দিনভর রোদের মুখ লুকানো
রইলো । কুয়াশারা প্রবল
ভাবে সাদা ,আরো সাদা।
দূরের গাছগুলো ভৌতিক
পদাতিকে স্থির অবস্থান
নিশ্চিত করে। এই অবস্থা
জেনেই খোলা পায়ে
বেরিয়েছি কোলাহলের
বিপরীতে একটা ফোন ধরবো
বলে। জানালার নামানো
কাচ তেমন একটা স্পষ্ট
দেখায় না বিরান
প্রান্তর। দু'একজনের
ইতস্ততঃ চলাচল ,
জুবুথুবু সঙ্কোচে
বিহবল । নামেমাত্র
ধরানো সিগারেটের
ধোঁয়াও জ্বলছে কিনা
বোঝা যাচ্ছে না এই
মাইনাসে। আমাকে
বিদ্রুপ করে আমার
অপেক্ষা, আমার
সর্বস্ব।
ঘাসের শরীরে পর্যাপ্ত
শীতল বোঝাপড়া পায়ের
রেখা স্পর্শ করে । যত
ঠান্ডা ভাবা যায় ততোটা
শীত নেই এই মুহুর্তে
বেশুমার। পাখিরা জটলা
ধরে উড়ে , জট পাকিয়েই বসে
পড়ে , ভাগাভাগি গাছের
পাতার শরীরে। কোনটা
পাতা কোনটাই বা পাখি ।
অতিথি পাখিরা মাঝে মাঝে
মানুষের মত রং চেহারা
লুকিয়ে লুকোচুরি খেলতে
ভালোবাসে ।
হাওয়া কিছু মৃদু ,শান্ত
তবে আছে সে গায়ে গায়ে।
বনভোজনের গাড়িগুলো
সারিবদ্ধ পৌছে গেছে
একদিনের ক্রয় করা
মনসংযোগে। অনেকের সাথে
মিশে থাকা মানুষেরা
নেমে পড়ে বাস থেকে ।
তারা হাত-পা ছড়ায় উদার,
যেন কেউ বেঁধে রেখেছিলো
সারা যাত্রায়।
এসি বাসগুলো ধীরে ধীরে
খালি হয়ে গিয়ে পাশাপাশি
ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে একটু
দূরে মাঠের প্রান্তে।
সারা শরীরে তাদের
নামগুলো বড়বড় করে লেখা
। আচ্ছা বাসগুলোকে , কি
কেউ নাম ধরে ডাকে ? ''এ্যই
ইরানি হীরা , এ্যই গ্রিন
লাইফ এদিকে এসো , থামো
মধুমিতা। তোমার অন্দরে
আসছি। ' তাদের নিজেদের
মধ্যে কোন জড়তা নেই । জড়
পদার্থের জড়তা জীবন্ত
মানুষের চেয়ে অনেক কম।
শিশুরা ছাড়া পাওয়া
মাত্র মাঠে দৌড় শুরু
করেছে। কি সুন্দর তীব্র
অথচ মোলায়েম রঙের
পুলওভার মাঠের প্রতি
কোনায় রঙ ছড়ায়। মায়েরা
সন্তানের পুলওভারের রঙ
খুঁজে নিয়ে সাথে সাথে
খাবার মুখে গুঁজে দিতে
দৌড়াচ্ছে। এই মাত্র
একলা থাকা মাঠে এত
মানুষ কোত্থেকে উদয় হলো
, পুরো শীতল পরিবেশ থতমত
খেয়ে গেছে। ফর্সা করে
রোদ চোখ মেলছে। যেন
কমলা শেডেড উলের গোলাটা
হাত ছুটে মাঠে গড়িয়ে
গড়িয়ে গড়াচ্ছে তাকে আর
ধরা যাচ্ছে না । অদ্ভুত
সুন্দর একটা দৃশ্য ।
এমন দৃশ্যেও মোবাইল
খুলে স্ক্রিনের দিকে
তাকালাম। নাহ কোন ফোন
নেই।
এতক্ষণ ধরে আবছা হয়ে
ধ্যনস্থ থাকা গাছগুলোর
চেহারা দেখা যাচ্ছে
এখন। গাছকে আমার
ধ্যানরত মূর্তি মনে হয়
। যেন তারা বছরের পর বছর
এক ঠায় দাঁড়িয়ে আছে
ঈশ্বরের বরের
অপেক্ষায়। এক সময় ঈশ্বর
তাদের বর দিলে তারা
অবস্থান ধর্মঘট
প্রত্যাহার করে নিয়ে
মানুষের মত স্বাভাবিক
হাঁটাহাঁটি শুরু করে
দেবে। এক পাড়ার গাছ
