‘ যদি ভাবো , তবে এই ---
এইটুকু উত্তরাধিকার ;
আর কিছু ভাঙা ইট,
একটি-দুটি দগ্ধ
শিলালিপি ।’
জয়দেব বসু
খ্রীস্টপূর্ব ২৬১ সাল ।
ইতিহাসের সবচেয়ে
কলঙ্কিত এক যুদ্ধ । এক
লক্ষ মানুষ নিহত ।
দেড়লক্ষ মানুষ বন্দি ।
পাশাপাশি রণনৈতিক এবং
রাজনৈতিক দু ’ দিক
থেকেই
গুরুত্বপ্রাপ্তি । তার
আগে অবশ্য বিজয়ী
সেনাবাহিনীকে প্রবল
প্রতিরোধের সম্মুখীন
হতে হয় । তা সত্ত্বেও
প্রবল পরাক্রমশালী
রাজাধিরাজ অভিজাত ,
সাধারণ মানুষ , শিশু ,
বৃদ্ধ , নারী
নির্বিশেষে গণহত্যার
ছবিগুলো দয়া নামের এক
নদীর জলে মিশিয়ে দিয়ে
যান । যুদ্ধের রঙ যে
টকটকে লাল ; আরও একবার
ইতিহাস লিখিয়ে দিয়ে যায়
সে কথা । গল্পটা যে
অশোকের কলিঙ্গ বিজয়ের
সবাই জানে । এও জানে
সক্কলে এর পর ভারতীয়
সমাজের আত্মিক
জীবনধারায় এক বিশাল
পরবর্তন লক্ষ করা যায় ।
প্রবল শক্তিশালী এক
রাষ্ট্রের শীর্ষে
স্বৈরতন্ত্রী
একচ্ছত্র এক রাজা মাথা
নোয়ান শাশ্বত
মানবধর্মের কাছে ।
ইতিহাস যাকে এতযুগ যাবৎ
চিনে এসেছিল চণ্ডাশোক
নামে , শুধু তথাকথিত
একটিমাত্র মহাযুদ্ধে
তাঁর মানসিক ও
চারিত্রিক পথ পরিবর্তন
তাঁকে ধম্মাশোকে পরিণত
করে দেয় । এর পরের
গল্পটাও সবার জানা ।
বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে
সম্রাট অশোক তেরোটি
শিলালিপিতে তাঁর এবং
বৌদ্ধধর্মের মহান
আদর্শ প্রচার করেন ।
ধর্ম বলতে সাধারণত
যেখানে আচার - আচরণের
এবং নীতিনিষ্ঠ
জীবনযাপনের নিয়মকানুন
বোঝাতো , সেইখান থেকে
কেবলমাত্র জীবনকে ধারণ
করার কথা সর্বপ্রথম
অশোকই বলে এসেছেন
মানবসমাজকে ।
অন্ততপক্ষে এই কারণেই
সম্রাট অশোককে ‘ the first
religious teacher of human race ’ নামেও
ডাকা হয়ে থাকে । পরের
বিষয়ে যাওয়ার আগে একবার
ভেবে নেওয়া
যাক ‘ ইতিহাস থেকে
কলিঙ্গ যুদ্ধ যদি মুছে
যেত, তবে কী হতে পারত ’ !
এর পরের ঘটনাটি তার
থেকে প্রায় আঠারো’শো
বছর পরের । ১৫২৭ সাল ।
ভারতবর্ষের আকাশ থেকে
সদ্য উধাও হয়েছে
সুলতানি হাওয়া । কামান
এবং বারুদের প্রথম
প্রচলন করে আগমন ঘটেছে
‘ প্রিন্স অফ
অটোবায়োগ্রাফার ’
বাবরের । ফারগানা
রাজ্যের অধিপতি ওমর শেখ
মীর্জার পুত্র
জাহিরুদ্দিন মহম্মদ
বাবর । ‘ বাবর ’ শব্দের
অর্থ ‘ বাঘ ’ । কিন্ত
১৫২৭ খ্রীস্টাব্দে
খানুয়ার যুদ্ধ ব্যতীত
কখনওই ওনার নামকরণের
সার্থকতা বিচার করা যেত
না । রাজপুত সেনাপতি
রানা সঙ্গ আঠারোটি
যুদ্ধে জয়লাভ করে
প্রচুর খ্যাতি ও সম্মান
পেয়েছিলেন । তাছাড়া
রাজপুত যোদ্ধারা যে
তাঁদের বীরত্ব ও
শৌর্যের জন্য বিখ্যাত
ছিলেন , তা আমরা সবাই
জানি । রানা সঙ্গের
সৈন্যসংখ্যাও ছিল
বিশাল । ডাঃ এ এল
শ্রীবাস্তবের মতে
রাজপুত ও মুঘলদের
সৈন্যসংখ্যার অনুপাত
ছিল দুই ভাগের এক ভাগ ।
