সন্ধ্যের আবছায়া আলো ,
সদ্যোজাত কুয়াশা এবং
ধরা যাক কারেন্ট নেই ।
পাঁচ তলা ছাদের উপর
থেকে শহরের আধা অন্ধকার
রূপ দর্শন । তার
মাঝখানে কখন যেন ফেলে
আসা দিনগুলো ছায়াছবির
মত জমাট বাঁধতে থাকে
আনমনে , বেখেয়ালে ।
স্মৃতির টুকরো আলেখ্য ,
আর ভুলের ইতিহাস ।
ভুলের স্মৃতিও সুন্দর
লাগে মাঝে মাঝে ।
যুক্তি খুঁজি ঠিক
প্রমাণ করবার । হঠাৎ
উপলব্ধি হয় ভুল – ঠিকের
চূড়ান্ত কোন সংজ্ঞা আছে
কিনা । আক্ষেপ হয়তো রয়ে
যায় কিন্তু তার চেয়েও
বড় হয়ে রয়ে যায় অবস্থান
। ঘটনার কোন তীরে
দাঁড়িয়ে বিচার করছি ঠিক
বা ভুলের ? প্রবহমান
সময়ের সাথে সাথে এবং
প্রতি মুহূর্তের
অবস্থানে ঠিক ভুলের
সংজ্ঞা কি বিপরীতগামী
হয়ে থাকে ? সহসা কারেন্ট
চলে আসে । শহর ধুয়ে যায়
আলোর মোচ্ছবে ।
এতক্ষণের চিন্তার
অসারতা বোধগম্য হয় এবং
ঘাড় ফিরিয়ে দেখি সামনে
দাঁড়িয়ে বর্তমান ।
সেদিন কাগজের পাতায়
খবরটা এসেছিল যে কয়েকজন
স্বাধীনতা সংগ্রামী
শহীদকে সন্ত্রাসবাদী
বলা হয়েছে সরকারী স্কুল
পাঠ্য বইয়ে । হতে পারত
ছাপার ভুল কিন্তু , তা নয়
, তেমন দাবী আসেনি ।
তাহলে দুটো সম্ভাবনা
বাকি থাকে হয়
ক্ষুদিরামরা ভুল অথবা
অষ্টম শ্রেণীর পাঠ্য
বইয়ের বক্তব্য ভুল ।
কিন্তু এর বাইরেও একটা
তৃতীয় সম্ভাবনা থেকে
যায় । শোনা যাচ্ছে এ
যুগের সন্ত্রাসবাদের
বিষয় আলাদা , তখন আলাদা
ছিল , স্বাধীনতা
সংগ্রাম ইত্যাদি
ইত্যাদি । বাইনারি
ডিজিটে পৃথিবীর ঠিক ভুল
বোধহয় সবক্ষেত্রে
হিসাব হয় না , তাই তৃতীয়
সম্ভাবনা হিসাবে এসে
যায় দোদুল্যমান এক
প্রশ্নচিহ্ন , কনফিউশন
। সন্ত্রাসবাদ আসলে কি ,
কোথায় দাঁড়িয়ে দেখছি
তার উপর নির্ভর করে
হয়তো অনেক কিছুই ।
মাঝখানে আরও রয়েছে
সময়ের বিস্তর ব্যবধান ।
১৯৭৬ সালের ৭ই আগস্ট
আনন্দবাজার পত্রিকায়
জনৈক পত্রলেখক
লিখেছিলেন :
ওরা কি ডাকাত ?
