হঠাৎ হঠাৎ এই
পৃথিবীতে এসে পড়া
এক পক্ষীরাজ
সেলাই আমার শেষ হয় না
একটা সকাল, যেখান থেকে
আমরা শুরু করি — আর একটা
বিকেল, যেখানে আসতে
আসতে আমরা ফুরিয়ে যাই।
মুহূর্তগুলোকে
বিচ্ছিন্নভাবেই আমি
চিনি। সকাল মানে –
জানলা বন্ধ, বাইরে পাখি
ডাকছে, অসম্পূর্ণ এক
আলো রোদ হয়ে ওঠার
চেষ্টায়... আর আমি
বিছানায় গড়াতে গড়াতে
ভাবছি আরেকটু ঘুমোব
কিনা। বিকেল মানেও তাই,
– জানলা বন্ধ, বাইরে
পাখি ডাকছে, রোদ থেকে
রিটায়ার করছে সেই আলো...
আমি বিছানায়, ভাবছি
আরেকটু ঘুমোব কিনা।
এ’ সবই এক চিরকালীন
জানলা-বন্ধে বিচ্ছিন্ন
কিছু মুহূর্ত। এখানে
কোনো অপেক্ষা নেই।
মধ্যে মধ্যে
কিছুক্ষণের জন্য জীবনে
ফিরে আসা। জীবন বলতে,
কিছুক্ষণ, আমার সঙ্গে
থাকা শরীরটাকে
পরিচর্যা করা। হঠাত ঘুম
ভেঙে মনে হলো, দাড়ি কাটি
কিম্বা জামা-কাপড়
বদলাই। কেন করি? কারণ,
জানি, এটাই আমার কাজ।
অন্তত এ’ বাদে দূর দূর
অবদি আর কোনো কাজ আমি
খুঁজে পাই না। যেন একটা
ঘরে কেউ আমায় রেখে গেছে,
আর সঙ্গে রেখে গেছে
একটা শরীর ও সেই শরীর
সম্পর্কে কিছু কাজ। এক
মৃতদেহ পোষার মতোই আমি
সে শরীরের পরিচর্যা
ক’রে যাই। তার মাথা
আঁচড়ে দিই। কে দেখবে?
তার জামাকাপড় বদলে দিই।
কোথায় বেরোবে সে? এ’ সব
প্রশ্ন শরীরটা করে না।
ভাগ্যিস আমার আর
শরীরটার মধ্যে কোনো মন
নেই, তাই প্রশ্নও নেই।
অপেক্ষাও।
তবু, আজ ভারী অদ্ভুত
হলো। দাড়ি কামানোর জন্য
গালে সাবান লাগালাম।
তারপর দাড়ি কামিয়ে,
সাবান ধুয়ে মুছে যা
দেখলাম – স্তম্ভিত।
চিবুকে একটা জড়ুল।
এমনকি নিচের ঠোঁটটাও
কীরকম যেন মুখ ভেঙচানোর
মতো বাঁদিকে ঝোলা।
যাচ্চলে! এটা তো সে মুখ
নয়। কবে থেকে এই জড়ুল?
কিম্বা এ’ বাঁকা ঠোঁট?
আগে দেখেছি? কিছু কী
ঘটেছিল? আশ্চর্য!
কিচ্ছু পরিচিত নেই।
হঠাতই একটা মুখ বদলে
গেল! ধীরে ধীরে নজর
করলাম অনেক বদলই ঘটেছে,
এমনকি ছোটবেলায়,
সাইকেলের ধাক্কায় বাঁ
চোখের কোণে যে
পার্মানেন্ট দাগটা
হয়েছিল, সেটাও বেমালুম
উধাও।
আমি ধাক্কা খেলাম। এরকম
নয় যে আমার আর শরীরের
মধ্যে একটা মন এলো। বা,
শরীরটার প্রতি আমার
একটা প্রেম তৈরি হলো
যাতে ক’রে আমি তাকে
নিজের শরীর ভেবে গদগদ ও
উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম।
একদমই নয়। আমার খারাপ
লাগছিল, নিজের কাজে
গাফিলতির জন্য। একটা
শরীরের দেখভাল — এই
একটাই মাত্র কাজ আমার,
যার জন্য দিনের পর দিন
জগত-সংসারের এত
কাঁড়িকাঁড়ি ঘুম ধ্বংস
ক’রে চলেছি আমি — সেটাও
ঠিক ক’রে না করতে পারায়
আমি কেমন যেন এই
অস্তিত্বের যথাযথ
হওয়াটুকুও প্রমাণ করতে
পারছিলাম না।
শেষ বাড়িতে কে এসেছিল —
আমি ভাবতে শুরু করি —
শেষ কে বা কারা আমি বাদে
এই শরীরটাকে দেখেছে?
