প্রায়ই চোখে পড়তো
রাস্তাটা। ছোট এক চিলতে
একলা পথ। দেখতে শহরের
অন্য আট-দশটা নিরিবিলি
মাঝারি গলির মতোই,
যেগুলো কীনা ব্যস্ত বড়
রাস্তার পাশ কেটে
বেরিয়ে যায়, এবং
একেকটা আধা মফস্বল
এলাকা হয়ে গড়িয়ে
পড়ে শহরের অন্দরে।
অথচ একে আমার সবসময়ই
একটা ছোট নদীর মতো মনে
হতো, যার হাঁটু জমা জল
থাকে আজীবন।
একটা সময় এই নিরিবিলি
পথ ধরে এগিয়ে দিতাম
নাইমাকে। গলি দিয়ে আরো
কিছুটা ভেতরে ছিলো ওদের
বিশাল সবুজ গেটের
বাড়িটা। আমরা তখন
একসাথে থিয়েটার করছি।
প্রায় সন্ধ্যাতেই
থিয়েটার বিল্ডিং থেকে
নেমে এলে ঐ পথে দু'জন
পাশাপাশি হাঁটতাম
কিছুক্ষণ। এখন ভাবলে
মনে হয় কবেকার কথা।
কিন্তু রাস্তাটা বোধহয়
ঠিকই মনে রেখেছিলো
আমাকে। কিংবা
উল্টোটা।
কিছুদিন আগের একদিন
বাসের জানালা দিয়ে
চোখাচোখি হয়ে গেলো তার
সাথে, একমুহূর্তের
জন্য। নতুন চাকরির
কারণে শহরের এদিকটায়
যাতায়াত বেড়েছে
ইদানিং। ভুলেই
গিয়েছিলাম প্রায়।
দেখেই চিনতে পারলাম।
বাঁক খেয়ে সোজা ভেতরে
ঢুকে পড়া সেই পুরাতন পথ,
যার মাথাটা আগের মতোই
আছে- কিছু দোকান,
দাঁড়ানো রিকশা, ছায়া
ছায়া।
তারপর থেকে দৈনিক
যাতায়াতে প্রায়ই দেখা
হতে থাকলো তার সাথে। আর
একটা রাস্তা যখন আপনার
দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত
ভঙ্গিতে হাসবে, চাওয়ার
আগেই আপনার নতুন করে
মনে পড়ে যাবে সেইসব
পুরোনো কথা, যা আপনি
ভুলেই গিয়েছিলেন-
ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়;
অথচ বুঝবেন সেগুলো
আপনার চামড়ার নিচেই ঠিক
জেগে ছিলো- কালচে,
জমাটবাঁধা। তাদের সাথে
কিছুদিন নিঃশব্দে কথা
হবে আপনার। তারপর কোনো
এক নিঃসঙ্গ বিকেলে
তড়িঘড়ি করে মাটিতে পা
রাখতেই বাসটা হিস শব্দ
করে ছুটে গেলে, আপনি
নিজেকে আবিষ্কার করবেন
সেই ভুলে যাওয়া
অতীতপরিচিত পথের মুখে,
যেখানে এখনও
গুঁড়োদুধের মতো অতীত
লেগে আছে।
কতদিন পর এখানে এলাম
আমি। চার বছর? আরো বেশি?
খুব বেশি বদলায়নি
কিছু। টুংটাং করতে করতে
যাত্রী নিয়ে
আসছে-যাচ্ছে শান্ত
রিকশা। সুযোগ পেয়ে
পাশেই একটা বাজারের মতো
বসে গেছে। আর পথের
দুইপাশে জেগে থাকা মুদি
আর টঙ্গ দোকান, একপাশে
কসাইখানা; পুরনো দিনের
গান বাজানো দুটো সেলুন-
এগুলো আগে ছিলো না
বোধহয়; তবু রাস্তাটা
এত বেশি পরিচিত ভঙ্গিতে
তাকিয়ে থাকে যে
বিকেলের নেতিয়ে আসা
আলোয় রীতিমতো
অস্বস্তি করে।
কই যাবেন?