'কলকাতা টিভি কেন্দ্র
হতে প্রচারিত গত ২৩শে
জুলাই -এর নিউজ
বুলেটিনে দেশের
স্বাধীনতা সংগ্রামের
অন্যতম শহীদ বীর
বিপ্লবী যতীন দাস ও
সর্দার ভগত সিং এর
সহযোদ্ধা চন্দ্রশেখর
আজাদ ও বটুকেশ্বর
দত্তকে রাজনৈতিক
"ডাকাত" বলে চিহ্নিত
করা হয়েছে । দেশের
স্বাধীনতা সংগ্রামের
এই সকল দুর্ধর্ষ
বিপ্লবী যোদ্ধার
সম্পর্কে
সাম্রাজ্যবাদী
ব্রিটিশ শাসকবর্গ
ভারতকে শোষণ ও শাসনের
উদগ্র নেশায় বা
স্বার্থে অনুরূপ ভাষা
(যথা ডাকাত , উপদ্রবকারী
বা সন্ত্রাসপন্থী ) বলে
আখ্যা দিতে অভ্যস্ত ছিল
। কিন্তু দেখা যাচ্ছে
যে , বিদেশী শাসকরা এদেশ
থেকে চলে গেলেও দেশের
বিপ্লবী স্বাধীনতা
সংগ্রামীদের সম্পর্কে
কিছু
গোলামী-মনোভাবাপন্ন
লোক বিদেশী শাসকদের
দ্বারা ব্যবহৃত
অসম্মানসূচক
শব্দগুলির চর্বিত
চর্বণ করতে কিছুমাত্র
দ্বিধা বা লজ্জাবোধ
এখনও করে না । দেশের
স্বাধীনতা
সংগ্রামীদের সম্পর্কে
ভবিষ্যতে ভাষা
প্রয়োগের ক্ষেত্রে টি
ভি
( কলকাতা কেন্দ্র )
সচেতন ও যত্নশীল হবেন
আশা করতে পারি কি ? '
পত্রলখক যাই আশা করে
থাকুন না কেন , হিসাব
হয়তো বদলায় নি । নিছক
ভুল হয়তো বা নয় , তাই । এই
প্রসঙ্গে ‘ ডাকাত ’
চন্দ্রশেখর আজাদের
সহযোদ্ধা ভগত সিং – এর
বক্তব্যে একবার চোখ
বুলিয়ে নেওয়া যেতে পারে
। “ সন্ত্রাসবাদ পূর্ণ
বিপ্লব নয় , কিন্তু
সন্ত্রাসবাদ ব্যতীত
বিপ্লব পূর্ণতা লাভ
করতে
পারে না । সন্ত্রাসবাদ
বিপ্লবের জন্য
প্রয়োজনীয় অনিবার্য
একটি অঙ্গ । পৃথিবীর
ইতিহাসে যে কোন একটি
বিপ্লবকে বিশ্লেষণ
করলে এই সিদ্ধান্তের
সমর্থন পাওয়া যাবে ।
সন্ত্রাসবাদ শত্রুর
মনে ভীতির সঞ্চার করার
মধ্যে দিয়ে নিপীড়িত
মানুষের ভিতরে
প্রতিরোধের আকাঙ্ক্ষা
জাগায় , তাকে শক্তি দেয়
। দোদুল্যমান চিত্ত
ব্যক্তিরা এরই
ভিত্তিতে সাহসে বুক
বাঁধে , তার মধ্যে
সৃষ্টি হয়
আত্মবিশ্বাসের । এর
মাধ্যমে দুনিয়ার সামনে
বিপ্লবের উদ্দেশ্য
যথার্থভাবে প্রকাশিত
হয়ে যায় , কারণ এর মধ্যে
দিয়ে কোন একটি দেশের
অভ্যন্তরে স্বাধীনতার
জন্যে যে মহৎ এবং তীব্র
আকাঙ্ক্ষা তা দৃঢ়
ভিত্তির উপর দাঁড়াতে
পারে । অন্যান্য দেশের
মতো ভারতেও
সন্ত্রাসবাদ একদিন
বিপ্লবের রূপ ধারণ করবে
এবং এর পরিণতিতে
বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে
দেশে সামাজিক ,
রাজনৈতিক তথা
অর্থনৈতিক স্বাধীনতা
আসবে ” - হিংসা ও
অহিংসার প্রশ্নে ।
উদ্দেশ্য ও বিধেয়ের
ফারাক আর অবস্থান , ঠিক
ভুলের ফারাক নির্ধারণ
করে থাকে বৈকি । কলকাতা
টিভি কেন্দ্রের নিউজ
বুলেটিন আর অষ্টম
শ্রেণীর ইতিহাস
নির্মাতারা তাই হয়তো
ভুল করেননি । তাঁদের
অবস্থান হয়তো বাধ্য
করেছে তাঁদের ঠিককে
সামনে তুলে ধরতে ।
তাঁদের ঠিকটা
