বসুন্ধরা শপিং
কমপ্লেক্সের লিফ্টটি
তখন দ্রুত উঠে যাচ্ছিল
আকাশের দিকে। কাচের
ভিতর দিয়ে দূরে চলে
যাওয়া ঘুরানো সিঁড়ি আর
সাজানো দোকানগুলো
দেখতে দেখতে রত্না ঘুরে
দাঁড়িয়েছিল লিফটের
দরজার দিকে । আর ঠিক
তখনই লিফটের দরজা খুলে
গিয়ে যে মানুষটি
অপ্রত্যাশিতভাবে ঢুকে
পড়েছিল, আর অপ্রস্তুত
ভাবে দাঁড়িয়ে পড়েছিল
রত্নার সামনে, তার নাম
ফেরদৌস। ঝুলে থাকা
সময়টা হঠাৎ করেই রত্নার
সামনে একটা গল্পকে মেলে
ধরল। যার
কেন্দ্রবিন্দুতে
দাঁড়িয়েছিল রত্না
নিজেই। অনেক দিন পার
হবার পরও সেই মুহূর্তে
অনেক দিনের অল্প চেনা
মানুষটি তাকে
আপাদমস্তক চমকে
দিয়েছিল। তবু ভীষণ সহজ
ভঙ্গিতে রত্না কথা
বলেছিল, দ্রুত কন্ঠে
হেসেছিল ফেরদৌসের
পাশাপাশি হেঁটে যেতে
যেতে। রত্না অনুভব
করছিল তার কাঁটাতারের
বেড়া দেওয়া জীবন যেন
হঠাৎ রূপকথার পরির মতো
ডানা ফুলিয়ে উড়তে
চাইছিল হাওয়ায়
হাওয়ায়।
ফেরদৌসের যথেষ্ট তাড়া
থাকায় রত্না
ফুডকোর্টের দিকে আর গেল
না। বরং পাঁচতলায় এসে
বারান্দার এককোনের
ছোট্ট স্টলের কাছে
দাঁড়িয়ে কফি নিতেই
পছন্দ করল। রেলিংয়ে পিঠ
ঠেকিয়ে পাশাপাশি কফির
কাপ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে
ছিল ওরা। অনেক দিন আগের
একটা স্মৃতির ঢেউ যেন
নাড়া দিয়ে গেল রত্নার
শরীর ও প্রাণে। সেদিন
চারপাশে এমন নীরবতা আর
এয়ারকন্ডিশনের ঠান্ডা
হাওয়া ছিল না। আজিজ
মার্কেটে অনেক কোলাহল,
ভিড় আর গরমের ভিতর
ফেরদৌসের ধবধবে সাদা
শার্টের ভাঁজে ভাঁজে
লেপ্টে ছিল এমনি শরীরী
গন্ধ । সেই ঘোরের মধ্যে
সেদিনও তেমন কোনও কথা
ওরা কেউ বলতে পারেনি।
তখন চোখের ভিতর দুলছিল
এক মায়াবি বাগান আর এক
সর্বগ্রাসী অদৃশ্য
চোরাটান, যা দুজনকেই
অন্য কোনও ঠিকানায় নিয়ে
যেতে পারত। না,
শেষপর্যন্ত অন্য কোনও
ঠিকানায় যাওয়া হয়নি
তাদের। অন্য কোনও
ঠিকানায় যাবে কী করে? যে
কথাগুলো বলতে চেয়েছিল
দুজনে,তাইতো বলা হলো না!
নিজেদের ভিতরের এক
অন্তহীন নীরবতা ছিল
পুরো সময়টুকু জুড়ে। তবু
দীর্ঘদিন পর সেই
একইভাবে রত্না তার
বুকের ভিতর ভরে নিল
হাওয়ায় ভেসে আসা সেই
পুরোনো গন্ধকে নতুন
করে। আপাত স্থিরভাবে সে
দাঁড়িয়ে ছিল কিন্তু
ভিতরে ভিতরে টের
পাচ্ছিল আর চমকে উঠেছিল
নিজের মধ্যে এক
দ্বন্দ্বমুখরতাকে টের
পেয়ে। হায়, ফেরদৌস কি
টের পাচ্ছে এসব ভাবনা?
