এ লেখার কোন ইতিহাস নেই
। কোন ম্যাপ নেই যেখানে
বসাতে পারবেন । এর
কোথায় শুরু যেমন কেউ
জানে না । এর শেষ নেই ।
কেবল নদীটা বদলাতে থাকে
। শরীর বাঁকে । রূপ
বাঁকে । ফোলে শোকায় ।
মানুষের কিছু করার নেই
। যে লেখার কোন দেশ নেই,
তার কাছে দেশ ভাগ কোন
ভুল নয় । কাগজ ছিঁড়ে
ফেললে গল্পটা শুধু
আলাদা হয় । নতুন দুটো
গল্প তৈরী হয় । আর যারা
শব্দ বরাবর ছেঁড়ে তারা
বুঝতে পারে না কোন
গল্পটা তাদের। তারা এ
গল্পের কাহিনি নিয়ে
অন্য গল্পে পৌছয়। আবার
অন্য গল্পের তাড়া খেয়ে
ফিরে আসে আগের গল্পে ।
আমি যখন রহড়া মিশনে
ভর্তির পরীক্ষা দিই তখন
শুনি , রেশন কার্ড।
লোকাল ছেলে হলে আমার
কিছু সুযোগ সুবিধা
নম্বরে । এই যেমন এস সি
এস টি ও বি সি-দের
থাকে । অল্প নম্বর
পেলেই হবে। আমি রহড়াতে
থেকেও বহিরাগত ছিলাম ।
আমার রেশনকার্ড নেই ।
আমার সাথে রুবেলের
যেদিন দেখা ততদিনে ওর
ঘর নেই। ও জানে শুধু ওর
গ্রামের নাম কি ছিল । সে
গ্রামই এখন আর নেই।
সবটাই জলের নীচে ।
গঙ্গা দেশ বদলালে নাম
বদলায় । পদ্মা ধরে সার
দিয়ে দাঁড়ানো মানুষ,
প্লাস্টিকের তাঁবু,
নতুন জমি।
দুই দেশ সরু সূতোর এক
নদীকে নিয়ে । সে
একজায়গায় জমি খায় ।
মাটি ওগরায় আর একখানে ।
মাটি জমতে থাকে । পালটে
যায় দেশের মানচিত্র ।
আবার আর এক ভারত । আর এক
বাংলাদেশ । বা কোনটাই
না । চর । নদীর ঘার ঘেঁষে
দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের
কাছে জানতে চাই,
তোমাদের গ্রামের নাম
কি। রুপনগর। রুপনগর
কতখানি? গ্রাম তো নেই
আর। ঐ যে দেখেন তাল গাছ
ওই যে দেখেন নারকেল
গাছ। ঐ ছিল রুপনগর।
গ্রামছাড়া, ঐ রাঙামাটির
পথটুকুর ওপর
প্লাস্টিকের ছাউনি।
ওদের ঘর। কদিনের ঘর।
নতুন জমির খোঁজ। সেই
জমিও একদিন গিলে খাবে
নদী। আবার নতুন চর। এ এক
বৃত্ত। বৃত্তের মধ্যে
ঘুরতে থাকা কিছু মানুষ।
বলে চলে , তাদের কোন
গ্রাম নেই । শুধু
সীমানা । এই সীমানাটুকু
বদলাতে থাকে সব সময় ।
রুবেলের বয়স কত হবে ? দশ
বারো । রফির বয়স আরো কম ।
ওরা জানে জায়গাটার নাম
চর । যা কোন দেশ নেতা
তৈরী করে দেয় না । তৈরী
করে নদী । দেশ কেবল
কাঁটাতার ঠিক করে ।
জওয়ান বসায় । কাঁটাতারে
লেখে বি এস এফ ঘুষ খায় না
। রুবেল অন্ধকার থাকতে
থাকতে উঠে পড়ে । রফি
প্রচণ্ড শীতে বেরিয়ে
পড়ে। ওরা চাল পাচার।
বর্ডার পেরোয়, বি এস এফ