লোকটার মাথায় গামছা
প্যাঁচানো, গালের
জায়গায় জায়গায়
বসন্তের ছিদ্র। সেই
ছিদ্রগুলোর দিকে আলাদা
আলাদাভাবে তাকিয়ে আমি
বাস্তবিকই ভাবনায় পড়ে
গেলাম। আসলেই তো- কোথায়
যাবো আমি? নাইমার সাথে
সবকিছু চুকেবুকে গেছে
অনেকদিন। তারপর আমরা
আবার ভুলেও গেছি
আমাদের- সেটাও অনেক
অতীত। তাই কৌতুহলী
রিকশাচালকের দিকে
তাকিয়ে বিষণ্ণ ভঙ্গিতে
মাথা দোলাই। আজ কোথাও
যাবার তাড়া নেই আমার।
নাইমারা কি এখনো থাকে
ওখানে? ভাবার চেষ্টা
করি। না, মনে হয়। ওটা
ওদের নিজেদের বাড়ি
ছিলো না। ভাড়া বাসা।
ওর এক ভাই থাকতো দেশের
বাইরে। আর কি কোনো ভাই
ছিলো নাইমার? জার্মানি
বা কানাডা। ঠিক খেয়াল
নেই। এলোমেলো ভঙ্গিতে
এগুতে হয়।
কখনো এই পথ দিয়ে যাওয়ার
সময় আমাদের ঘিরে রাত
নামতো। তেমনই একদিন
হঠাৎ পুরো এলাকায় নেমে
আসা অঘোষিত লোডশেডিং-এ
আমাকে পথের মাঝেই চুমু
খেয়েছিলো নাইমা। অবশ্য
অন্ধকারে এমন অতর্কিত
স্পর্শে প্রথমে চমকে
চিৎকার করে উঠতে
যাচ্ছিলাম আমি। কিন্তু
একটা নরম আর উষ্ণ ঠোঁট
চেপে বসলে আর সেই সুযোগ
মেলে না, বরং তা আমাকে
ফিরিয়ে নিয়ে যায় শৈশবে
দু'দাঁতের ফাঁক দিয়ে
চোঁ চোঁ টানে কোকাকোলা
পানের পুরনো স্মৃতির
কাছে। আর সেরকমই একটা
নেশায় আমরা পরষ্পরের
মধ্যে কিছু একটা খুঁজতে
থাকি। গভীর থেকে গভীরে,
আরো জোরালো ও
সচেতনভাবে। কিন্তু
কিছুই খুঁজে পেতে চাই
না, অথচ খুঁজে চলি। এবং
একমুহূর্ত কিংবা
অনন্তকাল ব্যবধানে
দূরের দোকানে একটা
অস্পষ্ট আলো জ্বলে উঠলে
আমরা দু'জন ব্যাটারি
শেষ হওয়া খেলনার মতো
বিকল হয়ে যাই। বাকীটা
পথ আমাদের আর কোনো কথা
না হলেও টুকরো অন্ধকারে
পাশাপাশি হেঁটে আমরা
মনে মনে গুনতে থাকি
দু'জনের গাঢ় নিঃশ্বাসের
নিঃশব্দ শব্দ।
আচমকা একটা ধাক্কা খেয়ে
সম্বিত ফেরে। ঘুরে ফিরে
তাকাতেই দেখি এক
ভদ্রলোক উল্টোদিকে হন
হন করে হেঁটে চলে
যাচ্ছে। কীরকম অভদ্র।
সরি-টরি বলা তো দূরের
কথা- একটু তাকিয়েও
দেখলো না। ইদানিং শহরের
মানুষগুলো সব কেমন হয়ে
যাচ্ছে। আমি তার কথা
ছেড়ে হাঁটতে হাঁটতে
চারপাশে কি কি পরিবর্তন
হয়েছে বোঝার চেষ্টা
করলাম।
দোকানের সংখ্যা কমে
এসেছে এখন। দু'পাশে
সারি সারি বাড়ি, গ্রিল
ঘেরা বারান্দা।
রাস্তার ধারে কালচে কল।