দেবি। ইয়েস। আমি দেবিকে
ফোন লাগাই। ফোন ব্যস্ত।
ধুর! এ’ বাদে, এ’বাদে?
ঠিক, ফিরদৌস। কাঠের কাজ
করতে এসেছিল, মাস দুয়েক
আগে। ফিরদৌসের ফোন রিং
হতে থাকে। রিং হতে
থাকে...
— হ্যাঁ দাদা।
হঠাতই এই “হ্যাঁ দাদা”
এক জনহীন দ্বীপে আরেক
প্রাণের খোঁজের মতো
আশ্বাস নিয়ে, জলীয়
বাষ্পে ধাক্কা মারে
আমাকে। আমি তড়িঘড়ি ব’লে
উঠি,
— ফিরদৌস, একটা খুব
সমস্যায় প’ড়ে ফোন করছি
ভাই।
— হ্যাঁ দাদা।
— আচ্ছা, তোমার কি মনে
আছে, আমার গালে কোনো
জড়ুল ছিল কি না?
— আপনার... গালে... জড়ুল...
মানে? আপনার মনে নেই?
— আরে সে অনেক গল্প, পরে
দেখা হলে বলব। আগে বলো,
ছিল কি না।
ফিরদৌস ভাবতে লাগল।
ফোনের এধার থেকে শুনতে
পাচ্ছিলাম, ওর ভাই
আক্রমের সাথে পরামর্শও
করল।
— হ্যাঁ দাদা, ছিল তো, ওই
বাঁ চোখের কোণে?
— বাঁ চোখের কোণে? — আমি
হতাশ হলাম — ধুর, ওখানে
তো কাটা দাগ ছিল!
ফোনের ওধার থেকে শোনা
যাচ্ছে, আক্রম ঝাঁপিয়ে
পড়েছে ফিরদৌসের ওপর,
— বলছি, ঘাড়ের কাছে, তুই
বেশি জানিস?
— ঘাড়ের কাছে? বললেই হলো?
দাদার ওই কোঁকড়ানো চুল
পেরিয়ে ঘাড় কবে দেখা
গেল এ্যাঁ?
— আরে যেটা বলছি একবার
বলেই দেখ দাদাকে...
কিন্তু ফিরদৌস কোনো
রিস্ক নিলো না। এটা ওর
চরিত্র, যে কাজই করে, মন
দিয়ে করে। ও মোবাইল
মুখের কাছে এনে বলল,
— দাদা, আমি আক্রম আর
আব্বাজির সাথে কথা ব’লে
আপনাকে পাঁচ মিনিটের
মধ্যে জানাচ্ছি।
চিন্তা করবেন না দাদা।
অসুবিধা হলে বলবেন, আমি
চ’লে আসব।
ফিরদৌস রাখার সাথে
সাথেই মোবাইলটা বেজে
উঠল। দেবি। কল ব্যাক
করেছে।
— বল।
— কল করেছিলি? ক্লাস
নিচ্ছিলাম।
ভাবলাম দেবিকে সব খুলে
বলা যায়। বললামও এবং
সেটাই ভুল। ওর উত্তর
শুনে প্রতিবারের মতোই
আবার মনে হলো, এর চেয়ে না
বললেই ভালো হতো। ওর
প্রথম উত্তর,
— রেজিস্টারে সাইন করার
সময় আমাদের তারিখ দেখতে
হয় বাবু।
আকাশ থেকে পড়লাম — তো?
— তো আজ যে পয়লা এপ্রিল
সেটা আমি জানি। খামোখা
মেটামরফসিসের
অ্যাডাপ্টেশনে বুদ্ধু
বানাতে পারবি না।
— কী যা তা বকছিস? আমি তো
তারিখই জানি না। আর
এখানে মেটামরফসিস এলো
কোত্থেকে?