পেরোয়। হাট। যেখানে
ভারত বাংলাদেশ টাকায়
বদলায়। -রফি তোর চাল
পাচার ছাড়া আর কিছু
করতে ইচ্ছে করে না? –
বাচ্চা তো আর কি করব? –
কেন? স্কুলে যাবি। রফি
জানে না বাচ্চারা
স্কুলে যায় । সে জানে
ছোটরা চাল পাচার করে ।
তার মায়েরা নেশার জিনিস
। বাবার কোন কাজ নেই ।
রফি ভোরের আলো ফোটার
আগেই চালের বস্তা । সে
ভোর দেখে বাংলাদেশের ।
আর বাকিটা রাস্তা ফেরা
বা না ফেরার । অনেক রাত
হয় সে ঘরে ফেরে না । তার
বাড়ি জানে না , আর ছেলেটা
ঘরে আসবে কি না। হতে
পারে মরে গেছে রাস্তায়।
- রুবেল তোর ভয় করে না । -
বর্ডারে থাকলে ভয় করলে
চলে না। রুবেলের মা আছে
বাবা আছে দিদি আছে।
দিদির বিয়ে আছে। শ্বশুড়
বাড়ি নেই। পুরো টাকা না
মেটালে মেয়ে নেবে না।
বাপের বাড়ির সাদা কালো
টিভি। মোবাইল ফোনের ঐ
প্রান্তে বরের গলা।
বরের পাশে অন্য মেয়ের
গলা ।
রুবেল একবার কেরালা
গেছিল কাজের খোঁজে।
হোটেলের কাজ। দেয় নি
কেউ। বাচ্চাদের কাজ
দেওয়া হয় না। রুবেল
আবার চোরা চালান। একটা
বিশাল অংশ চোরাচালান।
মেয়ে বৌরা থাইতে
ব্লাউসের নীচে বেঁধে
নেয় নেশার শিশি। শুকিয়ে
আসা পায়ের সাথে ঝুলে
থাকে শিশি। শিশি খেলে
ঘুম আসে । - ঘুম মানেই তো
নেশা। ওরা চর ধরে হাঁটে
।
ধূ ধূ চর । অন্ধকার ।
ঝোপ ঝাড় । হেঁটে যায়
মেয়ের লাইন। পায়ের শব্দ
ওঠে না। নীচু জলে
ডিঙ্গি । জল কেটে কেটে
নিয়ে যায় । সাপ ঝোলে
ঝোপের গায় । ওপারে
পৌঁছে এক শাড়ির নীচের
নেশা , জায়গা পায় আর এক
শাড়ির নীচে । মা বলত দেশ
ভাগের সময়। কাপড়ের ভেতর
বাচ্চা বেঁধে দলে দলে
মা। কৃষ্ণনগরের
রাস্তায় রাস্তায়। তখন
কত মা বদল। নতুন মায়ের
পা জড়ানো বাচ্চাগুলো
ঢেলে দেয় মাটির ওপর।
দড়ি দিয়ে বাঁধা , গায়ে গা
ঠেকিয়ে থাকে। এই শিশি
নিতে লোক আসে। সে গুণে
নেয়। তার কাছে ওপার
থেকে ফোনে হিসেব আসে।
সে জানে কত শিশি ওপার
থেকে পাঠানো হয়েছে।
এখানে কম পড়ে কখনো কখনো
। রাস্তায় হারিয়ে যাওয়া
। রুবেলের মাও এরকম
হারিয়ে ফেলে মাঝে মধ্যে
আধ একটা । গালাগাল করে
ওর বাবা । বি এস এফ
মেয়েদের গায় হাত
দেয় না । আটকে রাখে ।
বিকেল সন্ধ্যে রাত ।
আটকে রাখে । তাদের কাছে
খবর এসেছে নেশার শিশির
চোরাচালান । সেদিন
রুবেলের গ্রামে মেয়েরা
রাতে বাড়ি
ফেরে না।
গল্পটা এখানে এসে থেমে
যায় । বুঝে পাই না আর কি
বলব । এ গল্পের কোন