পানি পড়ছে। বাচ্চা
কোলে এক মহিলা কলসি
নামিয়ে রেখে কলের সামনে
প্রার্থনার ভঙ্গিতে
দাঁড়িয়ে আছেন। পাশেই
হাই ভলিউমে টেলিভিশন
বাজছে। রিপেয়ারিং শপ।
চারিদিকে বিকল
রেডিও-টিভির স্তূপের
আড়ালে বসে কেউ একজন নব
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবগুলো
চ্যানেল টেস্ট করে
যাচ্ছেন।
সবকিছুই খুব
স্বাভাবিক। তবু
কোত্থেকে একটা গুমোট
ভাব পিঁপড়ের সারির মতো
বুকের নিচে জায়গা করে
নিলে কেন যেন আমার
অযথাই দৌড়ে পালিয়ে
যেতে ইচ্ছে করে। অথচ
বেশ কিছু কুকুর ঘুরঘুর
করছে রাস্তায়।
মা বলতেন, কুকুর দেখলে
খবরদার কখনো দৌড়াবি না।
ওরা মানুষের ভয় বুঝতে
পারে।
কিন্তু যদি কামড় দিতে
আসে?
সোজা দাঁড়িয়ে যাবি। তখন
সেও থেমে যাবে। তারপর
কুকুরের দিকে তাকিয়ে
একটা ধমক দিলেই পালিয়ে
যাবে।
যদি না থামে?
না দেখার ভান করে সরে
পড়বি একদিকে। কিন্তু
দৌড়াবি না।
কিন্তু কুকুরটা যদি
পাগলা হয়?
শুনে মা হতাশ দৃষ্টিতে
তাকান। নিজের ছেলেকে
ঠিকই চেনেন তিনি। বুঝতে
পারেন তার ছেলে আসলে এক
বিরাট দৌড়বিদ। সে
দৌড়াবেই। এখন থেকে হয়ত
আরো বেশি করে দৌড়াবে।
গলাটা শুকিয়ে গেছে।
সাথে সিগারেটের
তৃষ্ণা। কিন্তু
আশেপাশে টঙ্গ জাতীয়
কোনো দোকান নেই। পেছনে
ফিরে যাবো? নাহ। সামনে
গেলে একটা না একটা কিছু
নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।
ঢালাই দেয়া রাস্তার ওপর
ধূলোর মিহি স্তর।
রাস্তার দু'পাশ থেকে
কিছু বাড়ি এত পরিচিত
ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে-
আগে চোখে পড়েনি কেন।
অবশ্য এতোদিনে
অনেককিছুই বদলে গেছে
হয়ত। নাইমা কি এখানেই
আমাকে চুমু খেয়েছিলো?
সরু গলির এই মাথা-ঐ
মাথায় চোখ বুলাই। নাহ,
কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
দূরে একটা টঙ্গ দোকান
দেখে কিছুটা স্বস্তি
পেলাম। নিজেকে একজন
পীড়িত মুসাফির মনে হলো।
দোকানের ভেতর এখনো বাতি
জ্বালানো হয়নি। মেঝেতে
মৃদু অন্ধকার জমে আছে।
একজন একচোখ অন্ধ বৃদ্ধ
বসে কানের কাছে উঁচু
শব্দের রেডিওটা ধরে
রেখেছেন।
শুনছেন?
তিনি এক চোখে অবাক হয়ে
তাকালেন। যেন আমি একটা
ভারী অবাক করা বিষয়।
আমি অনেকদিন পর এই পথে
আসলাম। আপনাদের এই
দিকটা খুব পাল্টে গেছে,
তাই না?