আমার একটা সমস্যাকে
একশোরও বেশি প্রাচীন এক
সাহিত্যের সাথে তুলনা
সত্যিই বাতুলতা।
বললাম,
— দেখ দেবি, সকাল সকাল
থিয়োরি মাড়াতে
ভাল্লাগছে না। তবু বলি,
মেটামরফসিসে ওই আপামর
পরিবর্তন চরিত্রটার
একটা ক্রাইসিস। আমার
ক্ষেত্রে প্রথমত এটা
আপামর পরিবর্তন জাতীয়
কিছুই নয় — একটা মুখে
জড়ুল এবং আরও কিছু কিছু
জিনিস আমার অচেনা
লাগছে, মনে করতে পারছি
না আগে দেখেছি কি-না,
ব্যাস, এটুকুই। আর
দ্বিতীয়ত প্রবলেমটা
আমার নয়, আমার কাজ
সংক্রান্ত, কারণ শরীরটা
আমার নয়, বরং তাকে
দেখভাল করাটা আমার একটা
কাজ, যা আমি করি আর
পরিবর্তে
প্রচুর-প্রচুর ঘুম পাই।
এরকম কোনোদিন ফেস
করিসনি, কাউকে দেখে
হঠাত মনে হলো, আরে এর
মুখটা একটু অন্যরকম ছিল
না? আমার ক্ষেত্রেও
বিষয়টা ততটুকুই
সামান্য। খালি চাপ
খাচ্ছি, শরীরটাকে
পরিচর্যা করা আমারই
দায়িত্ব ব’লে, এটা আমার
কাজের গাফিলতির মধ্যে
গোনা হবে ব’লে।
— ও — দেবি বলল — ওই দিন
অরিজিতও তো এসছিল।
দাঁড়া ওকে একবার ফোন
ক’রে দেখি, ও যদি কিছু
বলতে পারে।
দেবি ফোন কেটে দেয়। আমি
আবার আয়নার সামনে
দাঁড়াই। মুখটাকে
পরীক্ষণ করতে করতে
প্রবল টেনশনের মধ্যেও
হাসি পায় আমার। একটা
শরীর তার মুখের দিকে
তাকিয়ে আছে তারই চোখ
দিয়ে, আর তার মাথায় ধরা
পড়ছে জড়ুল বা ওই সমস্ত
পরিবর্তন। মদ্যিখান
থেকে আমায় এই সবকিছু
ব্যালেন্স করার
দায়িত্ব নিয়ে নিজের ঘুম
থেকে জেগে থাকতে হচ্ছে।
তবে এই হাসিটাও কি আমার
নয়? নাহ... এটা আমারই।
শরীরের ভারসাম্যের
বিপরীতে যা কিছু ঘটছে,
শরীরের বিপক্ষে যে বোধ
তা আমার বইকি।
কর্মক্ষেত্রে ঘুষ
খাওয়ার মতোই এক
চোরাগুপ্তা আনন্দ এ’।
আবার ফোন। অরিজিতের।
আমি চুপ। অরিজিত বলতে
থাকে,
— হ্যালো... বলছি, দেবি
ফোন করেছিল।
— হুম।
— তোমার ঠোঁট তো সেদিন
রাতেই ঝুলে গেছিল, মনে
নেই? সেলিম আমি আর দেবি
যেদিন গেলাম তোমার
বাড়িতে, রাতে তুমি
সেলিমকে চুমু খেতে
গেলে, আর ও তোমার ঠোঁট
কামড়ে দিল।
— আমার ঠোঁট... আমি চুমু
খেতে গেলাম... কী সব বকছো?
সে রাতে শরীর বেশি মদ
খেয়ে ফেলেছিল ব’লে আমি
ওকে রেখে ঘুমোতে চ’লে
গেলাম। এরপর যা করেছে ও
করেছে, ওকে দোষ দাও।
আমায় দিচ্ছ কেন!
— ইন্দ্র! তোমায় কতবার
বলেছি তোমার মূলাধারে
সমস্যা হচ্ছে। একটু
যোগাসন করো, ঠিক হয়ে
যাবে। আচ্ছা শোনো, আমি
দেবি আর সেলিমকে নিয়ে
তোমার বাড়িতে আসছি।
শোনো চাপ নেবার...
“আপনার কলটিকে হোল্ডে
রাখা হয়েছে”। এটা অরির
দীর্ঘদিনের ব্যাপার —
এই গালে লেগে ফোন হোল্ড
হয়ে যাওয়া। নতুন কিছু
নয়। আমি এক মিনিট শুনে
কলটা কেটে দিই।
এবার? কী করব? অপেক্ষা?
কার জন্য? ঘুমের জন্য যে
করব, তার কোনো উপায় নেই,
কারণ কাজে গাফিলতির পর
স্টে অর্ডার জারি হয়,
ফলে ঘুমে আমার আর কোনো
অধিকার নেই। দেবি,
ফিরদৌস, অরি বা সেলিম
এদের জন্যই বা করব বা
কেন? শরীরটা তো আমারই নয়,
সে কী করেছে বা না করেছে
জেনে কী লাভ? তবে?
যেখানে মন নেই, সেখানে
কোনো অপেক্ষাও নেই। তবু
এরা যে কোনো সময়ই চ’লে
আসতে পারে। ফলে আমি
কিছুক্ষণ ভেসে থাকব এই
বন্ধ ঘরের মধ্যে। ভেসেই
থাকব। এবং নিজেকে
বারবার শোনাবো —
“আপনাকে হোল্ডে রাখা
হয়েছে।”