অন্য পাড়ায় যাবে।
স্বজাতির খবর নেবে।
নার্সারিতে গিয়ে গাছ
শিশুদের সময় মত টিকা
দেয়া হল কিনা খোঁজ
নেবে। মানুষের চেয়ে
গাছেরা অনেক ভাল মনের
মানুষ হতে পারতো।
পুকুরের বুকে
অপরাহ্ণের শাপলা ফুটে
আছে দিক আলো করে। দূর
থেকে জাতীয় ফুলকে
গ্রীবা উঁচু করে
দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মন
ভরে গেলো । হৈচৈ করে
সকলে নানা ভঙ্গিমায়
স্থির ছবি তুলছে ।
কিম্বা দল বেঁধে ভিডিও
। এখানে এখন আর একা হবার
সুযোগ নেই। আমি আস্তে
করে সরে এলাম শব্দের
চাঞ্চল্য থেকে । উল্টো
পথে হাঁটতে লাগলাম
অন্যমনস্ক পায়ে।
কিছুতে মন লাগছে না।
অনেক বছর পর তার
যোগাযোগের ইচ্ছে কেন হল
জানিনা। আমি কেন প্রবল
ভাবে নিষেধ করলাম না
সেটাও বুঝিনি। আসলে
ভেবেছিলাম পুরোনো
কিছুই আর মনে নেই। ফোনে
কথা হলে হবে নইলে না।
আলাদা কোন অনুভূতি কাজ
করেনি। সম্পর্ক যেখানে
তৈরী হতে হতেই ভেঙ্গে
গেছে , অপেক্ষা সেখানে
কিভাবে আসে। আমি কি
অপেক্ষা করছি আসলে?
মানুষের মন মানুষ বোঝে
না । দু'ফুট দূরত্বেও
বোঝে না দুইহাজার মাইলে
দূরত্বেও না।
অলস দুপুরে মন দিয়ে
গল্প হচ্ছে মহিলা মহলে।
নিষিদ্ধ সব গল্প ।
মেয়েরাও কম যায়না নিষেধ
ভাঙ্গায়। ঘর থেকে
বেরিয়ে পড়ে সারাদিন
বিভিন্ন আডায় , সঙ্গে
খাবারে অঢে্ল সেলফিতে ।
আসলে সে কিসে শান্তি
খোঁজে বোঝা যায় না
ক্রমাগত সেলফির আড়ালে।
সন্ধ্যার আগে আগেই ঘরে
ফেরে সন্ধ্যার পাখি।
স্বামী নামক মানুষের
টের না পাওয়া কে উপভোগ
করে চূড়ান্ত । পরের দিন
ফের কোন পোশাকে বের হবে
তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে
পড়ে। এই যে ধরা না পড়া কি
এক সময় নিজের কাছে ধরা
পড়ে না?
বেঁচে থাকার জন্য
সম্পর্ক না কি
সম্পর্কের জন্য বেঁচে
থাকে মানুষ । মনে পড়ছে
একজনের কথা সে রোজ
অফিসের পর আলাদা বাড়িতে
চলে যেত । সেখানে আলাদা
ছোট্ট সংসারের মতোই
আরেক সেট হাড়িপাতিল ,
পোশাক , সংসারের
সামান্য আয়োজন। সে
অনায়াসে পোশাক পালটে
রান্না করে গিটারে সুর
তুলতো আর অপেক্ষা করতো।
অপেক্ষার মানুষ এলে
তারা একসাথে ঠিক
সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত
বুনে থাকতো ।সন্ধ্যার
ঝিঁঝিঁ ধরা আলোতে কেউ
আর আউকে চিনতো না। তখন
আলাদা হবার সময় শুরু।
পেগের পর পেগ মদ না
খেয়েও এক প্রেমেই মানুষ
তীব্র মাতাল হতে পারে ।
তারা দুজন তীব্র
আকাংক্ষায় মিলে যেত বহু
দূর অনেকটা সময় ধরে।
দ্রুত কেটে যাওয়া সময়
থেকে ইচ্ছে না থাকা
সত্বেও ছেড়ে আলগা হয়ে
যেত দুজন। ক্লান্ত শরীর
টেনে নিয়ে পুরনো
অভ্যস্ততায় ফিরতো আবার
। সেখানে আগের ঝাড়বাতি ,
হাড়িপাতিল , ড্রয়ারে
পোশাক , টুকটাক গহনা,