সার্বজনীন ঠিক নয় যেমন ,
সার্বজনীন ভুলও নয় ।
উদ্দেশ্য – বিধেয় -
অবস্থানের কোন পারে
সময়ের স্রোতের সাথে
সাথে আমি বা আপনি
দাঁড়িয়ে আছি , সেখানেই
নির্ধারিত হবে ঠিক ভুল
বিচার । প্রশ্ন একটাই
দোদুল্যমান থাকবো না
অবস্থান নেবো । সিলেবাস
নির্মাতারা তাঁদের
অবস্থান নিতে ভুল
করেননি ।
ঘাড় ফিরিয়ে ব্যথা হয়ে
গেল , এবার সোজা করা যাক
। বর্তমান থেকে তাকাই
অতীতের দিকে ।
স্বাধীনতা সংগ্রামের
দুই চরিত্র । একজন
অখ্যাত , অনামী , ব্রিটিশ
শাসকের চোখে
সন্ত্রাসবাদী এবং
ফাঁসির
আসামী ; দ্বিতীয়জন
স্বনামধন্য , বিশ্বময়
যার পরিচিতি ; অহিংসার
প্রশ্নে যার সাথে বুদ্ধ
এবং যিশুর তুলনা টানা
হয় । দুজনের জীবনের
দুটি বিশেষ ঘটনা নিয়ে
আলোচনা করবো , সামগ্রিক
ঠিক ভুলের আওতার বাইরে
। সম্পূর্ণ আলাদা
প্রেক্ষাপটে দুই ঘটনায়
এঁদের ঠিক ভুল বিচারের
দায় না নিয়ে ঘটনাটাই
শোনাব শুধু , বিচার
পাঠকের হাতে ।
বলতেই পারেন এমন ভুল
হয়ে যেতে পারে । অথচ এ
কিন্তু ভুলো মনের ভুল
নয় । ভুল করবার সময়
মানসিক স্থিতাবস্থাও
স্ক্রু গেজ দিয়ে মাপা
হয় নি । এবং ভুলটা ভুলই ।
এমন ভুলের সঙ্গে কিছু
অধিকারের প্রশ্ন জড়িয়ে
থাকে , অথবা
অধিকারহীনতার ।
স্বেচ্ছায় কিছু অধিকার
ছেড়ে আসা , যা নিয়ে আর
আক্ষেপ তো দূর ফিরে
তাকানোর প্রশ্ন
পর্যন্ত আসে না । এমনকি
ফাঁসির মুহূর্তেও আসে
নি । প্রবেশ নিষেধ সাইন
বোর্ড টাঙানোর সাথে
সাথে অনুপ্রবেশ রোধ করা
যাবে এমনটা মনে করার
কোনও কারণ নেই । কারণ
ছিদ্র সতত বর্তমান ।
সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম
রন্ধ্র পথ বেয়ে সে
এগিয়ে আসে ; আর সকলের
চোখে অপরাধী হয়ে যাওয়া
। অবশ্য সব ভুলই এমন নয় ।
এ এক বিশেষ ধরণ ।
একশ বছর আগে যারা বোমা
বন্দুক নিয়ে ব্রিটিশ
খ্যাদাবে ভেবেছিল
তাঁদের একজনের গল্প ,
ভুলের গল্প । বর্তমান
স্কুল পাঠ্য সিলেবাসে
সন্ত্রাসবাদী তকমায়
ভূষিত এক মানুষের ভুল ।
যার পিতৃদত্ত নাম বীরেন
দত্তগুপ্ত । আলিপুর
বোমা মামলার ডেপুটি
সুপারিন্টেনডেন্ট অফ
পুলিশকে সরিয়ে দেবার
দায়িত্ব তাঁকে
দিয়েছিলেন খোদ
যতীন্দ্র নাথ মুখার্জি
ওরফে বাঘাযতীন । টেক্সট
বইয়ের ভাষায় এগোতে শুরু
করলে বলা যায়
সন্ত্রাসবাদীদের
মাস্টার মাইন্ড , মোস্ট
ওয়ান্টেড পারসন । না ,
বীরেন কিন্তু
লক্ষ্যচ্যুত হয়নি ।
১৯১০এর ২৪শে
ফেব্রুয়ারী দিনের
বেলায় হাইকোর্টের
সিঁড়ি বেয়ে যখন সামশুল
আলম উঠে যাচ্ছিলেন ,
বিপরীতমুখে নেমে আসছিল
বীরেন । শুধু একটা
প্রশ্ন করেছিল , আপনিই
কি সামশুল আলম ? উত্তরে
হ্যাঁ বলতেই দ্বিধাহীন
ভাবে গুলি চালিয়েছিল
বীরেন । টার্গেট মিস
হয়নি এবং গুলি শেষ হবার
আগে অব্দি সে পালাবার