এসব সম্মোহন! বিবাহিত
জীবন আজ দুজনকেই দিয়েছে
স্থিতি। রত্না নিজের
ভিতরে ঝুঁকে আবার
নিজেকে দেখতে চাইল আর
একবার। নিজের ভিতর
লুকিয়ে থাকা এই কাঁপন
কী সত্যি? হ্যাঁ, সত্যিই
তো! সেই যে প্রথম
ভালোলাগার স্পন্দন! আজও
সেরকমভাবেই এতদিন পর
তার রক্তপ্রবাহে
তোলপাড় ঘটিয়ে দিচ্ছে!
কফির মগে ঠোঁট রেখে ওরা
দাঁড়িয়েছিল পরষ্পরের
কাছাকাছি, বাইরের দিকে
মুখ করে। আর উপর থেকে
দেখছিল যাবতীয় জটিল
আঁকাবাঁকা পথ, কাণাগলি,
ফুটপাথ। যে পথে সবাই
যাওয়ার দিকে যাচ্ছে।
কফি খাওয়া শেষ হবার
কয়েক মিনিট পরেই ফেরদৌস
যাবার তাড়া দেখাল, খুব
চমৎকার আর আয়েশি
ভঙ্গিতে একটা সিগারেট
ধরাল রেলিংয়ের দিকে পিঠ
ঠেসেই। সিগারেটটা
অর্ধেক শেষ করেই সে
দ্রুত চলে যাচ্ছিল
এমনভাবে যেন এতদিন পরের
এই চোখে চোখ রাখা,
পাশাপাশি হেঁটে চলা,
কফি খাওয়া সবকিছু
মিলিয়ে এই গভীর অনুভবকে
উপেক্ষা করার শক্তি সে
রাখে। রত্না এই অনুভবের
তাড়না নিয়ে দাঁড়িয়েছিল
আরও কিছুক্ষণ যতক্ষণ না
ফেরদৌসকে সে লোকের ভিড়ে
আড়াল হতে দেখছিল। তারপর
তার মনে হতে লাগল
সংসারের জটের ভিতর,
পরিত্যক্ত দালানের
ভিতর সে একটা পুরানো
পঁচা কাঠের মতই কী ছিল
এতদিন? না কি এ এক দারুন
বিভ্রান্তি!
২.
তারপরের কয়েকটি দিন
রত্না নিজেকে নিয়ে
ভাববার অবকাশটুকু ও পায়
না। সংসারের জটিল আর
কঠিন দিনগুলো কেটে
যাচ্ছিল ব্যস্ততায় আর
একঘেয়েমিতে, সবসময় যেমন
কাটে। চারপাশটা
সারাক্ষণই জটপাকানো।
ছেলেকে স্কুলেপাঠানো,
টিফিন দেয়া, বেয়াদপি
সামলানো, কোচিংয়ে নিয়ে
যাওয়া, বাজার করা,
শাশুড়িকে নিয়ে ডাক্তার
দেখানো, তিনবেলা
খাবারের বন্দোবস্ত
করা। রাতে ঘুমোবার আগে
চুল ঠিক করতে করতে
আয়নায় সে নিজেকে দেখে,
একজন মাকে দেখে, একজন
স্ত্রীকে দেখে। নিজেকে
দেখে না। এক অন্তহীন
আড়ালের মধ্যে একটা
দমবন্ধ পরিস্থিতিতে
সময়টা সবসময়ের মতো পার
হতে থাকে। তবু মাঝে
মাঝে কেমন যেন ফাঁকা
ফাঁকা লাগে তার, নিজেকে
খুঁজতে গিয়ে মনে হয় যেন
রত্না নামে কেউ নেই।
তার নিজের সাজানো
ফ্ল্যাট, হাজব্যান্ডের
যথেষ্ট টাকা, আত্মীয়জন,
কিছুই যেন তাকে স্বস্তি
দিতে পারছে না। রাতে
ঘুমোবার আগে সে তার
স্বামীর কাছ থেকে
মনোযোগ আশা করে ।
কিন্তু ভদ্রলোকটিকে এই
ব্যাপারে খুব বেশি
উৎসাহী মনে হয় না।
বেডরুমের নীল আলোটা
