জানুয়ারির নয় তারিখ আজ,
দু’হাজার আঠারো।
ক্রিসমাস আর হলিডে’র
মাতম শেষে চারপাশ
কিছুটা থিতু। স্কুল
কলেজ অফিস যথারীতি শুরু
হয়েছে, ঘরবাড়ি
দোকানপাটের
অত্যুজ্জ্বল আলো
স্তিমিতপ্রায়। সান্তা
ক্লজের দেয়া উপহার আর
চকোলেটের ঝকঝকে মোড়ক
খোলার পালা শেষ,
শীতার্ত শহরের আসল
চেহারাটা বেরিয়ে আসছে
ক্রমশঃ। হাড় কাঁপানো
হিমের ভেতর ক’দিন ধরে
আকাশ ভেঙে অঝোরে বৃষ্টি
ঝরছে। পৃথিবীজুড়ে একই
সময়ে ঋতু’র
বৈচিত্র্যের খেলা দেখে
কখনো চমকিত হই।
আমেরিকার উত্তরে বরফের
ওপর বরফের আচ্ছাদন
জমছে। সাউদার্ণ
ক্যালিফোর্নিয়াতে
বর্ষনমুখর শীত। আবার
অস্ট্রেলিয়ায় এখন
প্রচন্ড গরম, শুনেছি
উষ্ণতা রেকর্ড
ছাড়িয়েছে।
লিভিংরুমের জানালায়
দাঁড়ালে রাস্তার ওপাশে
অ্যামির বিশাল বাড়ি।
ফাঁকা পড়ে আছে অনেকদিন।
বৃষ্টিতে ধূসর আর
মেরুনের মিশ্রণে এক
পূর্ণদৈর্ঘ্য জলছবি
আমার সামনে। বাসার
ফ্রন্টইয়ার্ডে ধূসর
রকিং চেয়ারটা একাকী
ভিজছে। গতবছর সামারে
বাড়ি রঙ করার ফাঁকে
গাছের ছায়ায় এই চেয়ারে
বসে বব বিয়ার খাচ্ছিল।
সারা গায়ে রঙের
মাখামাখি, মাথায়
ব্যান্ডানা পেঁচানো,
“নিজের হাতে ঘরবাড়ি
পেইন্ট করা খুব
ঝামেলার কাজ।
ফার্নিচার সব মুড়িয়ে
ফেলো, দেয়ালে টেপিং করে
হিসেবমত পেইন্ট করো।
আগামী দশ বছরে এসব আর
ভাবব না। তুমি কী বলো,
হান?” কাছেই ছোট
পোর্টেবল বারবিকিউ
চুলোয় স্টেক আর হটডগ
বানাচ্ছে অ্যামি।
গ্যারাজের স্পীকারে
গান বাজছে, তালে তালে
মৃদু নাচছে সে।
খেতে খেতে আমরা গল্প
করছিলাম। বব এবং অ্যামি
আমাদের প্রতিবেশির
সীমানা অতিক্রম করে
ঘনিষ্ঠ বন্ধু। রাস্তার
এপার আর ওপারের
মুখোমুখি দুই বাড়িতে
বাসিন্দাদের অবাধ
যাতায়াত। অ্যামির বাসা
জমজমাট। চারটে ভিন্ন
ভিন্ন প্রজাতির কুকুর,
অ্যাকুরিয়ামে ছয়টি মাছ,
একটি বেড়াল, মিঃ টটার
নামের একটি প্যারট,
দুটো সুন্দর ফুটফুটে
মেয়ে নিয়ে তাদের সংসার।
অ্যামির মা বোনেরা এই
শহরেই থাকে, যখন তখন চলে
আসে তারাও। আনন্দের
গুঁড়ো ছড়িয়ে আছে
চারপাশের প্রতিটি
কোণে। এর বিশ দিনের
মাথায় কাঁধে
ব্যাকপ্যাক ঝুলিয়ে
হঠাৎ বব বাসা ছেড়ে চলে
গেল। শুনলাম, তাদের
ছাড়াছাড়ি হয়েছে।
আতংকিত আমি বব আর
অ্যামিকে অনেক অনেক
প্রশ্ন করতে চাই। ববকে
কল দিলে মেসেজে চলে
যায়। অ্যামি পরদিন আমার
বারান্দায় পায়চারি
করছে। আমার মস্তিষ্কে
বুদবুদিয়ে ওঠা শত শত