কন্ট্রাসেভটিভ সব
গোছানোই থাকে । শুধু
বিছানাটা টান টান ।
তাতে কোন ভাঁজ পড়ে না।
একটা পর একটা মনে পড়ে
যাচ্ছে কথা।বলা যাবে না
লেখা তো নাই।
এই সংসারে অনেক সময়
অনেক সুযোগ কিন্তু
এতটুকু প্রেমের অভাবে
কাটতে চাইতো না প্রবল
রাত। সকালের অপেক্ষায়
থাকতো মেয়েটা
।অপেক্ষারা আসলে তার
কোন বাড়িতে বাস করে
বোঝা যায় না। এক বাড়িতে
থেকে অন্য বাড়ির তীব্র
প্রেম তালাশ করতে করতে
সে একসময় সে আর কাউকেই
চাইতো না। একাই বেরিয়ে
পড়তো উত্তরের যাযাবর।
জীবন যাপন এরকমই । কোন
ঘরেই সে আসলে পৌছাতো
না।
মেয়েরা একত্র হলে এক
আয়নায় মুখ রাখে। এক
কাজলে চোখ টানে। কপাল
জুড়ে গোল টিপ পড়ে বড়
দেখে। ঘর চেনা যায়
বারান্দা চেনা যায়।
সন্তান দেখে মায়ের
তদারকি বোঝা যায়।
ইদানিং বাবা'রাও কিছু
কিছু দায়িত্ব ভাগাভাগি
শিখেছে। বিকেলের শেষ
ভাগে গানের সময়টাতে
সদ্য মা হওয়া মেয়েটি
গাইছে গলা ছেড়ে , আনন্দ
নিতে সে শিখেছে প্রেমেই
। শিশুর ঘুম ভেঙ্গে
গেলে বাবা তাকে কোলে
নিয়ে থামাচ্ছে । এই
সমঝোতা দেখে
দীর্ঘশ্বাস ফেলে অসুখী
সেই অপেক্ষারত মেয়েটা।
সে শুধু এতটুকু মনোযোগ
চেয়েছিলো। সে শুধু কথা
না বলে পাশাপাশি বসে
থাকতে চেয়েছিলো শীতে কি
বসন্তের আগে আগে।
বিকেল নেমে যাচ্ছে
দ্রুত । গুমোট হয়ে আসছে
সব তাপ। শীত তার আসল
চেহারা নিয়ে এসেছে আগে
ভাগে। সকালের চেয়ে গাঢ
এখন কুয়াশার রঙ একে একে
খালি বাসগুলো ভরে
যাচ্ছে । দুই বেনী করা
শিশুরা এখন ঘুমন্ত ,মা
বাবার কোলে । কেউ এখনও
লাফাতে লাফাতে বাসে
চড়ছে , কেউ কিছুতেই যাবে
না এই বনভোজনের মাঠেই
থাকবে , পাখির সাথে গাছে
ঘুমাবে। ফোনের চার্জ
চলে যাচ্ছে দ্রুত লাল
আলোর সিগন্যাল দিচ্ছে।
আ্মি যাচ্ছি ,আমি
যাচ্ছি । আমি চুপচাপ
চলে যেতে থাকা আলোর
বিন্দুর দিকে তাকিয়ে
রইলাম। কোথাও কেউ নেই ।
মাঠের কোনায় কেবল স্তুপ
করা শুকনো পাতারা জড়সড়
হয়ে থাকে , তারাও আগুনের
অপেক্ষায় দিন কাটায় ।
বাসগুলো মাঠ ছেড়ে বিদায়
নিলো । একটু আগে যে
বনভোজনের ক্ষণিক
সংসারটা পাতা হয়েছিলো
তা গুটিয়ে গেলো। আমার
ফোন দপ করে নিভে গেলো
তার সমস্ত আশা এবং
আয়ুসমেত। গাড়িতে উঠে
যাবার আগ মুহূর্তে যেন
সারাদিনের অলসতা
কাটিয়ে ফোন হুড়মুড় বেজে
উঠলো। ''আমাকে কি আজ পাঁচ
মিনিট সময় দেবে ? একবার
শুধু দেখতাম । আজ ফিরে
যাচ্ছি ফের সমুদ্রে । ''
আমি ফোন কানে চুপ করে
আছি। কথা নেই । সময় জানে
সময় তাকে দেবে কি না।
সমস্ত জীবনী শক্তি
ফুরিয়ে যাবার পরও
উপেক্ষা কিংবা অপেক্ষা
শেষে, আই ফোনটা হঠাৎ
কিভাবে চমকে বেজে উঠলো
নাকি আদৌ বাজেনি, সে
কথাই ভাবছি ফের মাইনাসে
ফিরে যেতে যেতে।