অদ্ভুত ক্লান্তিকর মনে
হয় তার। ভিতরে ভিতরে
একটি তীক্ষè আর্তনাদ
তার আত্মার ভিতর থেকে
জেগে উঠতে চায়। নিজ
অস্তিত্বের সংকটের
ভিতর থেকে। নিজের
ভিতরের সেই স্বরটি গভীর
অন্ধকারে তার
দ্বিধাগ্রস্ত শরীর আর
মনের উপর নিঃশব্দে পড়ে
থাকে।
আজকাল একটু সময় পেলেই
আনমনা হতে ইচ্ছে করে
তার। অথচ ফেরদৌসের সাথে
দেখা হবার কয়েকদিন আগেও
রোদ, বৃষ্টি বা মেঘলা
দিনে নিজের মধ্যে কোন
উদাসভাব টের পায়নি সে।
কিন্তু কয়েকদিন ধরেই
একটা অদ্ভূত তাড়নার
তীব্রতা ফাঁক পেলেই
নিজের মনের গভীরে তাকে
ডুবিয়ে দিচ্ছে। যদিও
নিজের ভিতর খুঁড়ে একরাশ
অবসাদ আর ক্লান্তি ছাড়া
কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না।
এতদিনের জীবনের স্রোতে
ভেসে চলা রত্না হঠাৎ
করেই যেন চারপাশে চরম
নৈঃশব্দ্য টের পেতে
থাকে। গোপন কান্নার মতো
সে সব নৈঃশব্দ্যের
বিষন্নতার মধ্যে ডুবে
থাকার ইচ্ছে হয় যখন
তখন। বিষন্নতায় বুঁদ
হয়ে থাকা রত্নাকে তার
পরিবারের কেউ তেমন
খেয়াল করে না।
একদিন চাঁদনি রাতে
রত্নার মনে হলো,
ফেরদৌসের মোবাইল থেকে
এখুনি একটি রিং বেজে
উঠবে তার জন্য। ওর দিক
থেকে ফোনটি সে
নিবিড়ভাবে আশা করেছিল ,
আর এও অনুভব করছিল যে,
ফেরদৌসের জন্য তার মন
পুড়ছে। মনে হল একি
স্বপ্ন না সত্যি?
ফেরদৌসকে তো সে কোনও
ফোন নাম্বার দেয়নি। বরং
ফেরদৌসই তার কার্ডটি
তাকে দিয়েছিল। আর সে
পরম যত্নে রেখে দিয়েছিল
তার ব্যাগের ভিতর।
চাইলেই কি সে ফোন করতে
পারত না! তবে সে করেনি
কেন? এখনি করতে পারে!
কিন্তু পরক্ষণেই মনে
হলো সে কি ফেরদৌসকে
কখনও দেখেছিল দেখার মতো
করে? সে আসলে কিছুই
দেখেনি, খোঁজেনি,
বুঝতেও চায়নি। ছিপছিপে
ঋজু নির্মেদ দীর্ঘ
শরীরের স্থির ও শান্ত
যুবকটিকে সে বুঝতে
পারেনি। আর তখনি ভুলে
যাওয়া দিনগুলির ভিতর
থেকে সে অন্য এক
ফেরদৌসকে পেতে চাইল ।
ভিতরে জেগে উঠল অন্য এক
অনুভব। কোনও এক বিগত
দিনের অন্ধকারের ভিতর ,
ফেরদৌসের সিগারেটে
জ্বলে থাকা গোল আগুনটার
ভিতর, সিগারেটের ধোঁয়ায়
এঁকে যাওয়া নক্সার
ভিতর। তখন লাইব্রেরিতে
বসে বসে বই পড়ার দিন ছিল,
ফেরদৌসের পাশে পা
ঝুলিয়ে বসে থাকার দিন
ছিল, হাসতে হাসতে সময়
পার করার দিন ছিল।
এতদিন এই অনুভবগুলো
কোথায় ছিল? তবে কী কালো
মুখোশের মধ্যে লুকিয়ে
রেখেছিল নিজেকে?
