প্রতীক্ষা দুটি
বিড়াল-প্রজাতির মাছের
নাম—গায়ে আঁশ নেই। ফলিত
গণিতের খাতার ভিতর
প্রকাণ্ড শীতকাল হয়ে
আছে। এই জানুয়ারির শীতে
দেখো আমাদের
ছাতিমগাছটা ফুলসহ ভিজে
যাবে পাগল কুয়াশায়।
একটা শীতাতুর কুকুর
ফুটপাথ থেকে তাকিয়ে
দেখবে গাছটার পাতায়
কেমন নিয়ন আলো এঁকে
রেখেছে ছেড়ে আসা পথের
ক্ষত। সে নিয়ন আলোর
খোঁজে শহরময় ঘুরে বেড়ায়
নিজের সঙ্গে। আর
জিবরানের তিনটি পিপড়া
অবশেষে লিলিপুটের দেশে
ঢুকে পড়ে।
রুদ্রাক্ষের একটি মালা
তার প্রতীক্ষায় ঝুলে
ছিলো বহদূর পশুপতির
মন্দিরে নিদারুণ একা
একা। সেও জেনে এসেছে
পাতার বর্ণিল রং, লাল আর
হলুদ পাতার শিরায় বয়ে
যাচ্ছে পৃথিবীর প্রাণ।
জেনেছে কী মুদ্রায়
মীনদল সন্তরণে বাজায়
অলোক ঘুঙুর। চোখের ভিতর
কেমন করে টলটলে দিঘি
নিয়ে ঘুরে বেড়ায় চিত্রল
হরিণ তাও জেনেছে। জলের
পরতে স্পর্শ এঁকে নদীকে
করে সে মহিমাময়।
এইখানে দূরে আকণ্ঠ
চুম্বনের পাখিরা
বৃক্ষহীন বনে বনে
প্রান্তরের তৃষ্ণাকে
ডাকে আরো আকাশের তলে।
আকাশ বলে তো আসলে কিছু
নেই। তবু আমরা পর¯পর একই
আকাশে বিছিয়ে দিই চোখ।
মাথার ওপর রোদ। আর
সারাটা দিন তার
প্রতীক্ষায় থাকে পথ।
ভাবে, সে আসবে। বুকের
পরে কোমল ছায়া ফেলে
হেঁটে যাবে। সে যখন
আসে—সন্ধ্যা নামে। পথ
জানে তার ক্লান্তি। সে
এসেছে। কিন্তু পথ তাকে
নেয় না। কেনো না সে তখন
ছায়াহীন।
অনতিদূর ঘাটে বাঁধা নদী
কার প্রতীক্ষা করে?
কোনোদিন রাত্রি তাকে
দংশন করে। পৃথিবীর অন্য
কোথাও আনন্দ বুঝি!
বাইরে দূরে পড়ে আছে
বাহির। কারও অলক্তরাগ
পদমূলে জ্বলে স্মৃতি।
আমি জিজ্ঞাসার অতীত
খুঁড়ি। সেতো তেমনই আছে।
নদী আছে তারপরও
প্রতীক্ষারত। উত্তরের
সমস্ত গন্ধ এসে পড়ে।
আমি থাকি, থাকে সেও।
এভাবেই বিভেদ হওয়া
ভালো। বাহিরে দূরে
কোথাও যন্ত্রণা আনন্দ
হয়ে আছে।
সকল সম্ভাবনার পাশে যে
গীতবর্ণ শূন্যতা
দাঁড়িয়ে থাকে—তার কথা
আমি জানি। তাকে আমি ঘুম
আর স্বস্তির বীজ দিলাম
দুইটি করতলে। সে মাটি
খুঁজে পেলো না। কোথায়
করবে বপন? যে পথে হেঁটে
গিয়েছে চলে সুদীর্ঘ
পথ—সেই পথের আমিÑ তাকে
শেখালাম পথচলা। সে
স্থির পড়ে আছে শরীরের
ভিতর অস্থির এক
সুন্দরতা নিয়ে। পথচলা
যে বিফল তা জানতে হয়
হেঁটে হেঁটে একদিন।
একদিন জানা যাবে
কোনোদিন আর ভোর হবে না।
চোখের বুকের রক্তের
যন্ত্রণা নিয়ে সে পড়ে
থাকবে অমর একটি
প্রতীক্ষায়। শয্যা তার
কণ্টকিত মনে হবে তখনও।
তার দুইটি হাতের ভাঁজে
ঘুম আর স্বস্তির বীজ
শুকিয়ে যায়। মৃত্তিকার
সন্ধান মেলে না। কোথাও
পড়ে থাকে পরতে পরতে
উর্বর মৃতল—সে তা জানে
না। সন্ধ্যার অমরতা
ঝুলে থাকে দিগন্তের
ডালে। তাকে আমি
সম্ভাবনার কথাই বলেছি
একদিন চিরদিন। বলিনি
এখানে অশোধিত থাকে থেকে
যায় মৃত্তিকার ঋণ।
চুলের রং রাত্রি হয়ে
আছে। চুলেরও প্রতীক্ষা
থাকে ঝড়ের। আকাশ বলে তো
আসলে কিছু নেই। আকাশ
মানে মহাশূন্যতা। তাই
আমরা যখন আকাশ আঁকতে
যাই তখন আসলে একটুখানি
মেঘ আঁকি। সে অনেকদিন
আঁকা ভুলে গেছে মেঘ,
ভুলে গেছে গিটারের তারে
তুলতে দীঘল মেঘমল্লার।
ওখানে কী ছিলো জানি না।
হয়তো গান ছিলো নীল, ছিলো
দিনের বিপরীতে বাড়ন্ত
রাত্রি। আর সোডিয়াম
আলোয় পুড়ে যাচ্ছিলো
আমার চোখের পাতা। আর
সোডিয়াম আলোয় পুড়ে
যাচ্ছিলো তার চোখের
পাতা। আর প্রতীক্ষায়
থাকি চিরদিন
চিরদিন—তার সঙ্গে দেখা
হবে কোনোদিন, সমুদ্রের
ঢেউয়ের ওপর দিয়ে হাঁটতে
হাঁটতে। আমরা সেই
সমুদ্রের ধারের কাঠের
তৈরি আকাশছোঁয়া একটি
ওয়াচিং টাওয়ারে
পাশাপাশি দাঁড়িয়ে
থাকবো, দাঁড়িয়ে থাকবো
অন্তত একটি জীবন। আমরা
পরস্পর নিজেদের স্পর্শ
করবো না ঠিক, কিন্তু
স্পর্শেও প্রতীক্ষা
থাকবে রাতুল।
তার ভুল হাতে ধরা
আয়না—আয়নার ভিতর
কুয়াশায় মোড়ানো তার আর
আমার মুখ দৃশ্য হয়ে
গেছে। প্রতীক্ষায় থাকি
আমরা জন্মান্ধ পথগুলির
বুকে পায়ের রেখা লিখে
ঘুরে বেড়াবো। সমুদ্রের
পিঠেও ছাপিয়ে দেবো
আমাদের পায়ের পাতা।
পায়ে হেঁটে পেরিয়ে যাবো
সকল বন্দর আর পানির
স্তর। তারপর, তারপর
কোনোদিন দেখা হবে কোনো
এক উন্মাদ-প্রেমিকার
রক্তের ভিতর চিরদিন।