আমি আলাপ জমানোর চেষ্টা
করি। কিন্তু খুব একটা
সুবিধা হয় না। তার এক
চোখ দেখে মনে হওয়াটা
স্বাভাবিক যে, এমন
প্রশ্নের সাথে তার খুব
বেশি কথা নেই। তিনি
আমার কথা না শোনার মতো
করে দোকানের ভেতরে
তাকিয়ে কাউকে যেন
ডাকলেন। ঐদিকে একটা
দরজা আছে। বাইরে থেকে
দেখে বোঝা যায় না।
সেখান থেকে একটি মেয়ে
বের হয়ে এলো। তার নাতনী
বোধহয়। মেয়েও হতে পারে।
পরনে অপরিচ্ছন্ন, সস্তা
পোষাক। অথচ আলোতে এসে
সরাসরি আমার চোখের দিকে
তাকাতেই ভয়ানক নড়ে গেলো
সব।
'দাদা কানে শোনে না। কি
লাগবে আপনার?'
তামান্না, এখানে?
কিন্তু তা কিভাবে।
কলেজে একসাথে পড়তাম।
অনেকেই পড়তো। কিন্তু
তামান্নাকে নিয়ে আমার
আলাদা একটা ভালো লাগা
ছিলো। বেশ ভালো রকমেরই
ছিলো। তাই ওর মুখ ভুল
করার প্রশ্নই আসে না।
নইলে ভাবা যেতো চেহারার
মিল। কিন্তু সেই একই
চোখ, মুখের মানচিত্র,
পুরু নাক- মেয়েটা
অপেক্ষা করে। কিন্তু
আমি আর কিছু বলি না বা
বলতে পারি না। দ্রুত পা
চালিয়ে পেছনে রেখে আসি
অস্পষ্ট দোকানটা।
এভাবে পালিয়ে আসাটা কি
ঠিক হলো? মেয়েটা কি
ভাববে। ফিরে গিয়ে
সিগারেট চাইবো আবার?
বলবো যে, দুঃখিত কিছু
মনে করবেন না।
তামান্নাকে নিয়ে একসময়
অনেক কথা ভাবতাম আমি।
তামান্না কে?
আপনি।
কিন্তু আমি তো আরেকজন।
ঠিক বলেছেন। আপনি
আরেকজন।
নাহ, ফেরার চিন্তাটা
মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলি।
কিন্তু তামান্নাকে এতো
সহজে তাড়ানো যায় না।
বৃদ্ধের নাতনীটি
নিশ্চয়ই তামান্না না,
আবার তামান্না আর
মেয়েটির এতো বেশি মিল-
তাদের দু'জনকে আলাদা
মানুষ ভাবতেও ইচ্ছে করে
না। ব্যাপারটা এমন
অমীমাংসিত রেখে
যাওয়াটা অস্বস্তিকর।
সেই অস্বস্তি ভেজা
বালির মতো বুকে লেপ্টে
থাকে।
কিছুক্ষণ আগে পাশ দিয়ে
টুংটাং শব্দ তুলে
দু'একটি রিকশা
আসা-যাওয়া করছিলো।
কিন্তু অনেকক্ষণ হয়ে
গেলো, কাউকেই চোখে
পড়েনি- না মানুষ, না
রিকশা। দুই পাশে শুধু
সারি সারি বাড়ি পাথরের
মতো মুখ করে দাঁড়ানো।
তাদের মাঝে হঠাৎ হঠাৎ
দু'একটি নারকেল গাছ যেন
অলস ভঙ্গিতে ঝুঁকে
দেখছে আমাকে। আর যতই
এগিয়ে যাচ্ছি সামনের
দিকে, বাড়ছে সবুজের
পরিমান, বদলে যাচ্ছে
বাড়ির কাঠামো। এখন এটা
সত্যিকার অর্থেই একটা
মফস্বলের রূপ নিয়েছে।
