দুই হাজার বারোর দিকের
কথা। কবিবন্ধু শিমন
রায়হান ও আমি তখন
পশ্চিমবাংলাকেন্দ্রিক
ওয়েবজিন ‘বাক’,
কালিমাটি, আদরের নৌকা ও
বিভিন্ন লিটলম্যাগে
লিখতাম। বাকের কোনো এক
সংখ্যায় আমাদের কবিতা
পড়ে মতামত জানালেন কবি
বারীণ ঘোষাল। আমাদের
ভালো লাগলো। যারা এই
কবিকে চেনেন-জানেন তারা
বিষয়টির সঙ্গে
অভ্যস্ত। তরুণদের
কবিতা পড়ে মতামত জানিয়ে
চিঠি লিখে চমকে দিতেন।
আমরা বাংলাদেশে থাকি,
চিঠি লিখে পাঠানোটা
একটু জটিল! আর তখন
ফেসবুকেরও রমরমা। তাই
বাই পোস্ট না পাঠিয়ে
তিনি পাঠালেন ফেসবুক
পোস্টেই।
গত ২৯ অক্টোবরের (২০১৭)
দুপুর। ফেসবুক জানালো,
শিমন রায়হান একটি
পোস্টে আমাকে ট্যাগ
করেছে। বারীণ ঘোষালের
পোস্ট। শিমনের কবিতার
আলোচনা দিয়ে শুরু। শেষে
এসে দেখলাম, দুলাইন
আমার কবিতা নিয়েও
রয়েছে। যে কবিতা নিয়ে
তার মতামত সেটি পাঁচ
বছর আগে লেখা। ধন্দে
পড়ে গেলাম, সম্প্রতি
কোথাও তো কবিতাটি
দিইনি! তিনি এই কবিতা
এতোদিন পর কোথায় পেলেন!
পরে নজরে এলো এটি, ০৩
নভেম্বর ২০১২ সালের
পোস্ট। শিমন পুনরায় এটি
শেয়ার করেছে, সঙ্গে
দু-চার লাইন, ‘এই হলেন
বারীন ঘোষাল। আজ থেকে
প্রায় পাঁচ বছর আগে
আমার মতো নবিশ আর
অখ্যাত কোন লিখিয়ের
লেখাতেও যিনি এতোটা
মনোযোগ দিয়েছিলেন,
'বাক্' এর পাতায়। তারপর
আরো আলাপ। যদিও সাক্ষাত
হয়নি কখনও। সাক্ষাত
হয়নি কি? সম্মুখে
শান্তি পারাবার, BARIN দা’।
বন্ধু আমার প্রায়ই এমন
বিমূর্ত কথা-বার্তা বলে
থাকে, আসল ঘটনা বুঝিনি
তখনও। কিন্তু সেসময়কার
অনেক কথা মনে পড়ে গেলো।
আহারে, সব নানা রঙের
দিনগুলি। কী দারুণ
কবিতা যাপনের
সময়গুলো…।
বিকেলের দিকে ফেসবুকে
গিয়ে আরেক কবিবন্ধুর
পোস্ট চোখে পড়লো,
‘আমাদের দেখা হলো না,
তার আগেই চলে গেলেন
বারীণ দা’ টাইপ কিছু।
পরে তার কাছের কয়েকজনের
প্রোফাইলে গিয়ে
নিশ্চিত হলাম, আমার
আশঙ্কাই সত্যি। তিনি
অন্যভুবনের দিকে পাড়ি
জমিয়েছেন।
তবে শিমন ও জনৈক
কবিবন্ধুর চেয়ে আমার
ভাগ্য খানিকটা
সুপ্রসন্ন, দেখা হয়েছিল
আমার সঙ্গে। বারো সালের
কলকাতা বই মেলায়।
সোয়েটার, ট্রাউজার,
কেডস্ ও মানকি টুপি
পরে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে
রয়েছেন কৌরবের স্টলের
সামনে। এর আগে ফেসবুকে
বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে।
পরিচয় দিতেই জড়িয়ে
ধরলেন। কথা হলো, নিজের
বই দিলেন, আমি সই করিয়ে
নিলাম। বইটি বাড়িতে
রয়েছে, আর আমি এই
মুহূর্তে বাড়ি থেকে
দূরে। কাব্যিক কিছু
একটা লিখে দিয়েছিলেন।
দেখতে দেখতেই কবিদের
একটা জটলা তৈরি হয়ে
গেলো। সবাই মিলে ছবি
তুললাম। ছবিটিও হাতের
কাছে নেই। কবি
শ্রীদর্শিনী
চক্রবর্তী, অনিমিখ
পাত্র ও সঙ্ঘমিত্রা
হালদার ছাড়া বাকিদের
নাম ভুলে গেছি। এসব
টুকরো স্মৃতিগুলো মনে
পড়ছে।
- আপনার লেখালেখি কেমন
চলছে বারীণ দা?
