দীর্ঘ ঘুমের শেষে একটা
গড়ে-নেওয়া অবয়ব নিয়ে পথ
চিনে চিনে অনেকটা চলে
আসা গেল, শীতল জল আর
আহার্যসন্ধানে। সকলের
পিছনে - শ্লথতার কারণে
নয়, মূলতঃ সম্ভ্রমে -
হেঁটে আসা হল অনেকটা
রাস্তা। আকাশে এখন নীল
থেকে প্রায় শহুরে ধুলোর
রঙ। পার হয়ে আসা গেল
আগুন-তপ্ত অনন্ত
প্রশ্নমালা। ছেড়ে আসা
গেল অগুনতি সন্দিগ্ধ
চোখ। ‘হায় প্রশ্নাবলী,
আমার পদদ্বয়, দেখো,
তাদের পূর্ণ
রক্তমাংসে এখনও বিভোর।
মাটি স্পর্শ করে আছে’।
আমি বলি, সম্ভবতঃ
নিজেকেই।
ক্রমে স্বচ্ছ আর
তীক্ষ্ণ হয়ে উঠছে
দৃষ্টি। যদিও দক্ষিণে
যাত্রা অনিশ্চয়তার
দিকে, তবু পিছনের মনোহর
নীলদুনিয়ার থেকে,
অনুরাগের ঘর থেকে অনেক
স্পষ্ট সামনের
উত্তুঙ্গ পাহাড়।
স্পষ্ট দেখা যায়, তারার
আলোক ঠিকরে পড়ছে মেঘের
শরীরে, যেন যোগীশ্বরের
বিশ্রস্ত জটার আড়ালে
ডুব দিচ্ছে
সূর্যচ্ছটা। মনে হয়,
সামনে কোথাও অপেক্ষায়
আছে অনন্তসন্ধ্যা। টের
পাই প্রাপ্ত
শাস্তিসমূহের
অভিজ্ঞান। দেখি, আমারই
মধ্য দিয়ে বহে যাওয়া
সুখ ও দুঃখভোগের সমস্ত
সরণি। দেখি সঙ্গী
দেবদূতকে, যে পুণ্যে
বিশ্বাস রাখে না,অথচ যে
পুণ্যলোভী।
গুরুর উপদেশের মর্যাদা
দেব জেনে আমি চলে এসেছি
এতটা পথ। পেরিয়ে এসেছি
ভয়ঙ্কর নদী, পরাজিত
করেছি ক্ষুধাচঞ্চল
জন্তু। অথচ, তাঁর শত
আশ্বাসের মধ্যেও আমি
দেখতে পাই না সে
প্রতিশ্রুত আশ্রয়, যখন
এ গোলার্ধে গাঢ় হয়
রাত্রি। বরং এক অতলান্ত
অন্ধকার খাদ আমার চলার
পথের ধারে ধারে চলতে
থাকে। আমাকে সাবধান
করে, প্রতি পদক্ষেপে ভয়
দেখায়। গুরু বলেন, আমার
গন্তব্য ওই খাদের
অন্ধকার চিরে। সহজ
সুন্দর পথ আমার নয়।
আমাদের নয়।
সেই খাদের প্রাচীরে
ধাক্কা খেয়ে ঘুরে বেড়ায়
ব্যাকুল দীর্ঘশ্বাস।
অথচ এরা তো কোনো পাপ করে
নি, সেই পাপ যা আমাদের
সম্মিলিত বোধেই - পাপ।
শুধু তোমার
ধর্মে দীক্ষা নেয় নি
বলে এদের এত ক্লেশ,
প্রভু। এদের জীবনেও ছিল
প্রজ্ঞার
অনুসন্ধান, যদিও তা
অন্যতর পথে। এদের মনেও
ছিল ঈশ্বরচেতনা, যাতে
মূর্ত হল
আরাধ্যের অন্যতর ছবি।
তোমার আশিসে বনরাজি হয়
নগর, বায়ু হয় রঙিন,
বিলুপ্ত হয় পতঙ্গ,
বিজিত হয়
বিমুখ - অথচ এদের
মুক্তিলাভের একমাত্র
পথ স্নেহ যা একমাত্র
তোমারই। ঈশ্বর, তুমি
তোমার প্রতি
অবিশ্বাসীদের,
বিরাগীদের,
ভিন্নধর্মীদের
মুক্তিদান করো। যে
জীবনে পুণ্য নেই, যশের
অবকাশ নেই, যেখানে কোনো
আলো নেই, বাতাস যেখানে
তরঙ্গময়, যে স্থান থেকে
সম্মুখের আলোর ধারণা হয়
কিন্তু তা দৃষ্ট হয় না,
সেই নরকগহ্বর থেকে এই
পুণ্যাত্মাদের নিয়ে
এসো সবুজ উজ্জ্বল
প্রান্তরে। এদের
ক্ষুধা সাধারণ, এদের
পাপপুণ্যের বোধ সহজিয়া,
এরা তোমার মতই
কামনাপীড়িত, এদের ভাবনা
সম্মুখবর্তী আনন্দের
দিকে – তুমি এদের
অনুবর্তী হও। অপরের
দোষে এরা অশরীরী সারসের
শিকার। তোমার
রোষাগ্নিতে ধ্বংস
হয়েছে এদের কাঠকুটো
সভ্যতা। ঈশ্বর, তুমি এ
সভ্যতার পূজারী হও, একে
রক্ষা কর। তোমার
আশ্চর্য সারমেয় - যে জয়
করেছে স্বর্ণ ও
মৃত্তিকার লোভ – পরাস্ত
করুক তোমারই পালিত
হিংস্র শ্বাপদকে।
তোমার প্রতিশ্রুত
আশ্রয় হোক সত্য,
প্রাণবন্ত,
স্পর্শস্নিগ্ধ।
আমাদের সম্মিলিত
মৃত্যুর থেকে একবার
জন্ম নিক কবিতা।