অন্তত আমার ঠিক তাই মনে
হয়।
এই প্রথম একটা মৃদু
আশঙ্কার মতো হলো- আমি
বোধহয় পথ ভুল করেছি।
একবার ভাবলাম ফিরে যাই।
নাইমাদের গলিটা এমন না,
অন্যরকম ছিলো। কিন্তু
সবকিছু এতো পরিচিত
লাগছিলো যে, আরেকটু
এগুলেই নাইমাদের সবুজ
গেটটা দেখতে পাবো এমন
একটা ব্যাপার আমি তবু
পুরোপুরি অবিশ্বাস
করতে পারলাম না।
অথচ রাস্তা ভুলের কিছু
নেই। আরো কয়েকটা গলিপথ
এদিক-সেদিক কাটাকাটি
খেললেও মোটামুটি সরলই
ছিলো রাস্তাটা। কিছুটা
এগুলেই একটা মসজিদ পড়তো
সামনে। সেই মসজিদের
সামনে একটা কানা
ভিক্ষুক বসে থাকতো
রাতদিন। কিন্তু কোথায়
সেই মসজিদটা? এতক্ষণেও
দেখতে পেলাম না।
হঠাৎ চোখে পড়লো
ছাপড়াটা। বাঁশ আর কাঠের
নড়বড়ে কাঠামো। রাস্তার
পাশেই নোংরামতো
দাঁড়িয়ে আছে। টঙ্গ হতে
পারে ভেবে এগিয়ে
গেলাম।
দোকান না। অনেকটা
অস্থায়ী একটা থাকার
জায়গার মতো। ভেতরে একটা
বেঞ্চ পাতা। লোকটা
উল্টো ঘুরে তার টিয়া
পাখির সাথে খেলছিলেন।
মধ্যবয়স্ক একটা লোক।
গায়ে একটা ফিরোজা রঙের
চাদর জড়ানো। টকটকে সবুজ
টিয়া।
আচ্ছা এখানে একটা মসজিদ
ছিলো না? মাইকওলা
মসজিদ?
প্রশ্নটা শুনে তিনি মুখ
তুলে আমাকে দেখলেন।
তারপর অদ্ভুত সহজ
ভঙ্গিতে হাসলেন।
এখানে নতুন নাকি? বলে
আবার হাতের টিয়া
পাখিটাকে আদর করতে করতে
নিজেই প্রশ্নের উত্তর
দেয়ার মতো করলেন,
হ্যাঁ। নতুনই হবে।
আসলে আমি অনেক আগে
এখানে আসতাম। আমার একজন
পরিচিত মানুষের বাড়ি এই
দিকে। সেটাই খুঁজছি।
ভদ্রলোক এবার আমার দিকে
কিছুটা কৌতুকমাখা
কণ্ঠে তাকালেন, এখানে
কিছু নেই, কখনো ছিলো না।
এটা হারানো জিনিসদের
এলাকা। যা কিছু হারিয়ে
যায়, এখানে চলে আসে।
তুমি হারিয়ে গেছো।
এখানে কেউ কাউকে খুঁজে
পায় না।
হারিয়ে গেছি মানে? কি
বলে এই লোক। দেখে তো
পাগল মনে হয় না।
কি বলছেন এসব
উল্টাপাল্টা? খুঁজে পায়
না মানে কি? ইভেন আমার
কাছে ওর ঠিকানাও আছে।
আমি পকেটে হাত দিই তাকে
ঠিকানাটা দেখাবো বলে।
কিন্তু লোকটা থামিয়ে
দেন।
লাভ নাই।
লাভ নাই মানে? পাগল নাকি
আপনি।
ভদ্রলোক আবারো অদ্ভুত
ভঙ্গিতে হাসলেন। তারপর
আর কিছু না বলে উল্টো
ঘুরে টিয়া পাখিটাকে আদর
করতে লাগলেন। ভালো
পাগলের পাল্লায় পড়া
গেলো- আবার নেমে এলাম
পথে। চাইলে এখনো ফিরে
যাওয়া যায়। কিন্তু