প্রশ্নকে গলা টিপে মেরে
ফেলতে থাকে আমার
শিষ্টতাবোধ।
নির্বিকারমুখে শুধু
জিজ্ঞেস করি,
“সেপারেশনের কথা কী
অনেকদিন ধরে ভাবছিলে,
অ্যামি?” কফিতে চুমুক
দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থাকে
সে, তারপর একসময় উত্তর
দেয়, “হু। অনেকদিন
ধরে”।
কুকুরগুলো প্রায়ই বাসা
থেকে বেরিয়ে যায়।
সাইডডোরের নিচে তারা
গর্ত খুঁড়েছে। অ্যামি
কেয়ার করে না, কাজ থেকে
ফিরে কখনো খুঁজে খুঁজে
ফিরিয়ে আনে অবশ্য।
মা’র বাসায় কখনো একটানা
থেকে যায়, বাসার
প্রাণীগুলো অনাহারে
ভোগে প্রায়ই। মেয়েটা
শুকিয়েও গেছে বেশ। এক
নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি
দেখলাম একদিন, পাড়ার
লাইটপোস্ট আর
গাছগুলোতে সেঁটে আছে,
“ল্যান্স নামের একটি
ল্যাব্রাডুডল হারিয়ে
গেছে। সন্ধান পেলে
অনুগ্রহ করে যোগাযোগ
করুন”। নিচে অ্যামির
নাম আর ফোন নম্বর।
ভাইবোনেরা একদিন এসে
কুকুর, বেড়াল,
মাছগুলোকে নিয়ে গেল।
বাচ্চারাও নানুবাড়িতে
থাকতে চাইছে। বেলারোজ
ম্লানমুখে ফিসফিসিয়ে
বলে, “বাবাকে আমি মিস
করি খুব!” অ্যামির
ব্যাকইয়ার্ডে
সুইংসেটের দোলনাগুলো
বিষন্ন স্থির। লনের
সবুজ ঘাস খরায় ভোগে,
বাড়ি আর গাছপালা জুড়ে
শুষ্কতা আর ধুলো।
মাঝেমাঝে গিয়ে কিছুটা
দেখাশুনা করে আসি।
চোখের সামনে একটি
স্বপ্নের ধীরমৃত্যু
দেখছি। নিস্তব্ধ
শূন্যতা ভুলিয়ে দিয়েছে
অজানা সব বিবাদ। শুধু
খাঁচায় মিঃ টটার কখনো
ববের কন্ঠ অবিকল নকল
করে হঠাৎ চীৎকার
করে,“আই লাভ ইউ, অ্যামি!”
আমি এখনো জানালায়
দাঁড়িয়ে। বৃষ্টির মাঝে
আজ একটি গল্প অ্যামির
ফ্রন্টইয়ার্ডের
নিঃসঙ্গ রকিং
চেয়ারটিতে এসে
স্থিরচিত্র হয়ে বসেছে।
জানালার কাচ ভেদ করে
জলের অপার ঝর্ণার ভেতর
বিশাল লন পেরিয়ে আমি
হেঁটে যাচ্ছি যেন।
রাস্তা পেরুচ্ছি, ৭৪৯
নম্বর বাসাটার মেরুন
দরজাটার দুইপাট
দুইদিকে খুলে যাচ্ছে,
বসার ঘর পেরিয়ে খাবারের
ঘর। অ্যামি হলুদ গ্লাভস
পরে আভেন থেকে বয়ে আনছে
হট চিলির বিশাল
পাত্রটা। বাচ্চারা
দৌড়ে ঢুকে যাচ্ছে পাশের
নার্সারীতে, সেখানে
সারি সারি তাকে জমে আছে
বার্বি, এভার আফটার হাই,
মন্সটার হাইয়ের মেয়ে
চরিত্রগুলো, লেগোর সেট,
পাজল, ফুসবল, এয়ার হকি,
অসংখ্য বই। আমার দিকে
ফিরে হাত নেড়ে সিঁড়ি
বেয়ে উঠে যাচ্ছে বব।
দোতলার পাঁচটা ঘরের
ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র।