রাতে ঘুমুতে এসে সে আর
একবার টের পায় এক বিশাল
শূন্যতা। আলো-আঁধারিতে
ঘুমের ঘোরে ম্বামীর
হাতটি অভ্যাস মতো তখন
গায়ের পোশাকগুলো খুলে
নেবার তাড়া দিতে থাকে।
সেও তাড়াহুড়ো করে।
সবসময়ের মতো তাড়াহুড়ো
করে সঙ্গমে পৌঁছে যায়।
প্রক্রিয়াটিতে না থাকে
আনন্দ, না উপভোগ। মাঝে
মাঝে সে উপভোগের ভান
করে। স্বামীকে খুশি
রাখার এটি একটি দাওয়াই,
যাতে সে অন্য মেয়েতে
ঝুলে না পড়ে। কখনও কখনও
এই যান্ত্রিক সঙ্গম
তাকে গভীর হতাশায় নিয়ে
যায়। নিজের জ্বলে ওঠা
শরীরের প্রত্যেকটি
কোণকে সে স্পর্শ করে
পরম মমতায়।
সঙ্গমক্লান্ত
স্বামীটি তখন গভীর
ঘুমে। এক গভীর হতাশায়
সে নিজের শরীরের
প্রতিটি কোণে হাত
বোলায়। এপাশ ওপাশ করে ।
অদ্ভুত তাড়নায় ছটফট
করতে করতে তার মনে হতে
থাকে কেউ তাকে
ভালবাসেনি। ঘুমন্ত
স্বামীর দিকে তাকিয়ে
অন্য একটি শরীরকে সে
মনে মনে কামনা করে। চোখ
বন্ধ করে নিজের শরীরে
নিজের আঙুলের পরিচালনে
আবেশিত হতে হতে
ফেরদৌসকে ভাবে। উথলে
উঠে তার শরীরী
ভালোবাসা। ফেরদৌসকে সে
শরীরে নিয়ে আসে গভীর
অনুভবে ধীরে ধীরে। যেন
সে ধীরে চুম্বন করছে
তার গালে, কপালে, নাভিতে,
গভীরতায় আর ভালোবাসার
অধিকারে পৌঁছে যাচ্ছে
গভীর অতলে। সেই অন্তহীন
রহস্যময় গভীর অতলকে
কোনওদিন জেনেছে কি তার
স্বামী? অথচ কত
দীর্ঘদিন মিলিত হয়েছে
এই অভ্যস্ত দাম্পত্য!
আর সেই সব মিলনে
উচ্ছলতা ছিল, বিষণœতা
ছিল, আঁচড়-কামড়ও ছিল।
কিন্তু ভালোবাসা কি
ছিল? ছিল না। কখনও ছিল
না। নিজের চারপাশে
জ্বলতে থাকা
তৃষ্ণাগুলো রত্নাকে
আরও বিষাদগ্রস্ত করে
তোলে। ঘুম আসে না ।
রাত্রির গভীরতায় চোখ
বন্ধ করে পড়ে থাকতে
থাকতে ঘুমন্ত চারপাশের
ভিতর থেকে, টুকরো টুকরো
আলো অন্ধকারের ভিতর
থেকে, আর তার নিজের ভিতর
থেকে সে এক অন্য মেয়েকে
জেগে উঠতে দেখে। খুব
বিষণ্ণ এক মেয়ে নিজেকে
আবিষ্কারের আকাঙ্খায়,
নিজেকে পুন রুদ্ধারের
চেষ্টায় সময় ও বাস্তবতা
পেরিয়ে তাকে এক গোপন
সংকেতের দিকে ঠেলে দিতে
থাকে।
৩.
বৈবাহিক সম্পর্ক মানেই
এক গভীর বিশ্বাস আর
দীর্ঘস্থায়ী
ন্যায়পরায়ণতা বলেই
রত্না নিজের মধ্যে জেনে
নিয়েছে। তবু নিজের
মধ্যে তার চারপাশের
শিকল ভাঙার এক
দূর্নিবার চোরাটান সে
অনুভব করে।
নিত্য-নৈমিত্তিক
জীবনের বাইরের স্বাদ
তাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ
করতে থাকে। ছেলের
বন্ধুদের মায়েরা
রাতদিন ফেইসবুকের নতুন
সর্ম্পক নিয়ে আলোচনা
চালিয়ে যায়। কেউ কেউ
এসব সর্ম্পক কে মনে করে
বিশ টাকার ফুচকা খাওয়ার
মতো। কেউ কেউ আবার
শারীরিক আনন্দ উপভোগের
জন্য বিউটি পার্লারের
স্পা ও ম্যাসেজ
কর্নারগুলোতে নিয়মিত
শরীর ম্যাসেজ করিয়ে
থাকে। স্বামীর কাছ থেকে
যে মনোযোগ তারা পায় না,
তা তারা আদায় করে নেয়
এভাবে অনেক টাকা খরচ
করে আনন্দ কেনার মধ্যে
দিয়ে। রত্নার এসবের
কোনওটিই ভালো লাগে না।
দুধের স্বাদ ঘোলে
মেটানোতে সে নারাজ। বরং
সে খুঁজতে থাকে তার
শূন্যতার ভিতরের তরঙ্গ
, সে খুঁজতে থাকে সেই
অতলের খোঁজ, নিজের
ভিতরের এক অজানা
রহস্যময় জগত। সে বুঝতে
পারে না একি তার নিজের
জন্য নিজের প্রেম, না কি
ফেরদৌসের প্রতি তার
প্রেমের আকাক্সক্ষা?
