আমার দুই বছরের বাচ্চা
মেয়েটা আমার লেখার
টেবিলে এসে সংবাদ দিয়ে
গেলো, একটা সাদা
রাজহাঁস আর একটা সাদা
শেয়াল আমাদের
শিউলিতলায় খেলা করছে।
আমি লাফ দিয়ে উঠে তাকে
থামাতে চাইলাম কিন্তু ও
চলে গেলো শিউলিতলার
দিকে। আমি আর ওদিকটা
গেলাম না কিন্তু একটা
সাদা শেয়াল আর সাদা
রাজহাঁস আমিও যেনো
দেখতে পেলাম। আর দেখতে
পেলাম আমার মাকে, যে
ছিলো দারুণ
নৈসর্গপ্রিয় এবং সে এখন
জীবিতের বাস্তবতা থেকে
গত হয়ে গেছে। আমি আসলে
তাকে মুহূর্তের জন্যও
ভুলি না, কারণ সে আমার
নৈসির্গিক জীবনের
রূপকার। যদিও তাকে নিয়ে
একদম শৈশবের কথা আমার
মনে পড়ে না কিন্তু সত্য
হলো সকল শিশুর শৈশবের
ইতিহাস আলাদা কিছু না।
তখন আমি আরেকটু বড়ো,
যদিও তখনো আমার গা থেকে
শৈশবের সোনারোদের
সবটুকু ঝরে পড়ে নাই।
তবে আধো আধো গল্প শোনার
দিন শেষ হয়েছে ঠিক। মনে
পড়লো, আমাদের শিউলি
তলায় বসে বসন্তের জোসনা
দেখতে দেখতে মা আমার
চুলে আঙ্গুল বুলিয়ে
দিয়ে আদর করলেন আর
বললনে, সুবু, তোর আরো
ছোটো বেলার গল্প বল তো
যে গল্পগুলো তোর মনে
পড়ে?
আমি অনেক স্মৃতি
হাতড়ালাম অনেক গল্পের
কথা মনে করার চেষ্টা
করলাম, কিন্তু মনে পড়লো
একটা মাত্র গল্প। মাকে
বললাম শোনো তবে একটা
গল্প। নূরেনাহারের
বিলে একবার অনেক অতিথি
পাখি বেড়াতে এসে মারা
পড়লো। মামা বললো চল নীল
পালক কুড়িয়ে দেবো তোকে।
আমি আর মামা মাটির সরু
পথ দিয়ে দুপুরের রোদে
বিলে এসে দেখলাম কোথায়
পালক, সেখানে কোনো
পাখিই আসলে নাই। আমরা
ফিরে আসতে লাগলাম যেই
তখন দেখতে পেলাম একটা
সাদা গরু মাঠে চিত হয়ে
পড়ে আছে। আর আকাশ বেয়ে
অসংখ্য শকুন নেমে এসে
মৃত সাদা গরুর উপরে পড়ে
খুবলে খুবলে মাংস
খাচ্ছে।
এটুকু বলে আমি আর কিছু
বলতে পারলাম না।
কিন্তু মা আমার দিকে
অপলক চেয়ে থাকলো
কিছুক্ষণ, কিছুই বললো
না। আমি হয়তো তখন অন্য
আরেকটা গল্প ভাবতে শুরু
করে দিয়েছিলাম আর
শিউলির সবুজ পাতার আধো
আধো আড়াল থেকে জোসনা
দেখছিলাম। তখন মা চিকন
স্বরে কান্না জুড়ে দিলে
আমি একটু অবাক হলাম
কিংবা হলাম না। কারণ
কিছুদিন হলো মা নাকি
তার মানসিক ভারসাম্য
হারিয়ে ফেলেছে তাই কতো
অদ্ভুত সব কাণ্ড সে
করছিলো। আমি তাই মায়ের
চিকন স্বরের দীর্ঘ