কিন্তু বাবরের তীক্ষ্ণ
রণকৌশল এবং বিচক্ষণতা
এই রকমের বিপুলায়তন
সৈন্যসংখ্যার সামনেও
বিজয়ের জয়োল্লাস জারি
রেখেছিল । অতঃপর
খানুয়ার এই যুদ্ধের পর
ভারতে মুঘল শক্তির
ভিত্তি আরও দৃঢ় করে
বাবর নিজেকে ‘ গাজি ’
বলে সম্বোধন করেন এবং
মুঘলদের রাজধানী কাবুল
থেকে দিল্লিতে
স্থানান্তরিত করেন ।
ঐতিহাসিক রাশব্রুক
উইলিয়ামসের মতে , ‘
খানুয়ার আগে , ভারত
অধিকারের প্রশ্ন ছিল
দুঃসাহসিক জীবনের একটি
উপাখ্যান মাত্র ; এখন
থেকে তাঁর বাকি জীবনের
জন্যে এই লক্ষ ছিল
একান্ত বাস্তব ও প্রধান
ঘটনা । ’ এরও প্রায় বছর
তেরো পর বাবরেরই পুত্র
হুমায়ুনকে চৌসার
যুদ্ধে চূড়ান্তভাবে
পরাজিত করেন আরেক
দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বীর
ফরিদ খাঁ ওরফে শেরশাহ ।
হুমায়ুন তাঁর
রাজত্বকালের বেশিরভাগ
সময়ই তাঁর রাজ্য থেকে
বিতাড়িত ছিলেন
শেরশাহের প্রভাবে ।
উত্তর -পশ্চিম ভারতের
পার্বত্য এলাকায়
রীতিমত পালিয়ে প্রাণে
বেঁচেছিলেন । চৌসার
যুদ্ধে পরাজয়ের পর তার
পরের বছরই অর্থাৎ ১৫৪০
সালে হুমায়ুন শক্তি
সংগ্রহ করে তাঁর হারানো
সাম্রাজ্য
পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে
পুনরায় শেরশাহের সঙ্গে
যুদ্ধে লিপ্ত হন ।
ইতিহাসে এটি কনৌজ বা
বিল্বগ্রামের যুদ্ধ
নামে পরিচিত । দুঃখের
বিষয় , এই যুদ্ধেও
হুমায়ুন শেরশাহের কাছে
চূড়ন্তভাবে পর্যুদস্ত
হন । ‘ হুমায়ুন ’ এই
শব্দের অর্থ হল , ‘
ফরচুনেট ’ বা
‘ ভাগ্যবান ’ । যদিও
প্রথাগত নামের
ঐতিহ্যকে উনি কখনওই
ধারণ ও বহন করতে পারেন
নি । তবে সূর্য গ্রহণের
পরেও যেমন কিছু সময়ের
অবকাশে সূর্যকে
উজ্জ্বলভাবে ফিরে
পাওয়া যায় আকাশে , তেমন
করেই হুমায়ুনও ফিরে
এসেছিলেন ১৫৫৫ সালের
মাঝবরাবর । শেরশাহের
মৃত্যুর পর তাঁরই পুত্র
সিকান্দর সুরি
শিরহিন্দের যুদ্ধে
হুমায়ুনের কাছে পরাজিত
হন । ইতিহাসে এই
যুদ্ধের গুরুত্ব
সত্যিই অপরিসীম । এই
যুদ্ধ যদি ইতিহাসে
সংগঠিতই না হত , তবে কে
জানে মুঘল যুগের
সর্বশেষ শাসক হিসেবে
দ্বিতীয় বাহাদুর শাহর
পরিবর্তে হুমায়ুনের
নামই উজ্জ্বল অক্ষরে
লেখা থেকে যেত ।
এ বার আসা যাক একটু অন্য
বিষয়ে । না , ইতিহাস
সম্পর্কিতই বটে । তবে
প্রথাগত যুদ্ধ নয় । বরং
যুদ্ধের ঊর্ধে যে
আত্মজ্ঞানের পরিধি ,
তার মধ্যেকার শাশ্বত
সত্য এবং চরম বাস্তবতার
বশবর্তী যুদ্ধ । গৌতম
বুদ্ধ । আসল নাম
সিদ্ধার্থ । পিতা রাজা
শুদ্ধোধন । স্ত্রী
যশোধরা । অধুনা নেপালের
কপিলাবস্তুর লুম্বিনি
উদ্যানের রাজপরিবারে
তাঁর জন্ম । একদিন তরুণ
সিদ্ধার্থ তাঁর
রাজত্বের কোনো একটি
উদ্যানের পাশ দিয়ে
হেঁটে যাচ্ছিলেন । হঠাৎ
সামনে আবির্ভূত তিনটি
দৃশ্য তাঁর জীবনের পট
বদলে দেয় । সবার প্রথমে
সিদ্ধার্থ একজন অসুস্থ