তবে সে ধাবিত হয়।
নিজেকে ধ্বংস করে
নিজেকেই আবার নতুন করে
ফিরে পাবার
আকাক্সক্ষায় সে ধাবিত
হতে থাকে। ফেরদৌসের
কার্ডে থাকা ফোন
নাম্বারে সে যোগাযোগ
করে। আর পরবর্তীতে অতি
সাহসিকতায় লিপ্ত হতে
থাকে ফেরদৌসের সঙ্গে
রহস্য নির্ভর
সম্পর্কে। প্রায়ই সে
নীরব অবসরে ফোনে কথা
বলে আর সেই সব ভালো
লাগার বার্তা মুহূর্তে
পৌঁছে যায় শরীরের কোণে
কোণে। জীবনে আবার যেন
বসন্ত আসে। তার সুগন্ধে
ভরে ওঠে চারদিক। সে হয়ে
ওঠে লাবন্যময়ী। আচরণে,
ব্যবহারে তা ছড়িয়ে পড়ে
পরিবারের সবদিকে। ফুটে
ওঠা ফুলের সৌন্দর্যকে
জোর করে ভোগ করতে চায়
তার স্বামী। কিন্তু
রত্না জানে এই শরীরী
সর্ম্পকে সম্পূর্ণ সরে
দাঁড়িয়েছে তার মন। আর
এই উদাস ভঙ্গিটি
স্বামীটি টের পেতে ভুল
করে না। কাম আর ক্রোধকে
একত্র করে সে দখল করে
নেয় রত্নার শরীর।
তৎক্ষণাৎ লোকটিকে তার
অচেনা মনে হয়, মনে হয়
ফেরদৌসের সাথে
সম্পর্কের বোঝাপড়া না
হওয়া পর্যন্ত তাকে
এমনভাবেই নিয়মিত
ধর্ষণের শিকার হতে হবে।
তার মনে হতে থাকে... বিয়ে!
কী জটিল! কী ঠুনকো ! কী
সাংঘাতিক! কী
অস্বাভাবিক অবস্থা যে
চাইলেও এর বাইরে সে
যেতে পারবে না। সবকিছু
মিলিয়ে নিজের মনে নিজের
জন্যই ক্ষোভ, ঘৃণা,
বিরক্তি জমা হতে থাকে
পাশাপাশি।
তবু সময়ে অসময়ে
ফেরদৌসের ঋজু, সুগঠিত
সুন্দর শরীরটি তার মনের
মাঝে হানা দেয়। আর সেই
মানুষটির পাশে নিজেকে
দাঁড় করানোর জন্য সে
রাতদিন নানা যুক্তি
খুঁজে বেড়ায়। তার বুক
দূরু দূরু করে ,দম আটকে
আসে। এর মধ্যেই
ফেরদৌসের এস এম এস টি
আসে: ‘ফোনে আর কত কথা
বলব! আমরা কবে দেখা করব!’
