‘জল চলে গেছে
তারা চলে গেছে
তবে এখানে
পারানি ভুলে আশায়
কাঁপছে কারা
হাওয়া কী
আজ কেমন
করে গাইবে নদীটিকে
গানের ফিরিয়াগুলো ডাক
নামে ডাকে
কত পুরনো দিনের আলো আজ
সূর্য হল
পুরনো
দিনের বারীন
বেড়ালের পথে
শ্রডিঞ্জার
পাখিদের পথে
ইন্দ্রনীল
ফিল
ভুলভুল করছে
দৈর্ঘ ক্রমশ
ছোট হয়ে আসছে যখন
তার থমকে যাওয়া
পাগমার্ক
ডগমগ করছে অমানো
বেশ্যায়
থমথম করছে
অমাবস্যায়
আর আমি
আর কাটা আর কুটি আর
খেলবো না (অমাবস্যা)'
কবিতাটি বারীনদার (কবি
বারীন ঘোষাল) শেষ
প্রকাশিত কবিতার
অন্যতম। প্রকাশিত
হয়েছিল ‘কর্ণ’
পত্রিকায়। কবিতাটিতে
মৃত্যুচেতনার খেলা
রয়েছে। সেই চেতনার রঙ
কালো নয়। বিভিন্ন
শেডের। আলো টু অন্ধকার
এই একমুখী
ধারাপ্রবাহের ভেতরে
পুরনো আলোদের সূর্য হয়ে
ওঠার ছবি আরেক পুরনো
ব্যক্তিসত্তায় এসে
আটকে যায়। বারীন নামের
একটা লোকের কাছে। এই
বারীন নয়। সেতো নতুন।
পুরনো বারীন যে আছে তার
খেলাশুরুর দিনগুলোয় আর
সেইসব পুরনো আলোয় জল
বয়ে গেছে, জলজ
স্মৃতিগুলো চলে গেছে,
শুধু যাওয়া। যাওয়াটা
ফেরৎ আসে আলো হয়ে।
মৃত্যু এক আলোকিত
অন্ধকারের নাম। কবি
বারীনের বিভিন্ন
কবিতায় সে এসেছে,
কবিতাকে বাঁচিয়ে দিয়ে
চলে গেছে। কোন কবিতা?
বারীনদা সারাজীবন
নিজের বিগতা স্ত্রী
ছাড়া আর একটি মহিলাকেই
ভালবেসেছিল, তার নাম
‘কবিতা’! তো, এটা আখছারই
হত। অথচ এই কবিতার কোন
প্রতিমাসুলভ ছবি কবি
বারীনের ভাবনাতেই
ছিলনা।
কাব্যপ্রতিমাকে
অস্বীকার করার ফলে
বারীনদা কবিতাকে তার
মুক্ত পরিসরে কাঁচা
অবস্থায় ছোঁয়ার চেষ্টা
করতো। মনে আছে সিকিমের
‘রাবংলায়’ আমরা
সন্ধ্যার পরে একটা
রাস্তার বাঁকে এসে
দাঁড়িয়েছি। রাবাংলার
উচ্চতা প্রায় ৮০০০ ফুট।
উল্টো দিকের পাহাড়ের
বিভিন্ন উচ্চতায় আলো
ফুটে উঠছে তখন। চোখ
আটকে আমরা সেই ফুটে ওঠা
দেখছিলাম। বারীনদা তখন
বলল, দেখ অন্ধকারের
বুকে ঐ আলোর ফুটকিগুলো,
কেউ যখন প্রদীপ বলবে,
মনে হবে ঠিক। কেউ যদি
বলে ইলেকট্রিক জোনাকি,
মনে হবে আধা পরাবাস্তব।
আর কেউ যদি বলে
‘সিকিমিদিনি’ অনেকের
কাছেই মনে হবে বকোয়াস।
অর্থহীন প্রলাপ।
অর্থযুক্ত কথায় কবিতা
কিন্তু ভরে
উঠেছে।অন্যদিকে
প্রকৃতির অর্থ কিন্তু
কেউ জানেনা। তো, সবাই
বানায়। পাহাড়ে দীপাবলী
দেখে। অন্ধকার আর
ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র
আলোকে বুঝে ওঠার
ব্যাখ্যায় নামিয়ে আনে।
আমার তো মনে হয় এটা
অবমাননা। প্রকৃতি, আলো,
অন্ধকার আমাদের
তোয়াক্কা করেনা। দূর
পাহাড়ের ঐ আলোগুলোকে
যদি প্রকৃতির অংশ ভাবি,
অলংকার নয়, অংশ ভাবি
তাহলে আর প্রতিমা বা
ইমেজ গড়ে উঠবে না।
প্রকৃতির ভাস্টনেসের
কাছে সামান্য ইমেজ বা
ইমেজারি নেহাতই
সীমাবদ্ধ একটা প্রকাশ
যাতে ‘দেখিয়ে’র মিথ্যে
লেগে আছে। কবিতা কিন্তু
ঐ কাঁচা অবস্থায় ব্যপ্ত
হয়ে চলেছে। তার শব্দ,
ধ্বনি ছুঁয়ে দেখার
ইচ্ছে হয়না? তাইতো
চেতনাকে বাড়াবার কথা