কাহিনি নেই। এ শুধু বলে
চলা। আর দেখা। শুকিয়ে
আসা কিছু মানুষ। না
একটা গোটা গ্রাম। যার
নীচ থেকে মাটি সরে যায়
সব সময়। যেখানে
বাচ্চারা খেলে না।
স্কুল আছে সর্বশিক্ষা
অভিযানের মত । শিক্ষা
নেই । তারা জন্ম থেকে
একই রকম রয়ে যায় । বড় হয়ে
কি হবি বললে বলতে পারে
না কিছু । সে তো বড় হওয়া
জানে না । সে দেখে তার
পাশের বাড়ি চোরা চালান
। তার পাশের বাড়িও তাই ।
তার পাশের বাড়িও । তার
পাশেরও । তার রাস্তায়
দু পাশে গুলির শব্দ ।
তার দেশে সব সময়ই যুদ্ধ
চলে । আর যুদ্ধও জানে না
সে কোন দেশের । দিনের পর
দিন মানুষ বাড়ি না
ফিরলে বুঝতে পারে
মরে গেছে । অথচ রুবেল
আমারই দেশ । আমার ঘরের
কাছেই । খুব বেশি হলে
কয়েক শো কিলোমিটার ।
আসলে মানচিত্র দুটো দেশ
দেখায়। সেই দুটো দেশের
মাঝ বরাবর আরো দুটো দেশ
রয়েছে। তাই এদের কাছে
দেশ ভাগ হওয়াটা কোন ভুল
নয়। কিন্তু ভোটার আই
কার্ড হারিয়ে ফেলাটা
ভুল। তখন আমি এ দেশে
থেকেও অন্য দেশের। আর
অন্য দেশে চলে গেলে
এদেশের । এখানে জমির
দলিল হারিয়ে ফেলা ভুল ।
নদী আবার ঘর ভাঙবে , নতুন
চর হবে । সেখানে পুরোনো
দলিল না দেখালে আর জমি
পাবে না । অথচ রুবেল আর
আমার পাশের বাড়ির
ছেলেটার মধ্যে কোন অমিল
নেই। রুবেলের কাছে এই
অনিশ্চয়তা এই যুদ্ধ
স্বাভাবিক । এই বড় না
হয়ে উঠতে পারাটা
স্বাভাবিক । তার কাছে
কোন কিছুই ভুল নয়। বরং
ভুলগুলোই ঠিক।
রুবেলের সামনে তখন একটা
ক্যামেরা । ক্যামেরা
পেছনে সৌরভ সারেঙ্গি ।
চরের পরিচালক ।
ক্যামেরা আর রুবেলের
মাঝখানে আমি । অথচ
আমাকে
দেখা যায় না । এবার
আপনারা ঠিক করুন আমি কি ?
ঠিক না ভুল ।
চর ধরে হাঁটতে থাকলে
আপনি দেখতে পাবেন পদ্মা
বেশ কিছুটা এগিয়েছে
ভারত বাংলাদেশের
সীমানা ধরে । কাসিম নগর ,
বিলবরাকপাড়া ,
কোদালকাটি ( পশ্চিম ) ,
দিয়ারমানিক চক ( পশ্চিম
), হনুমন্ত নগর ( দক্ষিণ ),
নির্মল চর এই ভাবে দুই
দেশের গা ঘেঁষে এগিয়েছে
পদ্মা । নদীর মধ্যে
মধ্যে তৈরী হয়েছে চর।
ম্যাপের ওপর ঝুঁকে পড়লে
দেখা যায় একটা ঘোলাটে
কালো নদী আর তার মধ্যে
মধ্যে সাদা জমি। চর। আর
সরু সাদা বর্ডার। লেখা
India , Banlgadesh. কিন্তু
মানুষগুলোকে দেখা যায়
না। তাদের কথাই বলে এই
গল্প । সেখানে
দারিদ্র্যকে মহৎ করে
দেখানো হয় না। বরং
বেঁচে ওঠে লড়াইটা , দেশ
না পাওয়ার মিথ্যেটা ।