ভাবলাম এসেছি যখন
আরেকটু এগিয়েই দেখা যাক
না। পাগলের কথায় ভয়
পাচ্ছি ভেবে কিছুটা
হাসিও পেলো। তাছাড়া
একটা রিকশা পেলে সহজে
ফিরে যাওয়া যাবে। পা
দু'টোও টনটন করছে।
অনেকদিন হাঁটার অভ্যেস
নেই তেমন। বাসে উঠে
অফিসে যাই, আবার নেমে
রিকশা নিয়ে ফিরে আসি।
খেয়াল করলাম কখন যেন
বদলে গেছে পায়ের নিচের
পথ- আধাপাকা একটা
রাস্তা সাপের মতো গড়িয়ে
চলেছে আমার সাথে সাথে।
রাস্তার দুই পাশে
দালানের সংখ্যাও কমে
এসেছে। এবং যত এগুচ্ছি,
আরো পরিচিত মনে হচ্ছে
চারিদিক। কেমন একটা
ইশারার মতো অনুভূতি কাজ
করে- হ্যাঁ, সামনের
বামদিকে একটা অশ্বথ গাছ
থাকার কথা। তারপরে একটা
ভাঙ্গা মন্দির। সেই
ভাঙ্গা কালী মন্দিরের
বাম পাশের সরু মাটির
রাস্তা দিয়ে এগিয়ে
পেয়ারা বাগান পেরুলেই
দেখা মিলবে বড় বড়
নারকেল গাছ ঘেরা
দুপুরপুকুরের। যার জল
খামচে গাছের কালচে সবুজ
ছায়া আর নীল ভাসে।
পুকুরটা দেখা যাচ্ছে।
শানবাঁধানো পুকুরঘাটে
কিশোর ছেলেটা বসে আছে।
মাথা নিচু করে। হাতে
একটা চিঠি। অনেকটা আড়াল
আর দূরত্ব নিয়ে
দাঁড়ালেও তার হাতের
চিঠিটা পড়তে খুব একটা
সমস্যা হয় না আমার। তার
মামা শহর থেকে
পাঠিয়েছেন চিঠিটা।
লিখেছেন, শহরের কলেজে
কথা বলেছেন তিনি। সে
যেন দ্রুতই ঢাকায় চলে
আসে। আর কলেজে ভর্তি
হওয়ার পর তার বাসায়
থেকেই লেখাপড়া করতে
পারবে সে। এজন্য চিন্তা
করতে নিষেধ করেছেন। অথচ
ছেলেটার এমন কোনো ইচ্ছে
নেই। এই মফস্বল, মানুষ,
পুকুরঘাট, আধাপাকা
রাস্তা, মাঠের বিকেল-
এসবই তার আপন। এসব সে
কোনোভাবেই হারাতে চায়
না। কিন্তু ছেলেটা একটা
কথা এখনো জানে না-
সবকিছুই একদিন হারিয়ে
যায়। তার দিকে তাকিয়ে
থাকতে থাকতে আমার মনে
মেঘ ছেয়ে আসে।
নিচু মুখে ফিরে আসি, সেই
টিয়া পাখিওলার ছাপড়ার
সামনে দাঁড়াই। তিনি
টিয়াটাকে কাঁধে নিয়ে
অতীতের চিহ্ন চোখে
বেরিয়ে আসেন।
আমি এখান থেকে ফিরে
যেতে চাই?
যে হারায় সেকি আদৌ ফিরে
যায়? ভদ্রলোক উদাস
ভঙ্গিতে দূরে দৃষ্টি
বোলান।
তা জানি না। তবে আমি
ফিরতে চাই। আমার
স্ত্রী-পরিবার আছে।
ভদ্রলোক হাসলেন। শীতল
হাসি। কেউ যেন আমার
শরীরে একখন্ড তাজা বরফ
ঘষে দিলো।
হারানো আর ফেরার জন্য
কোনো আলাদা পথ নেই।
আচ্ছা এর আগে আমি ঠিক
কতবার হারিয়েছি?