বলি। চেতনা
‘সিকিমিদিনি’কে
আবিষ্কার করে নেবে।
যে ঠিক করে নিয়েছে
নিজেকে বদলাবে না, যার
কাছে পঞ্চাশে শুরু হওয়া
প্রথাসিদ্ধ বহু
ব্যবহৃত ছন্দের
বারান্দাটাই কবিরা
আধার বা আধেয় তার কাছে
কিন্তু বারীন ঘোষাল
অস্পৃশ্য থেকে যাবে।
এরকমই মাইণ্ডসেট থেকে
‘নতুন কবিতা’কে বলা
হয়েছিল পাঠকঅস্পৃশ্য
কবিতা। যিনি বলেছিলেন
তাঁর দোষ নেই। তাঁর
নিজের অস্পৃশ্যতাকেই
তিনি সার্বজনীন ভেবে
নিয়েছিলেন। বাংলা
কবিতা দু’ভাগ হয়ে গেছে।
প্রথমভাগে অত্যন্ত
উচ্চমানের পুরনো
কবিতার বিখ্যাত কবিরা,
দ্বিতীয়ভাগে
অভিযাত্রী কবিরা, যাদের
কোন স্টেক নেই। এই
দ্বিতীয় ভাগ আকাশ থেকে
পড়েনি। নানাবিধ কবিতা
ভাবনার মিথষ্ক্রিয়ায়
তৈরি হয়েছে। এই কবিতার
যারা পাঠক তাদের কাছে
পুরনো কবিতা ঐতিহ্যের
অংশ। অত্যন্ত
মূল্যবান।কিন্তু তারা
নিজের কবিতাটিকে
খুঁজছেন। আর সেটা
‘কাঁপো’র সঙ্গে ‘পাপও’
মিলিয়ে নয়। নিজের
কবিতাভাষা তৈরি না হলে
বাংলা কবিতায় আবার
রক্তাল্পতা দেখা দেবে।
কবি বারীন সারাজীবন এই
কাজটিই করেছেন। নতুন,
নতুন আর নতুন। নিজের ঘর
হোক তরুন কবির, তাতে বড়
কবির প্রাসাদলিপ্ত
জৌলুস হয়ত থাকবে না
কিন্তু নিজের ঘরের
স্বাভিমান থাকবে।
স্বাতন্ত্র থাকবে।
বারীনদা, কবি বারীন
ঘোষাল, হাতে কলমে কাজ
করা লোক। নিজের লেখায়
এই কাজটিই করেছে
সারাজীবন। সে গদ্যে হোক
অথবা কবিতায়। যে
কবিতাটি প্রথমে দিয়েছি
তাতে এই জীবনব্যাপী
কবিতাযাপনের একটা
সংমিশ্রণ আছে। বেড়ালের
পথে যাওয়া শ্রডিঞ্জার
আর পাখিদের পথে যাওয়া
ইন্দ্রনীল এই দুটো
ভাবনাগতভাবে আলাদা
পথের পথিক। একটি পথে
যুক্তিসিদ্ধ
অনুসন্ধান আরেকটিতে
জলযুক্তির উড়ান। কবি
বারীনের কবিতাভাবনায়
এই বিরোধাভাসগুলি
অতিচেতনায় মিশে
গিয়েছিল। এই ভাবনার
জায়গাটা কিন্তু জটিল
আবার তাকে প্রয়োগ করার
কাজটা আরো কঠিন।
বারীনদার কবিতাতেও এটা
ধরা পড়েছে। মায়াবী
সীমূমের প্রতিকবিতার
পর থেকে নতুনভাবনার
লেখা ধীরে ধীরে পরিনত
হয়েছে। নিরীক্ষার
সর্বোচ্চ স্তরকে
বারীনদা ‘এঃ লুলু’র পর
থেকে অপরিসীম দক্ষতায়
নতুনের পরিধিতেই সহজ
করে তুলেছে। মৃত্যুর
কয়েকমাস আগে লেখা উপরের
কবিতাটি তার প্রমাণ।
বারীনদাকে আমি মজা করে
ডাকতাম বাঘো বলে।
ওড়িয়াতে বাঘ’কে বাঘো
বলে। বারীন ঘোষাল
বা.ঘো। বাঘ। বাঘের
মেজাজও ছিল। মেজাজের
রাজাও ছিল। নিজের শর্তে
বেঁচেছে, লিখেছে। যারা
নিন্দে করেছে, কুৎসা
করেছে তাদের দিকে ফিরেও
তাকায়নি। তারা ডেকে
ডেকে ক্লান্ত হয়েছে।
স্বভাবত আবার ডাক
পেড়েছে। আবার। আবার।
বাঘ উত্তর দেয়নি। বাঘ
ভাবে এই প্যানিক তো বাঘ
থাকলে বেচারা ভীরু
প্রাণীরা করবেই। আর তার
নিজের অবস্থান সে নিজেই
লিখেছে এভাবেঃ
‘তার থমকে যাওয়া
পাগমার্ক
ডগমগ করছে অমানো
বেশ্যায়
থমথম করছে
অমাবস্যায়..’
বাঘো, বারীন ঘোষাল
যাওয়ার আগে তাই লিখে
গেছে, ‘আর আমি আর কাটা আর
কুটি আর খেলবো না..’