চেষ্টা করেছিল । শেষ
হবার পর ধরা পরা ছাড়া
অপশন ছিল না কিছু ।
পুলিশ লক - আপে ভুলেও মুখ
খোলে নি বীরেন । কে তাকে
পাঠিয়েছে , নেতা কে , কোন
প্রশ্নের জবাব দেয় নি ।
তার জন্য ক্রমাগত
বেড়েছে অত্যাচারের
পরিমাণ , থার্ড ডিগ্রী ;
কিন্তু কিছুতেই মুখ
খোলাতে পারেনি কেউ ।
বরং দু’চোখে উল্লাস
যেন ফেটে পড়ছে তার ।
কদিনের মধ্যে ফাঁসি হয়ে
যাবে এবং ক্ষুদিরাম ,
কানাইলালদের তালিকায়
সেও হবে একজন । যাই
প্রশ্ন করা হয় , উত্তর
আসে বলা যাবে না গুরুর
বারণ । আদালতে আইনজীবী
নিশীথ সেন তাকে বিকৃত
মস্তক পর্যন্ত ঘোষণা
করলেন কিন্তু তার মুখে
তৃপ্তির হাসি কেউ কেড়ে
নিতে পারল না । এবং
যথারীতি হয়ে গেল ফাঁসির
হুকুম । শোনা যায় রায়ের
পর বিচারপতি তার কিছু
বলার আছে কিনা জানতে
চাইলে , সে কচুরি ,
সিঙ্গারা , রসগোল্লা
খেতে চায় । মধুরেন
সমাপয়েৎ ।
এহেন বীরেন ফাঁসির আগে
জবানবন্দী দিল ফার্স্ট
ক্লাস
ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে
। সনাক্ত করল সেই
ব্যক্তিকে যে তাকে
সামশুল আলমকে হত্যা
করার নির্দেশ
দিয়েছিলেন । তারপর ঝুলে
পড়ল ফাঁসির দড়িতে ! গল্প
কথা মনে হচ্ছে ??
একেবারেই না । এটাই
ইতিহাস এবং এখানে কোন
ভুল নেই । তবে কি জেলে
ফাঁসির জন্য দিন গুনতে
গুনতে সত্যিই মানসিক
ভারসাম্য হারিয়ে
ফেলেছিল বীরেন ? শেষ
মুহূর্তে মত বদলে ঠিক
করেছিল কানাইলাল নয় ,
ইতিহাসে নরেন গোঁসাইএর
সাথে এক তালিকায় রেখে
দেবে নিজের
নাম ? ভুলটা কার , কেন ,
কোথায় ?
এই অসমীকরণের অপর
প্রান্তে দাঁড়িয়ে
বাঘাযতীন । তিনি সত্যিই
আঠারো বছর বয়সের
ছেলেটার জন্য কিছুই
করতে পারলেন না । ধরা
পরার পর থেকে কেউ দেখা
করতে গেল না , এমনকি একটা
উকিল পর্যন্ত সংগঠন
থেকে পাঠানো গেল না ।
পরিস্থিতির বাধ্যতা
হয়তো । কিন্তু যতীন
মুখার্জির আক্ষেপ থেকে
যায় । তাঁর হাতে তৈরি
ছেলেটা । মুখ কিছুতেই
খুলবে না তিনি জানেন ।
কোন সাহায্য না পেলেও
শহীদ হবার আনন্দেই ও
তৃপ্ত থাকবে , কিন্তু
মনটা এলোমেলো হয়ে যায়
তাঁর । এদিকে অন্য
একজনের সাক্ষ্যে তিনি
গ্রেফতার হলেন । তখন
সরকারী চাকুরে তিনি ।
প্রমাণ ছিল না কোন
ব্রিটিশ সরকারের কাছে ।
হঠাৎই সামশুল আলম হত্যা
মামলার মূল
পরিকল্পনাকার হিসাবে
তাঁকে কেসে জড়িয়ে দেয়
পুলিশ । প্যারেড হয়
সনাক্তকরণের , সেখানে
তাঁকে সনাক্ত করে স্বয়ং
বীরেন , তাঁর প্রিয়
শিষ্য ।
সেইদিন বীরেন চিৎকার
করে তাঁর দিকে দেখিয়ে
বলে , এই তো ইনি যতীনদা ,
আমার গুরু , এনার
নির্দেশেই সামশুল
আলমকে মেরেছি আমি ।
তারপর কাঁদতে কাঁদতে
জিজ্ঞেস করে , কেন অমন
লিখলে যতীনদা আমার নামে
? আমায় ট্রেইটর কেন বললে
? শহীদ কেন হব না আমি ?