- ‘সে তো অন্যেরা বলবে।
আমার বলা সাজে না।’
- আপনার নিজের তৃপ্তি
থেকে বলুন না, কেমন
উপভোগ করছেন এখনকার
হাওয়া-জল-পাখি…
- ‘দারুণ। আমি রোজ ভোর
সাড়ে চারটায় উঠে কফি
নিয়ে ওপেন টেরাসে গিয়ে
বসি। পাখিদের ঘুম
ভাঙাই, আলো ডেকে আনি,
বাতাস আর মেঘ আমাকে
আশীর্বাদ দিয়ে যায়।’
মেসেঞ্জারে গিয়ে পুরনো
কথোপকথন পড়তে গিয়ে
দেখলাম, ২০১১ সালের ০৪
অক্টোবর সকাল ৯টা ৫৪
মিনিটে আমাদের কথা শুরু
হয়েছিল। শেষ কথা ২০১৪
সালের ১২ মে সকাল ১০টা
৪৬ মিনিট। তাকে
জন্মদিনের শুভেচ্ছা
জানিয়েছিলাম, উত্তরে
তার ধন্যবাদ। এরপর নানা
ব্যস্ততায় আর আমাদের
কথা হয়ে ওঠেনি। বারো
সালের পরও কয়েকবার
গিয়েছি কলকাতা বইমেলায়,
দেখা করে ওঠা হয়নি।
জানি আজ মেসেঞ্জারের
ওপারে কেউ নেই, থাকবেনও
না কোনোদিন তবু লিখতে
ইচ্ছা করে, কেমন আছেন
বারীণ দা?
এমন নয় তিনি আমার প্রিয়
কবি ছিলেন, গোগ্রাসে
পড়তাম তার কবিতা, যে
জন্য এই লেখা লিখতে বসা!
তবে পড়তাম। তার সঙ্গে
খুব বেশি মিশিনি, না খুব
আমাদের কথা হতো! তবে
হতো। তার ‘কবিতা যাপন’
আমাকে খুব মুগ্ধ করতো।
পঞ্চইন্দ্রিয়ের
সর্বোচ্চ ব্যবহারে
তিনি কবিতাকে উপভোগ
করতেন। শরীরের বয়স
বাড়লেও তার নতুন কবিতার
মতোই নবীন থাকতে
ভালোবাসতেন। রেস্ট ইন
পোয়েট্রি…।
বাকে প্রকাশিত আমার
‘উড়ালসঙ্গী’ নামে ওই
কবিতার মূল্যায়নে তিনি
কয়েকটি অনুষঙ্গ ধরে
লিখেছিলেন,
“শুভ্রনীলের অরণ্য ও
উড়ালসঙ্গীর খোঁজ না
পেলেও চিরহরিৎ দুঃখ আর
ভানুগাছ আমাকে মুগ্ধ
করেছে। বাঃ ভাই, দারুণ!”
কামনা করি, নতুন ভুবনে
সেই অরণ্য ও উড়ালসঙ্গীর
খোঁজ মিলবে…
১৯২৩ ঘণ্টা, ০৬ অক্টোবর,
২০১৭
হায়দাবাদ