রাজা একদিন ফিরে আসবেন
। এই যে
ডুংরি-নদী-মাঠ-ক্ষেত-
গাছপালা, এই যে
মানুষ-ছাগল-গরু-কুকুর-
সাপ-গিরগিটি, এই যে
হাওয়া-জল আকাশ এই
সবকিছুর মালিক তিনি, সব
কিছুর রাজা ফিরে আসবেন
একদিন । তারপর নিজের
সম্পত্তি তিনি দখলে
নেবেন । পুকুরের জল,
গাছের ফল, মাঠের ধান সবই
তো তাঁর । আমাদের যা আছে
আজ সবই তাঁর, এমনকি
আমরাও । তিনি এলে সকলই
তাঁর চরণে রেখে আমারা
তাঁর দাস হয়ে যাব একদিন,
রাজা ফিরে আসবেন,
আসবেনই ।
এই কাহিনি
মুকুন্দপুরের সবাই
জানে। চাষী যখন লাঙল
দেয় স্মরণ করে তাঁকেই,
যখন ফসল কাটে মনে মনে
তাঁকেই উৎসর্গ করে।
নতুন চালের পিঠে বানিয়ে
প্রথমটা তাঁর নামেই
নামিয়ে রাখা হয় চুলার
আগুনে ।
সে অনেকদিনের কথা ।
তিনি একদিন ঘোড়া ছুটিয়ে
রাজ্য ছেড়ে চলে
গিয়েছিলেন। তখন টটকো
নদী গাঁয়ের কাছ দিয়ে
বইত । যাওয়ার আগে তাঁর
সাদা ঘোড়া জল খেয়েছিল
মুকুন্দপুরের ঘাটে।
তারপর নদীও সরে গেছে
ফুলবেড়্যার দিকে ।
মাঝেমাঝে রাত্তিরে চর
থাকে ঘোড়ার ডাক শোনা
যায়, মাঝেমাঝে ক্ষুরের
ঠুক ঠুক। বুঝতে পারি,
তিনি বাহনকে পাঠিয়ে খবর
নিচ্ছেন ।
যাওয়ার আগে এই যে
কিঙ্কর আছে না, ওই যে
ছাগল চড়াচ্ছে জঙ্গলের
ধারে, ওর বাবা সাধুচরণ,
তাকে, না তাকে না, সাধুর
বাবা সত্য, হয়তো তাকে,
অথবা তাকেও না, তার
বাবাকে, অথবা তার
বাবাকে... মোট কথা ওদেরই
বংশের কাউকে তিনি ডেকে
বলে গিয়েছিলেন যে তিনি
আসবেন, ততদিন সব সামলে
রাখতে। তার গায়ে হাত
বুলিয়ে এঁকে দিয়েছেলেন
রাজত্বের সীমানা, লিখে
রেখেছিলেন সংকেত, মাটির
নীচে কোথায় আছে তাঁর
প্রাসাদ, কোথায়
গুপ্তধন।
সেইসব আঁকিবুঁকি এখন
কিঙ্করের গায়ে । তার
যখন ছ বছর বয়স হল গুণীন
এল ঘাটশিলা থেকে ।
রাসপূর্ণিমায় চাঁদ
সেরাতে মাঠঘাট জগিয়ে
রেখেছে। অসময়ে স্নান
করে বাচ্চাটা কাঁপছে,
ন্যাংটো। সামনে তার
বাবাও ন্যাংটো। বাবার
শরীর দেখে দেখে তার
বুকে-পিঠে-হাতে উল্কি
করা হল, হুবহু একরকমের
উল্কি, রাজা তা দেখে
চিনে নিতে পারবেন তাঁর
রাজত্ব, একদিন। তার যে
ব্যাথা হচ্ছিল না এমন
না, কিন্তু এই দায়িত্ব
তো শুধু তার, তার
বাপঠাকুর্দার, সে জানে
।
সে এখন অপেক্ষায় আছে,
কখন রাজা আসবেন। তার
বাবাও মরে গেছে গেল
বর্ষায়। এখন কেবল সে-ই,
শুধুমাত্র তার শরীরেই
রয়েছে সংকেত । ছাগল
নিয়ে জঙ্গলে যায়, একটি
জোড়্গাছের তলায় বসে
থাকে, গাঁয়েরই আর কেউ
এলে একসাথে ছাঁচপাঁচ
খেলে । মাঝেমধ্যে জামা
খুলে ঘুরে বেড়ায় । বলা
তো যায় না, হয়তো একটা কাক
তার শরীরের উল্কি দেখে
যদি উড়ে গিয়ে যদি তাঁকে
খবর দেয় ।
তিনি এলেই তো কিঙ্করের
দায়িত্ব খালাস ।
তিনি এলেই তো এই সবকিছু,
আকাশ অব্দি সবকিছুই
তাঁর হয়ে যাবে।
তবে কিঙ্করদের যে ছোট্ট
কুঁড়ে, তা-ও কি নিয়ে
নেবেন তিনি ! তার
ছাগলগুলো জল খায় যে
জোড়টায় তা-ও ! বিকেলে যে
ভটাদসিনির মাঠে খেলে
তারা, তাদের কালো গরুটা,
ইস্কুলের পেরিয়ে ডুংরি,
মাঠের আধপাকা ধান,
আকাশের সূর্য, মেঘ,
বৃষ্টি –সব কাড়িয়ে
নেবেন তিনি!
তবে কী আর থাকবে তাদের!
কী আর পড়ে থাকবে !
নিজেকে খুব অপরাধী মনে
হয় কিঙ্করের । চোখে জল
আসে, গা গুলিয়ে ওঠে।
নিজেক খুব অপরাধী মনে
হয়, সে যদি না থাকত, তার
শরীরে যদি এইসব ছাইপাঁশ
আঁকা না থাকত রাজা তো
কিছুরই হদিস পেতেন না।
খুব রাগ হল নিজেরই ওপর
।
পাথর দিয়ে বুকের ওপর
ঘষতে থাকল, এই দাগগুলো
মিলিয়ে ফেলতে হবে। না,
কিছুতেই মুছছে না।
জোরে, আরও জোরে ঘষতে
লাগল সে। আরও বড়ো বড়ো
পাথর নিয়ে এল, ঘষেই
যাচ্ছে ।
আজ আর কেউ জঙ্গলে
আসেনি। সে একা, কেউ তাকে
দেখছে না।
একসময় তার গায়ে আগুন
জ্বলে উঠল, ঘষা লেগে
লেগে । আর সে আগুনে
পুড়তে থাকে তার চামড়া,
চামড়ার নীচে মাংস,
মাংসের নীচে হাড়, তার
প্রাণ্টুকু। ব্যাথা যে
হচ্ছিল না এমন না,
কিন্তু সে জানে,তার
শরীর পুড়ে গেলে আর কোনো
চিহ্নই থকবে না, আর কোনো
ভয় থাকবে না
মুকুন্দপুরের ।
সে জ্ঞান হারানোর আগে
আকাশে তাকিয়ে দেখল
সূর্য অস্ত যাচ্ছে,
আকাশও পুড়ছে ।