উদ্বিগ্ন নেতা পুলিশের
সামনেই প্রশ্ন করেন , কে
বলেছে তোকে ট্রেইটর ?
আমার বীরেন শহীদ হতে
যাচ্ছে , সে ট্রেইটর হবে
কেন ? অভিমানী বীরেন
কোনভাবে উচ্চারণ করে ,
তাহলে দলের মুখপত্রে
তুমি আমার জন্য উকিল
কেন দাওনি জানিয়ে , আমায়
বিশ্বাসঘাতক লিখলে কেন
? বাঘাযতীন শান্ত চোখে
পাশে দাঁড়ানো
তদন্তকারী অফিসারের
মুখের দিকে তাকান ।
ক্রূর হাসি তাঁর ঠোঁটের
কোণায় । যতীন বীরেনের
মাথায় হাত রেখে বলেন ,
পুলিশের প্রেসে জাল
পত্রিকা ছাপিয়েছে ওরা ।
ধরতে পারলি না তুই ? আমি
কিভাবে তোকে---
বীরেনের সব গোলমাল হয়ে
যায় । ভুল ভুল , সে
পুলিশের ফাঁদে পা
দিয়েছে । এখন কি হবে
যতীন্দ্রনাথের ! মাথা
আছড়াতে থাকে সে যতীনের
পায়ের কাছে । নেতা তাঁর
মাথা যত্ন করে কাছে
টেনে নেন । ফাঁসি হয়ে
যায় বীরেনের ।
বাঘাযতীনের হাতে লেগে
থাকে শিষ্যের অনুতাপের
রক্ত । না বীরেন
বিশ্বাসঘাতক ছিল না ।
---------
কথা এবার দ্বিতীয়
চরিত্র নিয়ে । আজ্ঞে না
দ্বিতীয় ঘটনার সাথে
প্রথমের কোন সম্পর্ক
নেই । এর প্রেক্ষাপট
অনেক বড় ; রঙ্গমঞ্চ
এখানে অন্তত তিন দশকের
ভারতীয় রাজনীতি । এখানে
উনিশ শতকের বিশ্ব
ইতিহাসের এক অন্যতম
ব্যক্তিত্বের আলোচনা ।
পলিটিকাল ক্লাসের
বিচারে তাঁর কোন তুলনা
হয় না বীরেনের সাথে ।
রাজনৈতিক দর্শনের
বিচারে তো সম্পূর্ণ দুই
বিপরীত মেরুর বাসিন্দা
। একজন নেতা , অন্যজন
কর্মী । কিন্তু নেতার
ভুল হয় না এমন তো নয় ।
নেতার ভুল হয়তো বা
কর্মীর অনেক অনেক ভুলের
উৎস । প্রজন্মের পর
প্রজন্ম ধরে সাধারণ
মানুষকে গুনতে হয়
নেতাদের ভুলের মাশুল ।
মোহনদাস গান্ধী ভারতীয়
রাজনীতির অন্যতম
বিতর্কিত চরিত্র । কেউ
তাঁকে ভগবান বানিয়েছেন
, কেউ বা শয়তান হিসাবে
দেখেছেন তাঁকে । অবশ্য
১৯১৫ এর পর থেকে ভারতীয়
রাজনীতিতে তাঁকে
অস্বীকার করার সুযোগ
প্রায় নেই । প্রতিটা
ঘটনায় তিনি একটা বড়
ফ্যাক্টর । কৃষক এবং
শ্রমিক আন্দোলনে তাঁর
