এই দীর্ঘ জীবনে যেন
একটিমাত্র বন্ধু থাকে
তার ছয়টি ব্যবহারে
বদল হয় ঋতু
সে ফিরে আসবে—এইটুকু
শব্দে
কেটে যায় অর্ধেক জীবন
আর বাকি অর্ধেক
‘আমি ভালো আছি’—শুধু
এইটুকু
নিজেকে বোঝাতে
এই কয়েকটা শব্দ, কয়েকটা
পঙ্ক্তি, লিখতে হয়েছিল
কোনও সময়। সেই
২০০৬-২০০৭ সালে। কেন
লিখেছিলাম, তা না-লেখা
সময়রা জানে। কারণ তারা
আরও বেশি তেজস্ক্রিয়,
অনেক বেশি ভেদ্য, লিখিত
সময়গুলোর থেকে।
ছোটবেলায় এক-একটা বিকেল
আসত আমাকে বন্দি রেখে।
তখন কিন্ডারগার্টেন,
অথচ বিকেল হলেই আসতেন
গৃহশিক্ষক, আর
বিকেলগুলো বইয়ের পাতায়,
অক্ষরে, শব্দে, সংখ্যায়
দ্বিমাত্রিক
নির্জীবতায় ভরে থাকত।
পড়া শেষে যখন বাড়ির
পাশের মাঠে এসে
দাঁড়াতাম, দেখতাম
গোধূলির ছড়ানো রক্তের
ওপর বিকেলের খোলস ভেসে
আছে। বিকেল নেই। নেই
কোনও বন্ধু, সাথী।
তাদের কলরব
ক্রীড়ামুখরতা—যা
শুনতে পেতাম পড়তে
পড়তে—তাও মিলিয়ে গেছে
দিনের শেষ বাতাসে,
সামান্য আঁশটুকুও পড়ে
নেই। কান্না পেত। একা
একা দাঁড়িয়ে মেঘ
দেখতাম, সাঁঝের মেঘ,
দেখতাম মেঘের রং
পালটানো, চোখ বন্ধ করে
সেই রঙিন মেঘেদের শরীরে
ছিটিয়ে দিতাম আমার গোপন
অশ্রু, আর খুব খুউব ফিরে
পেতে চাইতাম সেই
বিকেলদের।
না। সেই বিকেলরা কখনও
ফিরে আসেনি। এসেছিল
আমার থেকে কিছু বড় একটি
ছেলে, আর আমাকে বলেছিল
লেখার কথা, বলেছিল এক
পৃথিবী লিখতে।
জানিয়েছিল এমন এক কবির
কথা যিনি এই পৃথিবীতে
হাজার বছর ধরে হাঁটতে
পারেন, যিনি হাতে তুলে
দেখেছেন চাষার লাঙল,
কাস্তে হাতে মাঠে
গেছেন, মেছোদের মতো নদী
ঘাটে ঘুরেছেন, আবার
‘বোধ’ নামে না-জানি
কাকে মড়ার খুলির মতো
ধরে আছাড় মারতে
চেয়েছেন। তখন আমি ষষ্ঠ
শ্রেণি, আর সে সম্ভবত
দশম। এক গোপন খাতা বের
করে সে দেখাতো হিজিবিজি
লেখা, যার বেশিরভাগই
আমার বোধগম্য ছিল না,
অথচ পড়লে কেমন একটা ঘোর
লেগে যেত। সে বলত, এসব
কাউকে দেখাতে নেই, কিছু
জিনিস থাকে শুধুমাত্র
নিজের জন্য, আর কাউকেই
ভাগ দেওয়া যায় না।
তাহলে আমাকে দেখালে
কেন? এই সরল প্রশ্নের
উত্তরে সে হেসে বলেছিল,
আমি জানি তুইও একদিন
আমার মত একটা খাতা তৈরি
করবি আর একা একা এইরকম
পাগলামি লিখে রাখবি।
তারপর সে মাধ্যমিক দিয়ে
চলে গেল দূরের কোন নামি
স্কুলে, আর সেই
বিকেলগুলোর মতো হারিয়ে
গেল।
মানুষ হারিয়ে গেলে পড়ে
থাকে তার স্মৃতি। আর,
কোনোদিন সে ফিরে আসবে—
এরকম একটা অসচ্ছল,
ক্ষীণ আশা। আর এই
অপেক্ষা বুকে নিয়ে,
মস্তিষ্কে নিয়ে আমাদের
বয়স বাড়ে, প্রিয় মুখ
পালটে পালটে যায়,
চাহিদায়, প্রয়োজনে,
ভালোবাসার রকমফেরে।
এভাবেই ‘বড়’ হতে থাকি
আর একা হতে থাকি। সেই
একাকিত্বের সেতু বেয়ে
কখন যে এসেছে কবিতা,
আমিও লিখতে শুরু করেছি
হিজিবিজি, তা যখন টের
পাই, অনেক দেরি হয়ে
গেছে। ভেতরে ভেতরে এমন
এক উচাটন তৈরি হয়েছে যা
আমাকে দিয়ে লিখিয়ে
নেবেই, না লিখে উপায় নেই,
মড়ার খুলির মতো ধরে
আছাড় মারতে চাইলেও সে