তিনি কোনো উত্তর করলেন
না।
সন্ধ্যা নেমে আসছে
দ্রুত। পা চালাই।
চারিদিকের এসব কিছুকে
এবার আর পরিচিত মনে হয়
না, চেনা লাগে। নির্জন
গলির সন্ধ্যা, রিপেয়ার
শপ, ঢাকায় আসার পর দেখা
পানির কল, পাড়ার সেলুন-
আমার সবকিছু পরিচিত
লাগে এবার। এজন্যই হয়ত
এবার পরিচিত পথটা কমে
গিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই
গলির মুখে পৌঁছে গেলাম।
ব্যস্ত বড় রাস্তা দেখা
যাচ্ছে।
হঠাৎ চোখ পড়লো লোকটার
উপর। আনমনে কী যেন
ভাবতে ভাবতে এদিকেই
আসছে। আমি তাকে এড়ানোর
জন্য দ্রুত পা চালাই।
কিন্তু তাকে অতিক্রম
করার শেষ মুহূর্তে
ধাক্কাটা এড়ানো যায় না।
তবু না থেমে দ্রুত পায়ে
সোজা হেঁটে যাই। আমি
জানি সে এখন মনে মনে কি
ভাববে।
তারপর কয়েকদিন কেটে
গেছে। সবই
স্বাভাবিকভাবে চলছে।
তবে সেদিন সন্ধ্যায়
নিজের ঘরে ফিরতে পারিনি
আমি। ফিরেছি অন্য
পরিচয়ে, অন্য একজন হয়ে,
অন্য এক আমার ঘরে- যার
বৌকে রাতে খুব
স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আদর
করছি, ছেলেকে হোমওয়ার্ক
দেখিয়ে দিচ্ছি, রাতে
একসাথে খাচ্ছি,
ঘুমুচ্ছি। তারা সবাই
আমার খুব চেনা। কিন্তু
বড় বেশি অপরিচিত। তারা
সেটা না জানলেও আমি
জানি- যেকোনো সময়
আরেকজন রেজাউল করিম
ফিরে আসবে। এবং তখন
আমার বর্তমান
স্ত্রী-সন্তান আমাকে ছি
ছি করবে, আরেকজন সেজে
তাদের সাথে থাকার জন্য
থু থু দেবে। মুখ কালো
হয়ে আসবে; আর আমার কোথাও
যাবার পথ থাকবে না।
এইসব চিন্তা প্রতিদিন
একটু একটু করে গ্রাস
করে নিচ্ছে আমাকে।
প্রচণ্ড পানির তৃষ্ণা
নিয়ে আমি জেগে উঠছি
প্রতিদিন। এবং এটা
অনেকটা নিজের মৃত্যু
দেখার পর সত্যি সত্যি
মরে যাবার জন্য
অপেক্ষার মতো। শুধু আমি
জানি- আমি বেঁচে নেই। যে
কোনো মুহূর্তে তা
বেরিয়ে আসবে সংবাদ
শিরোনামে, সবাই জেনে
যাবে- আমি আসলে আমি নই,
বেঁচে থাকার অভিনয় করছি
শুধু। এটা এক ভয়ংকর
অপেক্ষা। আর যারা
অপেক্ষা করে, তাদের
অপেক্ষা কোনোদিন শেষ হয়
না।
মাঝে মাঝে মনে হয় খুব
গোলমাল বেঁধে গেছে।
ভীষণ শীত করছে আমার।
অথচ নিজেকে দেখতে
পাচ্ছি না। কোথাও নেই
আমি। কোথাও পা বেধেছে,
কিন্তু পড়ে যাচ্ছি না।
চিৎকারে শব্দ হচ্ছে না।
আমার শুধু মনে পড়ে যায়
সেই টিয়া পাখিওলার কথা।
যে হারায় সে কি আদৌ ফিরে
যায়?