অনুপ্রবেশ ও ভূমিকা ,
জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর
দর্শন ও প্রায়োগিক
কার্যাবলী সবটাই প্রবল
বিতর্কের সৃষ্টি করেছে
। যে বিতর্ক আজও চলছে
এবং আজকের বাস্তবেও যে
বিতর্ককে অস্বীকার করা
সম্ভব নয় । তাঁর সমাজ
ভাবনা , ধর্ম ভাবনা ,
দলিত প্রসঙ্গে মতামত
এবং দর্শন সমস্তটাই ।
ঐতিহাসিক ভাবে দেখতে
গেলে অসহযোগ আন্দোলনে
চৌরিচৌরার ঘটনা , ভগত
সিং এর ফাঁসির ক্ষেত্রে
, যতীন দাসের শহীদ হবার
পর মন্তব্যে তাঁর
ভূমিকা এখনও বহুলাংশে
সমালোচিত হয় । আর হ্যাঁ
সুভাস চন্দ্র বসুর সাথে
তাঁর বিতর্ক এবং
দেশভাগের ক্ষেত্রেও
তাঁর ভূমিকা নিয়ে
অব্যাহত বিতর্ক ।
এই বিতর্কে প্রবেশ
করাটা আমার উদ্দেশ্য নয়
। এখানে একটা বিশেষ ভুল
নিয়ে আলোচনা করতে এসেছি
তাই প্রসঙ্গে ঢুকি ।
সাল ১৯৩৯ , ৩০শে
জানুয়ারী । কংগ্রেসের
অধিবেশনে সভাপতি
নির্বাচনের ফলাফল
প্রকাশিত হল । কংগ্রেস
সমেত দেশের জাতীয়
আন্দোলন তখন দুই মেরুতে
দ্বিধাবিভক্ত । একদিকে
গান্ধীজীর নেতৃত্বে
কংগ্রেসের আবেদন
নিবেদন কামী নেতৃত্ব ,
অন্যদিকে সুভাস বসুর
নেতৃত্বে বামপন্থী অংশ
, যারা আপোষহীন
সংগ্রামের পক্ষে ছিলেন
। গান্ধীজীর প্রবল
বিরোধিতা সত্ত্বেও
সুভাষ জয়ী হলেন । ১৫৭৫
টা ভোট পেলেন সুভাষ ,
অন্যদিকে
প্রতিদ্বন্দ্বী
পট্টভি সীতারামাইয়া
পেলেন ১৩৪৬ টি ভোট ।
দ্বিতীয় বারের জন্য
কংগ্রেস সভাপতি
নিরবাচিত হলেন তিনি ।
ভারতীয় জাতীয় রাজনীতির
একটা অন্যতম
গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে
এই জয় একটা অন্য মাত্রা
নিয়ে আসতে পারত হয়তো ,
কিন্তু পরের দিনের
সংবাদপত্রে দেশের
মানুষ গান্ধীজীর
বিবৃতি পেলেন ।
“ পট্টভি সীতারামাইয়ার
পরাজয় আমারই পরাজয় ।
---হাজার হোক , সুভাষবাবু
দেশের শত্রু নন! ---তাঁর
জয়লাভে আমি আনন্দিত ।”
অতঃপর যেমন প্রতি
ক্ষেত্রে হয় তেমনই , নন
কোয়াপারেশন । সুভাস
চন্দ্র বাধ্য হলেন
পদত্যাগ করতে । কেন ?
