎ
ঈশ্বর ওপরে বসে কি
দেখলেন সেটা নয় ,
মানুষের কথা বলাটাই এক
ও একমাত্র সঠিক বিষয় ।
ততদিনে টলেমির
মানচিত্র অঙ্কন পদ্ধতি
জ্যামিতিক গ্রিড বিষয়ে
ধারনা হঠাৎ গোটা
পৃথিবীটা কে হাতের
মুঠোয় এনে দিয়েছে । এই
নতুন বিস্তৃত
“স্পেস”এর ধারনা
নিজেকে স্পর্ধিত
ঘোষনায় প্রতিষ্ঠা করার
সাথে সাথে আর একটা নতুন
কেন্দ্র গরে তুলতে
লাগলো। অষ্টাদশ শতকের
নিউটনীয় “ স্পেস ” এর
ধারনায় তার অপরাজেয়
ভাবমূর্তি ভেঙে টুকরো
করে ঐশ্বরিক মহিমার
অনন্ত চেতনাকে
চ্যালেঞ্জ জানালো । একই
সাথে সময়ের ধারনাও হয়ে
উঠলো স্থানের মতই
একরৈখিক --- অতীত থেকে
ভবিষ্যৎ অবধি একই সুতোয়
। তারপর আধুনিক যুগ ভুল
ঘোষণা করলো এই একরৈখিক
ধারনাটিকেই । সামাজিক ও
অর্থনৈতিক সময়
মিলেমিশে একাকার হয়ে
গেল। পৃথিবীর
একপ্রান্তের সংকট
এতদিনে হয়ে উঠেছে সমস্ত
পৃথিবীর সংকট ।
আইনস্টাইনের
রিলেটিভিটি তত্ত্ব সময়
ও স্থানের ধারনাটিকেই
বদলে দিয়েছে ততদিনে ।
এই পরস্পর মিলেমিশে
থাকা বহুমাত্রিক সময়টি
বদলে দিলো আর্ট-ফর্মের
প্রকাশ ভঙ্গী । পুরোনো
কে ভুল প্রমান করে
নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে
নিলো যৌক্তিকভাবেই ।
ভুগোলোক সংকুচিত হতে
হতে ক্রমশই আরো আরো
খন্ড মান্যতা পেতে
থাকলো । আর উত্তর -
আধুনিকতা ভুল ঘোষণা
করলো বিষয়ের
কেন্দ্রিকতাকেই । “
এটাই ঠিক ” বা “ এটাই ভুল
” এই ধারনার বাইরে
দাঁড়িয়ে খুঁজে পেতে
চাইলো “ধূসর” বলয়টিকে।
বাইনারী অপোজিট এর
বাইরে দাঁড়ানো
মাঝখানটিকে এক -- না দিন ,
না রাত্রির
সন্ধ্যাকালে খুঁজে এনে
দিতে চাইলো আধুনিকতার “
কিন্তু সবার চাইতে ভালো
পাঁউরুটি আর ঝোলা গুড় ”
ঘোষণা টপকে ।
কিন্তু উত্তর - আধুনিক
পেরিয়েও আমরা আপাতত এক
“ বিয়ন্ড-থিওরি ” যুগের
মুখোমুখি । যেখানে
পারস্পেকটিভ ভাবতে
শেখায় আসলে আমরা অন্ধের
হস্তিদর্শণের মত করেই
দেখি । নিজের নিজের
জায়গায় ঠিক ও নির্ভুল ।
থিওরি দিয়ে কিছু ভুল
প্রমাণ করা যায়না , বরং
পারস্পেকটিভ বদলের
সাথে সাথে কিভাবে বাঁক
ঘুরে যায় ইতিহাস ও
দর্শণের সেটা হৃদয়ঙ্গম
করাটা জরুরি । হঠাৎ ঠিক -
ভুলের হিসেব গুলিয়ে
দেওয়া একটা মজার
কথোপকথন মনে পড়লো । জি .
সি. থর্নলের লেখা সেই
বহুপঠিত নাট্যাংশ
যেখানে “ রাইট ” আর “ রং
”এর ধারনা নিয়ে প্রবল
হাস্যরস সৃষ্টির সাথে
সাথে থমকে দেওয়াও আছে।
ইংল্যান্ডের এক শহরে
একজন ট্রাফিক পুলিশ এক
ব্যক্তির গাড়ি থামিয়ে
বলে --- আপনি, রাইট সাইডে
গাড়ি চালাচ্ছেন।
ব্যক্তিটি অবাক হয়ে
জানতে চান --- তাহলে আমি
কি রং সাইডে গাড়ি
চালাবো ? পুলিশমশাই
বলেন , --- আপনি তো রঙ
সাইডেই আছেন । ---- কী
আশ্চর্য ! এইমাত্র
বললেন আমি নাকি রাইট
সাইডে
আছি ! --- আজ্ঞে হ্যাঁ ,
ইংল্যন্ডে রাইট সাইড
টাই রঙ সাইড । ---- ওহ
আচ্ছা , তার মানে আয়নার
মত , তাই তো ? মানে আমি
যেটা রাইট ভাবছি সেটা
আসলে রঙ ? ---- ঠিক তাই । ----
হুম্ম ... বেশ তাহলে
আমাকে এবার বলুন আমি
ওমুক জায়গায় যাবো ... তা
কোনদিন দিয়ে যাবো ?
----ওই সামনে গিয়ে
বামদিকে যান। ------
বুঝেছেন --- খুব বুঝেছি ,
অর্থাৎ যেহেতু এখানে সব
উলটো , তাই আমাকে আসলে
রাইট দিকে যেতে হবে ?
অ্যাম আই রাইট ? --- right
কথাটির পান এর সুযোগ
নিয়ে কি মারাত্মকভাবে
সব গুলিয়ে দেওয়ার খেলা !
আমার বলার “ ঠিক ” আর
তোমার বোঝার “ ঠিক ”
হয়তো আদপেই এক নয় …তবু
কথোপকথন এগোচ্ছেই , আর
ঠিক কখন যে ভুল হয়ে উঠছে
, ভুলটা ঠিক … বুঝতেই
পারছিনা ।
নাহ্ ... ঠিক - ভুল
কাটাকুটির খেলায় সব
শেষে দেখি হাতে রইল
পেন্সিল ! আবার সব
ভুলভাল হয়ে গেল ।
সম্পাদক মশাইকে জানানো
যাক ---লেখাটা হলো না । এই
বিষয়ের জন্য আমি সঠিক
ভাবেই একজন ভুল লোক !
দুঃখিত !