নাছোড়, কোনও পরিত্রাণ
নেই। আমার কলকাতার
মেসজীবন, কেটে চলে
এভাবেই। বোধহয়
একেবারেই ভুলে যাই সেই
মেধাবী দাদাকে, কিংবা
কখনও অবসরে মনে আসে তার
কথা, মনে পড়ে তার
ভবিষ্যৎ বাণী যা হুবহু
মিলে গেছে। বাড়ি এলে
কখনও-সখনও খোঁজখবর
নেওয়ার চেষ্টা করি তার।
পাড়ার কেউই জানে না তার
কথা, তার পরিবারের কথা,
আমাদের পাড়া থেকে উঠে
তারা কোথায় গেছে।
অবশেষে একদিন শেষ হয়
আমার মেসজীবন, চাকরি
পেয়ে কলকাতা ছেড়ে ফিরে
আসি নিজের বাড়ি, বন্ধু
পালটায়, জীবন পালটায়,
সময়ও পালটায়—হয়তো বা
পালটায় মুখ, পালটায়
মুখের হাসি। কিন্তু
লেখা থেকে আমার
নিবৃত্তি নেই, নিবৃত্তি
নেই হিজিবিজি লেখা
থেকে। এভাবে একদিন
সন্ধেবেলা একা একা শহর
সংলগ্ন এক ফাঁকা চায়ের
দোকানে বসে চা খেতে
খেতে দেখি এক ধূলি ধূসর
মানুষকে। সারামুখ
শ্মশ্রু আবৃত,
অবিন্যস্ত মাথাভর্তি
স্নানহীন দীর্ঘ
কেশরাশি পিঠ অবধি,
কোমরে লুঙির মতো করে
সাদা মলিন ধুতি, পায়ে
চপ্পল, গায়ে মলিন ফতুয়া
নিয়ে মেদবহুল একজন
মানুষ তাকিয়ে আছে আমার
দিকে। আমার চোখে চোখ
রেখে মৃদু হাসে, চিনতে
পারছিস? আমি স্মৃতি
হাতড়াই, কূল পাই না। সে
কাছে এসে ঠোঁটে হাসি
ঝুলিয়ে বলে, আমাকে লেখা
শোনাবি না? আমি চমকে উঠি,
মাথা টলে যায়। তার মুখ
থেকে দেশি মদের কটু
গন্ধে বাতাস ভারী হয়।
বাপ্পাদা! আমার ঠোঁট
কেঁপে ওঠে। দেখি সে
অবিন্যস্ত টলমল পায়ে
বলে, আজ তোর কবিতা শুনব,
সারা গায়ে কবিতা মাখব।
তড়িতাহত আমি জিজ্ঞেস
করি, বাপ্পাদা, তুমি
কোথায় থাক, কী করো, তুমি
আর কবিতা লেখ না?
বাপ্পাদা, হাসাতে হাসতে
বলে, না লিখি না, সব তোকে
দিয়ে দিয়েছি, সঅঅব। তুই
জানিস না রাজা, তোর
সমস্ত কবিতার ভেতরে আমি
আছি।
আমি বাক্যহীন,
জ্বরগ্রস্ত বাড়ি ফিরে
আসি, আর ভাবি, যে
মানুষটাকে কত খুঁজেছি,
পাইনি। শুধু তার ছোঁয়াচ
লেগে আমিও কবিতা লিখতে
বাধ্য হলাম, বাধ্য হলাম
এক নাছোড়, কষ্টদায়ক
যাপনকে মেনে নিতে। এমন
কত বিনিদ্র রাত গেছে
যখন ঠিক করেছি আর কখনও
কবিতা লিখবো না, মাথার
মধ্যে অহরহ এই
শব্দস্রোত আর নিতে
পারছি না, নিজেকে পাগল
পাগল লাগছে, সেইসব সময়ে
মনে মনে বলেছি,
বাপ্পাদা তুমি কোথায়?
ফিরিয়ে নাও তোমার
অভিশাপ, আমি কবি হতে চাই
না, লিখতে চাই না একটাও
কবিতা! সে আসেনি। আর আজ
যে ফিরে এল সেও তো সেই
বাপ্পাদা নয়, নয় আমার
দেখা প্রথম কবি? তাহলে
কি কেউই ফিরে আসে না? এই
সময় যেমন সোজা যেতে
যেতে হঠাৎ একটা লুপ
তৈরি করে আবার পাড়ি দেয়
নিজের পথে, আর আমরা সেই
লুপের ভেতর পড়ে ভাবি
এসবই যেন আগেও ঘটেছে,
তাহলে কি ফিরে পেলাম
অতীতের সামান্য
ভগ্নাংশ? তেমনই কোনও
মানুষ একবার হারিয়ে
গেলে, হয়তো, আর কখনও ফিরে
আসে না, আসে অন্য কেউ,
একই নামে, একই
কণ্ঠস্বরে, স্মৃতি
নিয়ে; আর যার কাছে আসে
সেও হয়তো তখন বিগত
আমিকে হারাতে হারাতে
অন্য কেউ, একই নামে একই
স্বভাবে, পড়ে থাকে সেই
পুরোনো আমির ছেড়ে যাওয়া
খোলস।