মাস্টার বেডরুমে দুই
যুবক যুবতীর ভালবাসার
ইতিবৃত্ত এদিক সেদিক
ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
পাশের ঘরে যেভাবে তারা
জমিয়ে রেখেছে তাদের
শৈশবকে। গল্পটা আজ যেন
পণ করেছে, আমাকে সে
প্রতিটা ঘরের প্রতিটা
পরত খুলে খুলে দেখাবে,
তার নিরহংকারী থলেয়
জমানো পাশার ঘুঁটি চেলে
এক ঘর, দুইঘর করে। পণের
মত আমি এগিয়ে চলেছি।
আরও দুই ঘর,
ম্যাডেলিনের
প্রিন্সেস জাসমিন আর
বেলারোজের লিটল
মারমেইড থিমে সাজানো
রুপকথা। স্নানের ঘরে
স্মৃতি বিস্মৃতির ভাপ।
ব্যালকনির টবে জমে আছে
জিওস্মিন, থেকে থেকে তা
গন্ধ ছড়ায়। চিলেকোঠার
ঘরে বাক্সবন্দী গান আর
হারানো সুর। ক্ষয়ে
যাওয়া মোমবাতি।
মেয়েদের ছোটবেলার কিছু
পুরনো জামাকাপড়।
হেক্সাগন ছোট জানালার
বাইরে ম্যাগনোলিয়ার
বেড়ে আসা শীর্ণ ডাল, ফুল
পাতা ঝরে গেছে শৈত্যে।
তার কাঠখোট্টা কাঠামোর
ফাঁকে রাস্তার ওপাশে
আমার ছাইরঙা বাসাটাকে
দেখছি। নাভাহো
ইন্ডিয়ানদের গ্রাম
থেকে কিনে আনা ক্রাফট
দিয়ে সাজানো আমার সবুজ
লনে উজ্জ্বল তারার মত
ফুটে থাকা হলুদ ডেইজি
বৃষ্টির মাঝেও আলো
ছড়াচ্ছে। বাসার ছাদের
লালরঙা দুই চিমনি বেয়ে
ধোঁয়া বেরুচ্ছে।
ফায়ারপ্লেসে উড দিয়ে
আগুন জ্বালিয়েছো
নিশ্চয়ই, পাশের নীল
আর্মচেয়ারটাতে বসে
উত্তাপ নিচ্ছো। পাশে
কফির কাপ। মেঝেতে
কুপারের সাথে রায়েন হাত
পা ছড়িয়ে বসে খেলছে।
কুপার আমাদের হাভানিজ
পুডল। তুমি একজন সুখী
বাবা। তুমি কী একজন
সুখী স্বামী? তোমাদের
সামনে হালকা টিউনে টিভি
চলছে। টেলিভিশন তো
প্রতিচ্ছবি। দূরবর্তী
পৃথিবীর কিছু শব্দ আর
প্রতিচ্ছবি বয়ে এনেছে
তোমার কাছে। টিভির এই
মানুষগুলোকে বাস্তবে
সচরাচর দেখাও যায় না।
অ্যামির চিলেকোঠার ঘরে
আমার দু’চোখে বাষ্প।
অ্যামির ফ্রন্ট
ইয়ার্ডে সাজিয়ে রাখা
রকিং চেয়ারটির মত,
আমাদের নীল আর্মচেয়ারও
কী, কোন একদিন, কাউকে ৬২৪
নম্বর বাসাটির গল্প
বলার অপেক্ষায় আছে?
আমার শীত শীত লাগছে।
বাড়িগুলোর শরীরী
অণু-পরমাণু পর্যন্ত
চরিত্র হয়ে এই গল্পে
ভিড় করছে। এই বৃষ্টি
থেমে যাবে। শীত শেষে
বসন্ত চলে আসবে
ক্যালিফোর্নিয়াতে।
চিমনি বেয়ে তখন ধোঁয়া
উড়বে না। টিভিতে আজ
দেখা নৃত্যরত
মানুষগুলোকে একসময়
ভুলেও যাব। তবে কিছু
নৃত্য হয়ত আজীবন নিউরণে
থেকে যাবে। অ্যামি
সেখানে মৃদু ছন্দে
অবিরাম নেচে চলছে।