বাহান্ন প্রকাশ থেকে ২১
জুন ২০১৫ সালে আমার
প্রথম বইয়ের (আম্বিয়া
দাদি ও তার বিড়ালেরা)
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে
কলকাতা গিয়েছি ঢাকা
থেকে। যাবার আগে একটা
ছোটো দুর্ঘটনায়
হাঁটুতে ব্যথা পেয়ে
হুইল চেয়ারে ফ্লাইটের
দোরগোড়া পর্যন্ত যেতে
হয়েছিল। কিন্তু
অনুষ্ঠানের দিন
বৃষ্টির মাঝে কলেজ
ষ্ট্রিটের লম্বা
রাস্তা পেরিয়ে কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছে
ঘেরা ছায়াপথ দিয়ে গাড়ি
যখন ভিতরে ঢুকছে, আমার
হাঁটুর ব্যথা আর মাথায়
থাকল না। দ্বারভাঙা
হলের শ্বেতপাথরের
অনেকগুলো সিঁড়ি বেয়ে
উপরে অনায়াসে চলে এলাম।
বিশাল হল রুমের দরজায়
হাসি মুখে বাহান্নর
প্রকাশক সুদেষ্ণা
মজুমদার আমাদের
অপেক্ষায়। সুদেষ্ণা
জানালেন আমার বইটির
মোড়ক উন্মোচন করবেন
বারীন ঘোষাল। এতো বড়ো
মাপের একজন কবি ও
প্রাবন্ধিকের হাতে
আমার বইটি উদ্বোধন হতে
যাচ্ছে, ভাবতে পারছিলাম
না। বারীন ঘোষালের নাম
বন্ধুদের মুখে শুনেছি
মাত্র। সত্যি বলতে আমি
তাঁর কোনো লেখাও পড়ি
নাই তখনও। যখন শুনলাম
উনি শুধু মাত্র বাহান্ন
প্রকাশনার আমার বইটি
উদ্বোধনের জন্য প্রায়
তিনশো মাইল দূর থেকে
কলকাতায় আসছেন,
শ্রদ্ধায়, কৃতজ্ঞতায়
আমি তার বিশাল ভক্ত হয়ে
গেলাম। আসলে বারীনদা
মানুষটি এমনই ছিলেন।
চেনা–অচেনা সবাইকে
সমান গুরুত্ব দিতেন।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
অনুরাগী তরুণদের পাশে
মহা উৎসাহে গিয়ে
দাঁড়াতেন।
দ্বারভাঙা
হলে সন্ধ্যা হতে
লোকজনের ভিড় যখন জমে
উঠতে শুরু করেছে, দেখা
গেল জলপাই রঙের শার্ট
পরা শান্ত অবয়বের
মানুষটি অমায়িক মিষ্টি
হাসি নিয়ে টেবিলের কাছে
এসে দাঁড়ালেন।
সুদেষ্ণা উঠে এসে
আমাদের সবার সঙ্গে
পরিচয় করিয়ে দিলেন।
আমার পরিচয় দিতেই এমন
করে হাসলেন যেন কতকালের
চেনা মানুষ। সেদিন আমি
কিছুটা নার্ভাস ছিলাম।
বারীনদার সঙ্গে
পরিচয়ের পর একটু
উৎসাহিত বোধ করলাম। যথা
সময়ে অনুষ্ঠান শুরু হল।
প্রথমেই ছিল আমার বইটির
মোড়ক উন্মোচন। বইটির
মোড়ক খুলে বারীনদা
বললেন, বাহ সুন্দর বই!
সবাই ছবি
তুলছে, আমাকে বলা হল
বইটি নিয়ে কিছু বলতে।
আমি ঘামছি, বুকের
দুকদুকানি বেড়ে গেল।
বারীনদা মনে হয় আমার
নার্ভাসনেস বুঝতে
পারছিলেন। বললেন, আসো
তোমার বইটির সঙ্গে আগে
একটি ছবি তুলি। ছবি,
স্মৃতি, পাশে থাকা এতো
কিছু সব ফেলে রেখে
স্বল্পভাষী বারীনদা
চলে গেলেন। বারীনদা
সাধারণ আর পাঁচ দশটি
মানুষের মতো যে ছিলেন
না সেটি বোঝা যায় তার
প্রতি মানুষের অসীম
ভালবাসার
শ্রদ্ধার্ঘ্য দেখে।
দুদিন
পর দ্বিতীয়বার দেখা
হয়েছিল বারীনদার সঙ্গে
কবি সব্যসাচী হাজরার
বাড়িতে সন্ধ্যায়
সাহিত্য সভায় কবিতার
আসরে। উনি যে সবার কত
কাছের মানুষ ছিলেন
সেদিনই বুঝতে
পেরেছিলাম। বারীনদা
হার্টের রোগী বলে তার
জন্য হালকা মশলার
খাবার, ছোটো মাছ সবজী
করা হয়েছিল বিশেষ
যত্নে। বারীনদার পায়েস
পছন্দ, পায়েস করা
হয়েছে। দুঃখ থেকে গেল
বারীনদার সঙ্গে আর কখনো
দেখা হবে না। দুদিনের
সান্নিধ্যে
অকৃত্রিমতার যে
উপলদ্ধি হয়েছে,
বারীনদাকে ভোলা যায় না।
ফেরার সময় বারীনদা
দুটা বই উপহার দিলেন।
‘পুব আর ফুরোয় না’ ও
‘কবিতার ক্যাম্প ৬’।
বারীন
ঘোষালের লেখা থেকে......
‘পণ্ডিতরা বলেন আমি এই
করে বাংলা কবিতা ও তরুণ
কবিদের বারোটা
বাজাচ্ছি। হাঃ হা। একটা
দুটো বাজাব কেন, বারোটা
বাজানোই তো উচিত আমার।
আমি তো কবিতার, মূলধারা
কবিতার ভিলেন। সেটা
জেনেই কবিরা এখানে
আসেন, ভালোবাসেন,
তৃপ্তি পান।’
ভালো পাহাড়ের কবিতার
ক্যাম্পে বারীন
ঘোষালের গাঢ় ডাকের
অপেক্ষায় থাকত অনেকে।
এখনো কেউ কেউ হয়তো ইথার
তরঙ্গে বা্রীনদার
মন্তব্যের অপেক্ষায়।
আমার ফেইসবুক বন্ধু
ছিলেন তিনি। ভাল লাগলে
লাইক দিতেন, ছোটো করে
কমেন্টও করতেন। আর কখনো
করবেন না, ভাবতে কষ্ট
হচ্ছে। বাংলাদেশে আসার
খুব ইচ্ছে ছিল, আসা হয়ে
ওঠেনি। বাংলাদেশের
কবিদের কবিতা পড়তেন,
নামে চিনতেন। বই পাঠাতে
বলতেন। তাঁর চলে যাবার
পর তার ভালোবাসা, স্নেহ,
প্রীতির ঘনিষ্ঠ জনেরা
তাঁকে নিয়ে লিখছে, কথা
বলছে। পড়ছি আর ভাবছি,
তাঁকে ভালো করে জানার
সুযোগই হল না, চলে
গেলেন।
৪.১১.২০১৭