মানুষকে দেখতে পান । এর
আগে কখনও কোনো অসুস্থ
মানুষ সিদ্ধার্থের
চোখে ধরা পড়ে নি । তাই
প্রথম দেখাতেই
সিদ্ধার্থ অত্যন্ত
বিচলিত হয়ে ওঠেন । এরপর
তিনি একটি মৃত ব্যক্তি
ও একজন মহাজ্ঞানী দেখতে
পান ।
জন্ম - মৃত্যুর সহজ এবং
সত্যার্থ পরিণাম
সম্পর্কে অবগত হয়ে এর
পর সিদ্ধার্থ
বোধিদ্রুমের মাধ্যমে
গৌতম বুদ্ধে
আত্মপ্রকাশিত হন । ৪৮৭
খ্রীস্টপূর্বাব্দে
কুশিনগরে গৌতম বুদ্ধ
নামে মহানির্বাণ লাভ
করেন । বিনয় পিটক, সূত্র
পিটক এবং অভিধম্ম পিটকে
গৌতম বুদ্ধের বাণী
লিপিবদ্ধ করা আছে ।
ভাববার বিষয় এই যে ,
সেদিন যদি ওই তিনজন
আগুন্তুকের সম্মুখীন
সিদ্ধার্থ না হতেন , তবে
কী আজকের গৌতম বুদ্ধকে
আমরা খুঁজে পেতাম ? হয়ত
পেতাম , হয়ত বা না । সে
প্রসঙ্গে আসছি না । তবে
এ কথাটা তো সত্যি যে
সিদ্ধার্থ থেকে গৌতম
বুদ্ধের রূপান্তরণও এক
ধরনের যুদ্ধ জয় ।
সত্যকে উপলব্ধি করবার
যে যুদ্ধ , সেটাকে
অনাবিলভাবে জয় করা ।
কিন্তু ঠিক কতটা সত্য
এইসব যুদ্ধ জয় ? কতটা
নির্ভুল এই ইতিহাস ?
কতটা যথাযথ এই ঐতিহাসিক
পাক্ষিকতা ? আজ খুব কম
মানুষই হয়ত জানেন যে
অশোকের কলিঙ্গ
আক্রমণের সময়
কলিঙ্গরাজ ছিলেন
শিশুগুপ্ত । এ
ব্যাপারেও অনেকে
সন্দিহান । সকলেই জানে
বাবরের ইতিহাস । তাঁর
যুদ্ধজয় সম্পর্কে আমরা
সত্যিই অবগত । কিন্তু
কতজন জানেন রানা সঙ্গ
সম্পর্কে ? কতজন চেনেন
শিকান্দর সুরি বা
সিদ্ধার্থের দেখা সেই
মৃত মানুষটিকে ? কিংবা
সেই অসুস্থ অথবা
মহাজ্ঞানী
ব্যক্তিটিকে ? তাঁরা কে
ছিলেন ? তাঁদের কোথায়
বাড়ি? কী বা করতেন ?
কীভাবেই বা মৃত্যু হল ?
ইত্যাদি ইত্যাদি ।
আপেক্ষিকভাবে দেখতে
হলে হয়ত এঁরা নিতান্তই
গুরুত্বহীন এক একজন
সাধারণ
মানুষ । কিন্তু তাঁরা
সেদিন যদি সিদ্ধার্থের
সম্মুখে না আসতেন ? এক
মুহূর্তের জন্য হলেও
কিছুটা তো পিছিয়েই
পড়তাম
আমরা ।
ইতিহাস , যা আমরা জেনে
আসি, তা যে বেশীরভাগ
ক্ষেত্রেই কেবল বিজয়ীর
ইতিহাস , সে বিষয়ে গোটা
পৃথিবীতেই বহুল
দৃষ্টান্ত আছে । কিন্তু
এটা ভুললে কী করে চলবে
যে ইতিহাসে পরাজিতরাই
তো বিজয়ীর ইতিহাস তৈরি
করে । শুধু পরাজিত শাসক
বা স্থান বা সময় নয় ,
পরাজিত সমাজ , সেখানকার
মানুষজনও দায়ী বিজয়ীর
ইতিহাস রচনায় । ফলে
একদিক থেকে যেমন
বিজিতেরা না থাকলে
বিজয়ীর ইতিহাসই রচনা হত
না, তেমনি অন্যদিক থেকে
এও সত্য যে ইতিহাসের
একপাক্ষিকতার প্রভাবে
বিজিতদের ইতিহাস ক্রমে
অবক্ষয়মান এক লুপ্ত
ইতিহাসে পরিগণিত হয় ।
এটা নির্লিপ্তভাবেই
ইতিহাসের একটি মিসটেক ।
কালের অবগুণ্ঠনের কাছে
ফসিল হয়ে যাওয়া বিজিতরা
এই ভুলের কারণেই হয়ত বা
এখনও রয়ে গেছেন
স্তব্ধতার গানে ।
ইতিহাসের সাথে ভুল আর
সঠিকের বেটন দেয়া - নেয়া
করছেন ।