ওয়ার্কিং কমিটি
গান্ধীজীর সাহায্য
ছাড়া বানানো সম্ভব নয় ।
কারণ , “ফ্যাসিস্টদের
মধ্যে মুসোলিনীর ,
নাৎসীদের মধ্যে
হিটলারের এবং
কমিউনিস্টদের মধ্যে
স্ট্যালিনের যে স্থান ,
কংগ্রেস সেবীদের মধ্যে
মহাত্মা গান্ধীরও সেই
স্থান । --- কংগ্রেসের
লিখিত গঠনতন্ত্রে
তাঁহার জন্য কোন স্থান
নির্দিষ্ট নাই ইহা সত্য
, কিন্তু ইহা কেহ
অস্বীকার করিতে
পারিবেন না ,
রাষ্ট্রপতি পদে
মহাত্মা গান্ধীর
মনোনীত ব্যক্তিকে
নির্বাচন করা এবং
রাষ্ট্রপতির পক্ষে
ওয়ার্কিং কমিটির
অধিকাংশ সদস্য পদে
মহাত্মা গান্ধীর
মনোনীত ব্যক্তিগণকে
মনোনীত করা একটা প্রথায়
দাঁড়াইয়াছে ।” বক্তা
ত্রিপুরী কংগ্রেসের
অভ্যর্থনা কমিটির
সভাপতি শেঠ গোবিন্দ দাস
( আনন্দবাজার পত্রিকা :
১১ই মার্চ : ১৯৩৯ ) ।
এরপর ফরওয়ার্ড ব্লক গঠন
, দেশ ছাড়া , রাশিয়া হয়ে
জার্মানি হয়ে জাপান ,
আজাদ হিন্দ সরকার গঠন
এবং ফৌজের দায়িত্ব নিয়ে
ভারত আক্রমণ সুভাষের ।
অন্যদিকে দেশের মধ্যে
একের পর এক
আলোড়ন । ভারত ছাড়ো
আন্দোলন , ভয়ংকরতম
দুর্ভিক্ষ , আর দেশের
ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে
ধর্মের রাজনীতির কদর্য
চেহারা । তেভাগা ,
তেলেঙ্গানা , নৌ
বিদ্রোহ এবং শেষতঃ
ভাতৃঘাতী দাঙ্গার হাত
ধরে দেশভাগ । একটা ঝড়ো
দশক বয়ে গেল গোটা
বিশ্বের উপর দিয়ে । সব
কিছু এলোমেলো হয়ে গেল
যেন । সুভাষ হারিয়ে
গেলেন সেই ঝড়ে রাজনীতির
আঙ্গিনা থেকে । আর
গান্ধীজী ?? একটা গল্প
বলি শুনুন । আমার মুখে
নয় । লেখক নারায়ণ
সান্যাল । এক.দুই..তিন…
বইটির দেজ পাবলিশিং
থেকে ১৯৯৭এ প্রকাশিত
দ্বিতীয় সংস্করণ থেকে
হুবহু তুলে দিচ্ছি ।
উৎসাহী পাঠক বইটি
সংগ্রহ করলে ৩৮-৪২
পাতায় পেয়ে যাবেন ।
“ এই যখন দেশের হাল তখন
আমি যেটুকু তথ্য জেনেছি
তা লিপিবদ্ধ করি ।
এতদিন করিনি । বিবেকের
নির্দেশে । সার্ভিস
কন্ডাক্ট রুলস বলে ‘Barring
judicial inquiries and those ordered by the Govt. or
Parliament , no person shall give evidence , except with
the prior sanction of the Government .’ আমি
অবশ্য অবসর প্রাপ্ত
পেনশনভোগী ; তবু বলি , না ,
আমি কোনও ‘এভিডেন্স’
দিচ্ছি না । কেন্দ্রীয়
উপমন্ত্রীর কাছে যা
শুনেছি তাই বিবৃত করছি
। এতদিন প্রকাশ করিনি
এই কারণে যে , যাঁর গৃহে
আমন্ত্রিত হয়ে
কাহিনীটা 1962 সালে
শুনেছিলাম , তিনি ছিলেন
তদানীন্তন ভারতের
‘সিনিয়ারমোস্ট’
আই.সি.এস. অফিসার । তিনি
আমাদের এগারোজনকেই
মৌখিকভাবে বলেছিলেন :
তথ্যটা প্রকাশ না করতে
।
তাহলে আজ আমি লিপিবদ্ধ
করছি কোন যুক্তিতে ?
