বইমেলায় ঘুরে ঘুরে মদ
খেয়েছি সেবার। যখন আর
পারছিনা, দেখি,
‘কৌরব’-এর সামনে
বারীনদা বসে আছে
চেয়ারে। বেশিদিন আগে
নয়, এই ২০১৬। বসে পড়লুম
বারীনদার সামনে
বাঁধানো ফুটপাথে। টাল
সামলানো হাতটা ধরে
বারীনদা বলল—তোর কবিতা
আমার ভালো লাগে, তার
জন্য পায়ের কাছে বসতে
হবেনা। হেবি লেগেছিল
ইগোতে, অবাক হতেও ভুলে
গেছিলাম—এই ধন্দটাই
বারীন ঘোষাল—কী
আশ্চর্য তখন মনেই পড়েনি
এবং আজও কখনও কখনও ভুলে
যাই, স্ট্রেট কথা আর
ব্ল্যাক হিউমারের
আড়ালে লোকটা মজার খেলাই
খেলে গিয়েছেন লেখা থেকে
ব্যবহার ও
সম্পর্কে—সেখানে
কাল্ট ফিগারের থেকেও
প্রমিন্যান্টলি ময়দান
দখল করে থাকে ভূমিকাকে
উহ্য রাখার বারীনীয়
প্রবণতা। যে মানুষ
ধ্বংস করতে জানেনা সে
আর যাই হোক বুদ্ধিমান
নয়। ধ্বংসই অনিবার্য
সৃষ্টিকে ডেকে
আনে—“তখনই বুঝেছিলাম
দিনশেষ / এবার সৎকার হয়
পুড়ে যাবে”। যে
একাগ্রতায় মানুষ নিজের
স্বগতোক্তির সাথে
ভ্রমণে বেরোয়, যে
একাগ্রতায় মানুষ দৃশ্য
ও শ্রাব্যকে
ইন্দ্রিয়াতীত করে তোলে
তাকেই সৃষ্টি বলে।
বারীন সেই সৃষ্টির
সাধনাই করে গেছেন। কেবল
ধন্দ ছড়িয়ে রেখেছেন
কিছু বুদ্ধিমান
ব্ল্যাক
হিউমারে—লুঙ্গি পড়লে
কবিতা লেখা যায় না।
ইন্দ্র (ইন্দ্রনীল ঘোষ)
তখন জামশেদপুরে।
মাঝেমাঝেই যাই আড্ডা
দিতে। সেই যাওয়ায় বিরতি
এলে মেসেজ বক্সে
বারীনদার বার্তা ভেসে
আসত—“কবে আসছিস দেবা?
ওরে আয়, ওরে
আয়রে...”..ভাবি, এই
আন্তরিকতা নিজের
লঙ্গোটিয়া ইয়ারদের
প্রতিও সবসময় দেখাতে
পারি না...বাড়ি, সংসার,
চাকরি—অজুহাত বেশ
লম্বা। এই সেদিনও
জামশেদপুর যাওয়া নিয়ে
কথা হয়েছিল বারীনদার
সাথে। আমি, চাটু
(অনির্বাণ
চট্টোপাধ্যায়), ইন্দ্র
যাব। বারীনদার বাড়িতে
আত্মীয় চলে আসায় আর
যাওয়া হয়নি। ১৭ই আগস্ট
২০১৭, বারীনদা শেষবারের
মত খোঁজ নিয়েছিল—“আসার
কি হল?”...আবারও আমার
ধন্দ রাখতে না-পারা
লম্বা অজুহাত...কী
কোইন্সিডেন্স! যে রাতের
১টা ১০ মিনিটে বারীনদা
চলে যাচ্ছে সেই রাতের
সন্ধ্যায় আমি আর চাটু
কফি হাউসে বসে
জামশেদপুর যাওয়ার কথা
বলছিলাম। আবেগবর্জিত,
নৈর্বক্তিকতা—যা
বারীন ঘোষালের বৃহৎ
সৃষ্টিকর্মের এক
অন্যতম সূচক সেই প্রায়
বিজ্ঞানমনস্ক
নৈর্বক্তিকতা নিয়ে
বারীন ঘোষাল কদাচ বৃথা
মধ্যবিত্ত কালক্ষেপ
করতেন। তাই আসছি বলেই
হাজির হতেন কখনও
প্রকৃতির কাছে, কখনও বা
তরুণ কবির আস্তানায়। এই
ভ্রমণ বা আলাপচারিতাকে
কল্পনার সীমাবদ্ধতাকে
অতিক্রমণের চেষ্টা বলে
ভুল হয় কারো কারো, কখনও
কখনও...আমরা ভুলে যাই
গ্লাসকে দেখার মধ্যেই
জল এবং শূন্যতার
অস্তিত্ব...বারীন
জীবনের বৃত্তকে বাড়াতে
চেয়েছিলেন...চেয়েছিলেন
কল্পনার সীমানাকে