কান্না শুনতে শুনতে,
বসন্তের চাঁদ দেখতে
দেখতে ছোটো ছোটো ভাবনা
নিজে পড়ে থাকলাম।
কখন যে মায়ের কান্না
থামলো ততোক্ষণে আমার
বুঝি ঘুম ঘুম পাচ্ছিলো।
তাই ঘোরের মতো একটা
প্রচ্ছন্ন জগত আমার
চোখের উপরে কুয়াশার মতো
ঘুরছিলো। তখন মা কথা
বলে উঠলো।
শোনরে সুবু, তোকে ঘুম
পাড়ানোর সময়, আদর করার
সময় কোনোদিন আমি কুৎসিত
কিংবা ভয়ের কোনো গল্প
বলি নাই। আর তুই আমার
সেই সুবু, এসব কুৎসিত
গল্প কোথায় পেলি বল? তোর
স্মৃতিতে কেনো এমন
কুৎসিত গল্প ঘর বাঁধলো।
তোর কি মনে পড়লো না একটি
ডালিম ফুল আর নীল
প্রজাপতির বন্ধুত্বের
গল্প? যে গল্প শুনিয়ে
কতো রাতে সন্ধ্যায় তোকে
ঘুম পাড়াতাম। কিংবা
একটা সাদা শেয়াল আর
একটা সাদা রাজহাঁসের
গল্প। যে রাজহাঁস ছোটো
বেলায় দেখতে ভালো ছিলো
না কারণ তার পালক ছিলো
না তখন, আর শরীরজুড়ে
জড়ানো চামড়া দেখে
প্রতিবেশিরা তাকে
তাড়িয়ে দিলো। আর ছোট
রাজহাঁস খুব মন খারাপ
করে বনে চলে এলো। তখন পথ
হারিয়ে ছোটো একটা সাদা
শেয়াল বনের পথে বসে বসে
কাঁদছিলো। তারপর তাদের
দেখা হলো আর তারা আপন
আপন কান্না ভুলে গেলো
বেদনা ভুলে গেলো। তারা
প্রাণের চেয়েও অধিক
বন্ধু হলো আর পৃথিবীতে
শান্তির জন্য সুন্দরের
জন্য কাজ করলো। তারা
পৃথিবীতে এই মত প্রচার
করলো যে, পৃথিবীতে কোনো
কুৎসিত নাই। পৃথিবীর
সবকিছুই সুন্দরের আর
শান্তির।
এই ঘোষণা দিকে দিকে
প্রচার হয়ে গেলে আর
পৃথিবীময় শান্তি ও
সুন্দরের বাতাস বইতে
থাকলে দারুণ খুশি হয়ে
মর্তে ঈশ্বর নেমে এলো।
ঈশ্বর এসে খুব আয়োজন
করে একটি অভিষেক
অনুষ্ঠানের আয়োজন
করলো। সেখানে সাদা
শেয়াল আর সাদা
রাজহাঁসের শান্তি ও
সুন্দরের দূত হিশেবে
ঘোষণা করলো। এরপর থেকে
সাদা শেয়াল আর সাদা
রাজহাঁস শান্তি ও
সুন্দরের উদ্দেশ্যে
পুরো পৃথিবী যাত্রা
করতে লাগলো। তাদের এই
যাত্রা কোনো দিন থামে
নাই থামবে না। দেখিস
সুবু, আমাদের এই শিউলি
তলায় একদিন নয় শুধু, সেই
সাদা শেয়াল আর সাদা
রাজহাঁস বারবার এসে
পৌঁছাবে শান্তি ও
সুন্দরের বার্তা নিয়ে।
তুই সেদিনের অপেক্ষা
করিস আর মন থেকে এসব
কুৎসিত গল্প মুছে
ফেলিস, সুবু আমার, তোর
ঘরে সেদিন ফুটে থাকবে
এক নৈসর্গিক ফুল।
তখন, এই গল্প আমার কাছে
অচেনাই মনে হলো যদিও মা
