দূরে কোথাও ধানকাটা মাঠ
তাকিয়ে আছে আকাশের
দিকে। ঝিরঝিরে
হাওয়া-বৃষ্টি, টানছে
আঁচল। আঁচল বলে হয়তো
কিছুই নেই, সভ্যতাজনিত
অসুখ সব। দূরে কোথাও
বাস হাইওয়েজুড়ে চাকার
ঘর্ষণ মাখিয়ে চলে
যাচ্ছে। মাঠের কোন
ফেরিওয়ালা মাথায় সওদা
নিয়ে আড়াআড়ি পার হচ্ছে
গন্তব্য। মাজারের
লালসালু পেরিয়ে বাজনা
ভেসে আসে, আগরবাতির
গন্ধ পরম্পরা ছড়িয়ে দেয়
বাতাসে। খুব সাবধানে
ঘটে যাচ্ছে কিছু।
টান-বাঁধন ছিঁড়ে
চিহ্নহীন বোধ সাঁকো
পেরোতে চায়।
কোথাও দুঃখ বাজে,
কাঁচাপাকা সব দুঃখ। দাম
চড়ছে কথাদের। সহজে
বেরতে চায় না আর
শব্দরা। পরিপক্ক বোধের
বয়স এলে মানুষ বিন্দুবৎ
ফুরিয়ে যাওয়ার দিকে
এগোয়।
পুরনো গলির মতো লতিয়ে
যাওয়া অপেক্ষাগুলো
ক্রমশ জড়িয়ে গেছে ছেড়ে
যাওয়া ট্রেনের চাকায়।
সময়ের দালানবাড়ি
জানালা বন্ধ করে ঘুমোয়
কুয়াশামুড়ি দিয়ে।
কু-আশাগুলো রেখাপাত করে
চলে যায়। অমোঘ সৌন্দর্য
চোখে নিয়ে তুমি চোখ
মুদে আছো। আমার
ভাঙাঘরের দোর খোলা পড়ে
থাকে, পোকার উচ্ছ্বাস
ছিটকে আসে ভেতরঘরে।
সেইসব বিদ্রুপের হাসি
নুনমশলার পাত্রে
ঢেউয়ের বলয় নিয়ে তড়পায়।
ভাগচাষীদের বীজতলা
ভেজে। কারো কারো ভেতরটা
ভেজে, কুয়াশা ও শীতের
বৃষ্টি মাখামাখি হয়।
ব্রহ্মাণ্ডের কেউ জানে
না, বড় হয়ে গেলে কেন
কান্না লুকোতে হয়, হু হু
করে ডাক ছাড়া যায় না
প্রান্তরের দিকে।
সন্ধ্যে আসবে, ময়লার
গাড়ি গন্ধ ছড়িয়ে
ভাগাড়ের দিকে চলে যায়!
আর, মানুষ গন্ধ লুকাতে
আপ্রাণ চেষ্টা করে,
বীভৎস যত গন্ধ মানুষেরা
পুষে রাখে করতলে,
হাড়ে-মজ্জায়। এই
ঠাসাঠাসি গন্ধের ভিড়ে
গর্দানজুড়ে রক্তচাপ
টের পাওয়া যায়। ঘুম নয়,
চেতন নয়, অবচেতনার আসরে
বসে নিজের সাথে জুয়া
খেলি। রাতদিন এই
ক্যাসিনো খোলা রেখে দেয়
স্ববিরোধী 'আমি'। এখানে
আমিই কি আমার পার্টনার?
জল ছেড়ে জলের কাছে আছড়ে
পড়ে জল, মানুষ মানুষকে
ছেড়ে মানুষের কাছে যায়।
করতল ছেড়ে ধরে রাখে
অন্য করতল। স্মৃতির
ভেতরে স্মৃতি গুঁজে
দেয়ার খেলায় কী নির্মম
মেতে ওঠে! এত বদল! খোলা
জমিনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে
দেই, সে আর গোপনতার দাবি
করে না।
মনটা কেন অকারণ দপদপ
করে ওঠে! ছিটকানো
পায়েসের মতো চটচটে লাগে
শরীর। কুকুরের কাছে
বিশ্বস্ততার দাবি করা
যায়, মানুষ! মুখবদলের
আগে রঙ মেখে নেয় আচানক।
যেন সদ্যনির্মিত কোন
দেয়াল, রঙেরঙে সজ্জিত
হতে উন্মুখ।
দূরগ্রাম থেকে আলো ভেসে
আসে। রেখার মতো করে সে
আলো এসে নামে পায়ের
কাছে। তখন অন্যসব
অনুষঙ্গ ছেড়ে কিছুকাল
নিজের কাছে থাকা লাগে,
একার করে। রাখালের
পায়ের পাঁক না শুকোতেই
গান মুছে যায় দিনের।
ঝিঁঝিঁ চোখ খোলে
ঝোপঝাড়ে।
জল পূর্বাপর আর কোথাও
যাওয়ার থাকে না। না ঘর,
না কোন দুপুর। শহর সবে
জ্বলে উঠেছে রোজকার
নিয়ম সেঁটে।
সন্ধ্যাগুলো ভাগাভাগি
করে সে এখন অন্য কোন
মুখের কাছে নত হয়
একপ্লেট ফুচকার
বিনিময়ে। খাটে না
অনেকবিধ হিসেব- কতটা
নির্জনতম তার ছায়াগাছা,
অধি-বোধের উচ্চারণ কতটা
ভালো? কতটা শুদ্ধতম তার
প্রণয়ের গরিমা? অনেক
রোগের ভেতর সব প্রশ্ন
ডুবে যায় সান্ধ্যকালীন
সূর্যের মতো।
ডাক্তারের কাছে গেলে
বৃত্তান্ত বলার কিছু
থাকে না। অথচ সারাক্ষণ
মর্মের ভেতর ভাঙার গান।
ডানাকাটা পাখি এক
খিড়কির কাচের বুকে ছটফট
লেখে। দরপতনের হাটে
মানুষ কীসের
গ্র্যাভিটি নিয়ে থাকে
জানা যায় না।
.........