কীভাবে শুরু করব বুঝে
উঠতে পারছি না। আমি
নতুন কবিতার কেউ না,
তাঁর দীর্ঘদিনের চেনা
পরিচিত বা বন্ধুও না।
বারীনদার সঙ্গে
কয়েকবার মাত্র দেখা
হয়েছে। বইমেলায়, লিটল
ম্যাগ মেলায়। ফেসবুকে
আর ফোনে কিছু কথা।
প্রথম যখন বারীনদাকে
রিকোয়েস্ট পাঠাই,
২০১২/১৩ সাল হবে, অনেক
দিন বাদে গ্রহণ
করেছিলেন। একজন
বিখ্যাত কবি, একজন আইকন,
দূর থেকে ভয় মিশ্রিত
শ্রদ্ধায় তাঁকে দেখত
নতুন লিখতে আসা একটি
মেয়ে। সেবার গরমকালে
কালিমাটির এক সংখ্যায়
আম নিয়ে লিখেছিলাম।
আমের ঠিকুজী, কুষ্ঠী,
ইতিহাস, আর নিজের
ভাললাগার কথা তো ছিলই
সেখানে। তখনই দেখলাম
বারীনদাকে। সেই প্রথম
কাছ থেকে, এক মুহূর্তে
দূরত্ব, ভয় উড়ে গেল। আম
নিয়ে কথা শুরু হল
আমাদের। থামেই না… আমি
আম-লস্যি বানিয়ে ছবি
দিই আর বারীনদা দুঃখের
ইমো পাঠায়… আমি আর
বারীনদা তখন এক বয়সী, আম
মিত্রতার সাক্ষী। সেই
শুরু।
তখনও ঐহিক ওয়েব শুরু
হয় নি, কবিতা লিখছি আর
ভাবছি, না জানি কী দারুণ
কিছু লিখে ফেলেছি!
যুগান্তকারী তো হবেই
হবে এই সব কবিতারা। এখন
বুঝবে না কেউ, ইত্যাদি,
ইত্যাদি… ঝোঁকের বসে
একটি বইও করে ফেললাম।
এফবিতেই কবি বন্ধু
পেলাম, পেলাম কিছু
গুরুজন, যাঁদের উপদেশ
আমার পাথেয় হয়েছিল। সেই
সময়ে এক বন্ধু বলেছিল,
বারীনদার কাছে যাচ্ছিস!
ভাল, ভাল! দলে টেনে নেবে
তো বটেই, এমনকি কবিতা কী
করে লিখতে হয়, তাও
শিখিয়ে দেবে। আরেকজনও
প্রায় একই কথা বলল,
সঙ্গে জুড়ে দিল – তাঁর
তত্ত্বের বাইরে কোন কথা
বললেই নাকি তিনি দূর
করে দেন। মনে রেখে
দিয়েছিলাম দুজনের
কথাই। এবার একদিন আমারই
এক কবিতা পড়ে মতামত
চাইলে বারীনদা জানালো,
‘দেখ তুষ্টি, তুমি আগে
ঠিক করে নাও, কী লিখবে।
কবিতা লিখবে না দর্শন।‘
বেশ রাগ হল শুনে। তখন
আমি অল্প বিদ্যা
ভয়ঙ্করী হয়ে খুব দর্শন
কপচাই। দর্শন ছাড়া
কবিতা হয় নাকি! মুখে
কিছু বলি নি অবশ্য তখন।
আগের মতই লিখেতে
থেকেছি। তখনও বুঝি নি,
এমনকি এখনও বুঝি না,
কবিতা কী ভাবে লেখে বা
কবিতা কী! তবে এখন বুঝি
দর্শন দেখাবার বস্তু
নয়, অন্তঃস্থ করার। তার
জন্য চাই দেখার চোখ।
এরপর ঐহিক এলো। প্রথম
সংখ্যা ফুটবল। তমাল
আমাকে লাইন্সম্যান
বানালো। আমিও বাঁশি
নিয়ে পিঁপিঁ করে মাঠের
বাইরে দৌড় শুরু করলাম।
আর বারীনদা বলে গেল,
তুষ্টি, তুমি বাঁশি
শুনে ফেলেছ এবার। জোরসে
দৌড়োও। ব্যাস্, সেই
থেকে ছুটছি আজও। বাঁশি
শুনি আর নাই শুনি দৌড়
থামাই নি বারীনদা! আর