নাকি অসংখ্য বার আমাকে
শুনিয়েছে। কিন্তু
তারপর কতো জীবন পেরিয়ে
এলাম আর পৃথিবীতে কতো
দুর্যোগ অসুন্দর আর
অশান্তির সাক্ষি থেকে
গেলাম, এই গল্প তবু আমি
ভুললাম না। যদিও জানি
এটা বিশ্বাস
অবিশ্বাসের গল্প নয়
তবু, এই পৃথিবীতে এমন
গল্পের কেন জন্ম হয় না
তার অপেক্ষা হয়তো করি।
আর অপেক্ষা করি বলে
আমার দুই বছরের মেয়েকে
কতো সুন্দরের গল্প করি।
ওর মনে সত্যিই কোনো
কুৎসিত গল্প নাই।
কিন্তু সাদা রাজহাঁস আর
সাদা শেয়ালের গল্পও
কোনো দিন ওকে বলি নাই।
আর দুবছরের কন্যা আমার
আমাদের শিউলিতলায় সাদা
রাজহাঁস আর সাদা
শেয়ালের দেখা পেলো।
আমার এই হিরের টুকরো
কন্যা যে কিনা নৈসর্গিক
ফুল, সে না থাকলে হয়তো এই
সাদা রাজহাঁস আর সাদা
শেয়ালের দেখা পাওয়া
যেতো না। আমি আসলে
মায়ের দেখানো পথে
সত্যাসত্য হয়তো চলতে
পারি নাই। কিংবা আধেক
পেরেছি আর আধেক পারি
নাই। আমার মনেও থেকে
গেছে অসুন্দর কতো গল্প।
কিন্তু আমিও মায়ের মতো
নৈসর্গ ভালোবেসে কতো
সম্পর্ককে না বোধক টিক
দিয়েছি। তাই আমি শহরে
যাই নাই যে শহর আমায়
সোনার মতো চোখ নিয়ে
ডেকেছিলো। কারণ
ধূসরপ্রিয় শহরের বুকে
কোনো নৈসর্গিক হাহাকার
নাই।
আমার কন্যা, যে আসলে
নৈসর্গিক ফুল আর তার
বিষয়ে যে বলেছিলো সে
আমার মা, সে হলো এই
নৈসর্গিক ফুলের
রূপকার। আমি আজ প্রথম
বিশ্বাস করলাম মা আমার
মানসিক ভারসাম্যহীন
ছিলো না। সে ছিলো আসলে
এইসব সমাজের চে অনেক
অনেক উপরে তাই সমাজ
তাকে চিনেছিলো না। আর
আমার জন্য জগতের সকল
শোক, কারণ মা আমাকে
চেনাতে চেয়েছিলো
নিজেকে কিন্তু আমার
দৃষ্টিও পরিচ্ছন্ন
ছিলো না। তখন এক
সমুদ্রের নোনা কান্না
আমার চোখে এসে ভীড়
জমালে আমার টেবিলের
সমস্ত লেখার খাতা ছিঁড়ে
ফেললাম, যার সমস্তই
ছিলো অসুন্দর আর অসুখের
গল্পে ভরা।
আমার কন্যা এলো হাসতে
হাসতে, তখন তার কপালের
রেখা ধরে শিশিরের মতো
বিন্দু বিন্দু ঘাম
জমেছে। আমি তার ঘামের
কপালে আলতো ঠোঁট রেখে
বললাম, সাদা রাজহাঁস আর
সাদা শেয়াল কি
শিউলিতলায় এখনো খেলছে?
কন্যা আমার যে কিনা
নৈসর্গিক ফুল, বললো,
তারা চলে গেছে। কাল
দুপুরে আবার আসবে
বলেছে।
আমার বুকজুড়ে নৈসর্গিক
শান্তি নামলে বললাম,
আমরা তাদের জন্য রোজ
অপেক্ষা করবো।