লাইনটি যেন তাকে জাপটে
ধরে চুমু খেল, তার শরীর
কাঁপলো থরথরিয়ে। এখনও
যৌবন আছে! আয়নায় নিজেকে
খুঁটিয়ে দেখে সে। কোথায়
হারিয়ে গেছে সেই কবেকার
সাদা, সুন্দর, ক্ষীণ, নরম
, সুগঠিত শরীর! স্ফীত
পেটের উপর বিপুল
স্তনভার, বিশাল নিতম্ব,
মেদ আর মাংস মিলিয়ে
নিজেকেই বিবমিষা লাগতে
থাকে। এসব বাস্তবতা
তাকে দিশেহারা করে দেয়।
এসব মেদমাংস পেরিয়ে
ফেরদৌস কী খুঁজে পাবে
তার অতল মনের ঠিকানা! আর
নিজেকেও সে আচমকা ভয়
পেতে থাকে। তার ভয় হয়
প্রেমের স্পর্শে সে নদী
হয়ে উঠবে। আর কখনও
ফিরতে পারবে না উৎস
স্থলের দিকে। সে ভয়ে
ভয়ে ফিরে তাকায় সংসারের
বৃত্তে। ফেরদৌসের
এসএমএস-এর উত্তরে সে আর
কিছু বলতে পারে না। তার
নিজের মধ্যে ক্লান্তি
অনুভব করতে করতেই কখন
যেন দোদুল্যমানতার
ভিতর প্রতিশ্রুতিহীন
এই রহস্যময় সম্পর্ক
অতি দ্রূত হারিয়েও
যেতে থাকে।
৪.
পরিবারের সবার
অস্তিত্বের মধ্যে
সহজভাবে সে মিশে থাকে
রাত্রিদিন। তবু সে টের
পায়, তারই অন্য একটি
প্রতিচ্ছায়া একা একা
নিঃশব্দে ঘোরে সমস্ত
ব্যর্থতাকে বুকে নিয়ে।
সেই হাহাকার এসে মিশে
যায় তার স্বপ্নের ভিতর,
স্মৃতির ভিতর।
শরীর ও সংকেত গল্পটির
সূত্র মাথার ভিতর রয়ে
গিয়েছিল অনেক আগে
থেকেই। চারপাশে দেখা
নারীদের মধ্যে এক
অদ্ভুত মনস্তাত্ত্বিক
সমস্যা টের পেতাম। এরা
নিজেরাও হাতড়ে বেড়াতো
তাদের সমস্যাটিকে।
এদের অধিকাংশই অতি
সচ্ছল পরিবারের
শিক্ষিত গৃহবধু। ওদের
জীবনও খুব সাজানো
গোছানো। তবু অদ্ভুত এক
একাকীত্ব এরা বয়ে বেড়ায়
। আর এর থেকে পরিত্রান
পাবার জন্য নিজেকে মাঝে
মাঝে ভেঙে আবার নতুন
ভাবে গড়ার স্বপ্ন দেখে।
আমার গল্পের রত্না
চরিত্রটি নিজের
স্বরটিকে চিনবার
চেষ্টা করে। এবং একসময়
সে চিহ্নিতও করতে পারে
তার শরীর ও সংকেত কে।
নীরস ব্যস্ততা আর
একঘেয়েমি ভরা জীবনের
মধ্যে নিজেকে খোঁজার এক
অদম্য যাদুটান সে অনুভব
করে নিজের ভিতর । নিজের
ভিতর নিরন্তর শুনতে পায়
দূরের ডাক। আর এই অসীম
যাদুটানের মধ্যে
উন্মুখ ও অধীর ভাবে
আবিস্কার করে তার
ভালবাসাকে। সে ভাঙতে
চেয়েছিল তার
সীমাবদ্ধতা। কিন্তু
বিয়ে নামক খাঁচার ভিতরে
বন্দী জীবনের আনুগত্য
পালন আর নিরন্তর
ঘুরপাককে সে অতিক্রম
করতে পারেনা । নিজেকে
আবিস্কারের পর বিয়ের
অনিবার্য শরীর নির্ভর
সম্পর্ক তার কাছে
অসহনীয় হয়ে ওঠে। তার
অর্ন্তগত চেতনায়
সঞ্চিত হতে থাকে সমুহ
বিষণ্ণতা । তবুও সে
এ্যাকোরিয়ামের মাছের
মতোই চাকচিক্যময়
নিশ্চিত অর্থহীনতার
মধ্যেই পড়ে থাকে
।চারপাশের দেয়ালকে
অতিক্রম করে নিজের
জীবনে অন্য যোগসূত্র
ঘটাতে পারে না।
এই গল্পটি লিখার সময়
আমি প্রথমে ডায়লগ
ব্যবহারের চিন্তা
করেছিলাম । পরে মনে হল
বর্ণনামূলক হলেই ভাল
হয়। বাস্তবের
সীমাবদ্ধতা আর
স্বপ্নের বিস্তৃতির এক
দ্বান্দ্বিক পটভূমি
নির্মানে আমি
বর্ণনাকেই আশ্রয়
করেছি।