তারপর থেকে বারীনদা
কালিমাটিই হোক বা ঐহিক,
বা অন্য কোথাও, বারীনদা
(যতদিন সুস্থ ছিল) নিজে
থেকে আমার কোন গদ্য পড়ে
নি বা মতামত দেয় নি, এমন
হয় নি। এরকম হাত আমার
মাথায় আরও দুএকজনের আছে
এখনও। সেদিক থেকে আমার
সৌভাগ্য নিজের কাছেই
ঈর্ষনীয়। দিন কাটতে
থাকল, ঐহিক নিয়ে মেতে
উঠেছিলাম আমরা।
বারীনদা প্রায় প্রতিটি
লেখা পড়ে পুরো ঐহিকের
রিভিউ করত। সেই লেখার
টাইপো ইত্যাদি দেখতে
গিয়ে দেখি, একজনের
লেখার সেখানে উল্লেখ
নেই। বারীনদাকে বললাম,
ওর লেখা নিয়ে কিছু বললে
না? সেই প্রথম রেগে যেতে
দেখেছিলাম। কেন উল্লেখ
নেই তার কারণও আমাকে
জানিয়েছিল, অবশ্যই
সঙ্গত ছিল সেই কারণটি।
পরে অবশ্য সেই লেখক
বারীনদার প্রিয় পাত্র
হয়ে উঠেছিল, সেও কিন্তু
সঙ্গত কারণেই। ঠিক যেমন
আমার কবিতা বদলালো একটু
একটু করে, বারীনদার
প্রশংসাও পেলাম কিছু।
আর হ্যাঁ, আমি আজ
পর্যন্ত নতুন কবিতার
লেখার ধারায় লিখি নি,
বারীনদাও কখনও শেখায়
নি, এমনি করে লেখ, ওমনি
করে লেখ। এই আমার
তত্ত্ব, এ তোমাকে
মানতেই হবে, নইলে বিদেয়
হও- এও কখনও বলে নি।
বারীনদার লেখা নিয়ে
বলার ধৃষ্টতা আমার নেই।
গদ্য পড়েছি কিছু, কিছু
কবিতাও। অতিচেতনার কথা
বুঝেছি যত, না বোঝাই
বেশি। আর এ কথা বলতে
আমার দ্বিধা নেই বা ছিল
না, তার কবিতা আমায় তত
টানে নি, যতটা গদ্য।
তবুও বারীনদার স্নেহ
কমে নি। সঙ্গে মজা, গল্প
তো ছিলই। একটি ঘটনার
উল্লেখ না করলেই নয়।
আমাদের প্রিয় এক কবির
পিতৃবিয়োগ হয়েছে, সে
তখন কর্মসূত্রে বাড়ির
বাইরে। খবর পেয়ে সে
ট্রেনে ফিরছে, শোকে
মূহ্যমান সেই ছেলেটির
সঙ্গে একসময়ে আর ফোনে
যোগাযোগ করা যাচ্ছিল
না। আমি উদ্বিগ্ন, অন্য
অনেকের সঙ্গে
বারীনদাও। কীভাবে
কীভাবে যেন বারীনদার
কাছে খবর এসে পৌঁছে যায়,
সেই ছেলে ফোনের চার্জ
শেষ, এবং সে ঠিকঠাক মতই
ফিরেছে। আমাকে জানিয়ে
দিল তৎক্ষণাৎ, আমিও
নিশ্চিন্ত হলাম। এই
আন্তরিকতা, এই ভালবাসার
মনটি আমি খুব কম
মানুষের দেখেছি। সবার
জন্য ভাবনা নিয়ে বসে
থাকত বারীনদা। আরেকটা
মজার কথা বলি। বারীনদা
আর তার এক বন্ধু,
দুজনেরই যেন শৈশব ফিরে
এসেছিল! তিনি এক লেখেন
আর বারীনদাও সেই কথার
পিঠে আরেক লেখেন,
এইভাবে ব্যাপারটা
ঝগড়ার পর্যায়ে চলে গেল
শেষ পর্যন্ত। যদিও আমরা
জানতাম, এমন্ ঝগড়া ওদের
আগেও হয়েছে। তবে সেবার
বোধহয় একটু সিরিয়াস হয়ে
গেছিলেন দুই বন্ধু।
একদিন সকালে বারীনদাকে
বকুনি দিলাম, কী করছ কী
তোমরা বাচ্চাদের মত!