উন্মুক্ত করতে। তাই খুব
সহজেই তিন প্রায়
অপরিচিত তরুণের
আস্তানায় এসে হাজির
হয়েছিলেন ২০০২ সালে।
তখনও কলকাতা প্রচণ্ড
হিউমিড, গরমে চিড়বিড়
করে গা, খালাসিটোলার
দোতলা থেকে চাঁদ ভেসে
যায় ধর্মতলা স্ট্রিটে,
চাপ চাপ ভোরের আলোমাখা
নেশা নিয়ে হঠাৎ কোনদিন
এক সিনিয়র কবি কড়া নাড়ে
ঐ তিন তরুণের মেসের
দরজায়। বারীনদা আগাম
টেলিফোন করে এসেছিল।
সঙ্গে স্বপনদা (রায়)। এ
যোগাযোগ বৈখরী
যোগাযোগ...যে পত্রিকা
পরে শিরোনাম
নেবে—বৈখরী এক ভাষার
নাম। সারারাত আড্ডা
কবিতা নিয়ে, সঙ্গে ওল্ড
মঙ্ক...তর্ক
বারীনদা-স্বপনদা’র
সাথে..হতে হতে সেই তর্ক
একসময়
অমিতাভ(প্রহরাজ)-অনির্ব
াণ-দেবাঞ্জনের নিজেদের
তর্ক...মদের গ্লাস উড়ছে
ঘরের মধ্য, সশব্দে
ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে
মেসের
দেওয়ালে...বারীনদা
চুপ...তর্ক হাঁটতে শিখে
গেছে...কবিতার জন্য
লোকটা সলতে আর আগুন
নিয়ে হেঁটে গেল আজীবন!
তার জন্যই তার
ভালোবাসা, আগলে রাখা।
বকুনিও সে’কারণে—তখন
সৌমিত্রদা (সেনগুপ্ত)
থাকে টালিগঞ্জে।
বারীনদা কলকাতা এলে
ওখানেই উঠত...কবিতার
আড্ডা...একবার আমি আর
অনির্বাণ গেছি। মাস
খানেক লেখালিখির মধ্যে
নেই। সাথে দু’একটা
পুরনো লেখা। কবিতা পড়ার
পালা এলে আমরা বললুম
সে’কথা। বারীনদা বলে
উঠল, দ্যাখ দ্যাখ ওরা মদ
খেতে এসেছে ...তিরস্কার
ভালোবাসার অধিকার
থেকেই আসে। যাকে
বারীনদা কবিতার
অধিকারে পরিণত করেছিল।
২০০৯ সালে ‘নতুন কবিতা’
থেকে প্রকাশিত ‘কবিতার
অধিকার’ বইটি উপহার
দিতে গিয়ে বারীনদা লিখে
দিয়েছিল—“এই অধিকারে
ভালবাসি”। সেই
অধিকারেই ব্যক্তিগত
সম্পর্কের বিপর্যয়ের
দিনে অন্যের মুখ থেকে
শুনে মেল পাঠাতে পারে
স্নেহশীল অভিভাবকের
পরামর্শ দিয়ে। বই পড়ে
চিঠিতে মতামত মেলে ধরেন
বন্ধুর
মত—“যেন—শব্দটা তোর
মুদ্রাদোষ জানিস
কি?”...পারলে, গ্রহণ করলে,
কুড়িয়ে নাও...
পঞ্চেন্দ্রিয়ের আহৃত
জ্ঞানকে জাগতিক বলে
তুচ্ছ করে ভাববাদী
মানুষ। সে খোঁজ করে এক
অধিজাগতিক
মেটান্যারেটিভের। সে
ভাবতে থাকে এহেন
মেটান্যারেটিভ তার
অস্তিত্বের শূন্যতাকে
ঢেকে দিতে পারবে।
ক্রিয়েটিভ অস্তিত্বের
শূন্যতা সেলিব্রেট
করে। তার যাত্রা সবসময়
প্রোলাইফ—বিজনের
আলোবাতাস। তাই সে
পঞ্চেন্দ্রিয়র আহৃত
জ্ঞানকে অস্বীকার করে
না, ফিরিয়ে দেয়, বিলিয়ে
দেয় জীবনের দিকে।
সে’কারণেই প্যাটার্ন
ভাঙ্গা, নতুনের সন্ধান।
তরুণ কবিদের সাহস-তর্ক
বারীন ঘোষাল। প্রথম
প্রকাশিত বই পড়ে লেখা
চিঠিতে, প্রথম প্রকাশিত
গল্পের প্রতিক্রিয়ায়
যেমন সাহস দেয় বারীন
ঘোষাল তেমনি তর্কের
আহ্বানও জানায়।
তর্কগুলো বাকি থেকে গেল
বারীনদা ... কেবলই বারবার
ভেসে উঠছে--“আসার কি হল?”