সবাই হাসছে, মজা নিচ্ছে,
বুঝতে পারছ না? বারীনদা
কোন উত্তর দিল না। আমার
মত আরও অনেকেই নিশ্চই
বুঝিয়েছিল, তারপর থেকে
ওদের ঝগড়া কিন্তু
সত্যিই বন্ধ হয়ে গেল।
আরেকবার বারীনদার ওপর
রাগ হয়েছিল, সেই
ঘটনাটার কথা বলি।
কৌরবের ইতিহাস লিখে
দিতে বলেছিলাম
বারীনদাকে, সংক্ষেপে।
আমায় পরিষ্কার ভাগিয়ে
দিয়েছিল তখন। বলেছিল,
কমলের কাছে যাও, ও এখন
কলকাতায়, কফি হাউসে ওকে
পাবে। আমার তো আক্কেল
গুড়ুম সেই শুনে। সে
লেখা আমি পেয়েছিলাম
অবশ্য আরেকজনের কাছে।
আর তারপরে বারীনদাকে
গিয়ে বলেছি, তুমি লিখে
না দিলে যেন আমি পাব না,
ভেবেছ টা কী! হুঁ!
বারীনদা তখন হেসে
বলেছিল, ওই জন্যই তো
লিখি নি, খালি তোমরা এই
বুড়োটাকে খাটিয়ে নেবে
নইলে! রোজ ভোরবেলা
নিজের বারান্দায়
পাখিদের খাইয়ে এফবি
খুলে কিছু না কিছু নিয়ে
একটা পোস্ট দিত। আর
প্রায়ই থাকত তার
প্রশ্নের ঝুলি। সেখান
থেকে আমরা কত কী যে
জেনেছি! বারীনদাকে আমি
মনে মনে পাখি-মানুষ
ভাবতাম। বারীনদা
পাখিদের ভাষা বুঝত,
পাখিরাও ওর ভাষা বুঝত,
আমি নিশ্চিত ছিলাম। সেই
বারান্দায় বারীনদা রোজ
বসে থাকবে, পাখিরাও
থাকবে, আমি জানি।
একবার অসুস্থ হয়ে আবার
সামলে নিয়েছিল বুড়ো।
সেই থেকে বারীনদাকে কম
দেখতাম এফবিতে। তারপর
ক্রমাগত আক্রমণ সম্ভবত
তাকে ক্লান্ত,
বীতশ্রদ্ধ করে
তুলেছিল। তাই কি এবারে
আর বারীনদা ফিরতে পারল
না? হয়ত অসুখ, হয়ত নিয়তি,
মানুষ তো আর চিরকাল
সশরীরে টিঁকে থাকবে না।
থাকবে মানুষের মনে। গত
গ্রীষ্মে আমের সময়ে,
আমি লিখেছিলাম গাছপাকা
আমের কথা। মানকুন্ডুর
বাগান থেকে নিয়ে আসা
সত্যি সত্যি গাছপাকা আম
খেয়েছি শুনে বারীনদা
সেই নিয়ে পোস্ট দিল,
তুষ্টির যত গাছপাকা
আমের গল্প। আসলে আমি
জানি তো! হিংসেয় জ্বলছে!
আর তখনই কথা দিয়েছিলাম,
পরের বার তোমাকে এখানে
এনে গাছ থেকে আম পেড়ে
খাওয়াব। হল না, হল না,
বারীনদা তোমার আর আম
খাওয়া হল না। হিংসেয়
জ্বল গিয়ে, আমার কী! তুমি
তো আর আসতেই পারবে না!
তাই এবার তোমার নাম করে
প্রথম আমটা আমিই খেয়ে
নেব। বারীনদা আমার গুরু
ছিল না, আমার আম-শাখা,
আমার আম-সখা হয়েই থেকে
গেল মনে। প্রতিবার
বইমেলার সময়ে দেখা হত।
গতবার শেষ দেখা। অনেক
রোগা তখন, আমি গেছি
মেলার শেষ দিনে। প্রণাম
করতেই হৈহৈ করে উঠল,
আবার প্রণাম কেন! আর
তারপরেই দেখি, চোখ ছলছল
করছে ওর, আমায় বলল, সব
শেষ করে এলে! ভুলব না এই
কথাটি- কোনদিন। যদিও
সমস্ত অনুভূতি
প্রকাশ্যে লিখে
জানানোয় আমার প্রচন্ড
অনীহা আছে, তবুও এই
আবেগটুকু প্রকাশ না করে
পারলাম না। আকাশ, বাতাস
সাক্ষী, আর সাক্ষী
বইমেলা, মেলার একটি
চেয়ারের শূন্যস্থান আর
কেউ কোনদিন পূরণ করতে
পারবে না।