প্রথা বলে , ত্রিশ বৎসর
অতিক্রান্ত হলে যেকোনো
ঐতিহাসিক দলিল আর
সরকারের গোপন তথ্য নয় ,
ইতিহাসের অধিকারে । যে
যুক্তিতে মৌলানা
আজাদের আত্মজীবনীর
একটি বিশেষ অনুচ্ছেদ
ত্রিশ বছর পরে প্রকাশিত
হল । যে যুক্তিতে
গান্ধিহত্যা মামলায়
প্রতিবাদী নাথুরাম
গডসের জবানবন্দী ত্রিশ
বছর পরে প্রকাশ করা হল ।
কৈফিয়ত দিয়েছি । এবার
ঘটনাটা বিবৃত করি ।
আমি তখন দণ্ডকারণ্যে
দেপুটেশনে কাজ করি ।
উড়িষ্যার কোরাপুটে ।
এক্সিকিউটিভ
এঞ্জিনিয়ার । তপশীল
উপজাতির কমিশনার তথা
পূর্ত , গৃহনির্মাণ ও
সরবরাহ দপ্তরের
উপমন্ত্রী অনিলকুমার
চন্দ দণ্ডকারণ্য
পরিদর্শনে এসেছেন ।
রাত্রে
চেয়ারম্যান-সাহেব তাঁর
বাড়িতে একটা নৈশভোজের
আয়োজন করলেন । আমরা
এগারো জন নিমন্ত্রিত
ছিলাম – নয়জন বাঙালী ,
দু’জন অবাঙালী , চীফ
অ্যাডমিনিস্ট্রেটার
মিস্টার অ্যান্ড মিসেস
জনসন । দিনের বেলা
অফিসিয়াল ওয়ার্কিং
লাঞ্চ হয়েছে ; এটা
চেয়ারম্যান সাহেবের
ব্যক্তিগত নিমন্ত্রণ ।
চেয়ারম্যান তদানীন্তন
ভারতের প্রবীণতম আই . সি
. এস. : স্বনামধন্য
পদ্মবিভূষণ সুকুমার
সেন ।
কাহিনীটি বিবৃত
করেছিলেন অনিলকুমার
চন্দ : ‘আফটার-ডিনার’
খোশগল্পে ।
সুধীজনমাত্রেই জানেন
অনিল চন্দ ছিলেন তাঁর
আমলে ভারতবিখ্যাত ।
লন্ডন স্কুল অব
ইকনমিক্সের স্নাতক ।
বত্রিশ সালে তিনি
শান্তিনিকেতনে
শিক্ষাভবনে যোগ দেন ।
পরের বছর থেকে
রবীন্দ্রনাথের
প্রয়াণকাল পর্যন্ত
তিনি ছিলেন গুরুদেবের
একান্ত সচিব ।
তিপ্পান্ন সালে
রাষ্ট্রপুঞ্জের
সাধারণ পরিষদের অষ্টম
অধিবেশনে ভারতের
প্রতিনিধিত্ব করেন ।
এত কথা বলছি বোঝাতে যে ,
যাঁর কাছে কাহিনী
শুনেছিলাম তাঁর কথার
কতটা গুরুত্ব ।
শ্রদ্ধেয় অনিল চন্দ
প্রায় পনের বছর আগেকার
একটি বিচিত্র
অভিজ্ঞতার কথা আমাদের
শোনালেন সে রাত্রে ।
ভারত তখন পরাধীন ।
জিন্না-ঘোষিত ‘
ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে ’ 16
আগস্ট 1946 অতিক্রান্ত ।
সমস্ত ভারত জ্বলছে
সাম্প্রদায়িক
বিদ্বেষবহ্নিতে –
বিশেষ করে পঞ্জাব ,
কাশ্মীর , বাংলা , কিছুটা
উত্তরপ্রদেশ ও বিহার ।
দেশের নেতারা দিশেহারা
! গান্ধীজী তখন
সেবাগ্রামে । কী একটা
কাজে মহাত্মাজীর সঙ্গে
পরামর্শ করতে অনিল চন্দ
এসেছেন শান্তিনিকেতন
থেকে । আছেন আশ্রমের
অতিথিশালায় ।
মহাত্মাজীর সঙ্গে কথা
বলছেন , হঠাৎ টেলিফোনটা
বেজে উঠল । যন্ত্রটা
ছিল দুজনের মাঝামাঝি ।
কিন্তু মহাত্মাজী
ছিলেন
শায়িত । তাই অনিল চন্দ
রিসিভার তুলে শুনলেন ।
অবাক হয়ে গেলেন । বললেন ,
বাপুজি , পন্ডিতজি কথা
বলছেন , ধরুন ।
পণ্ডিতজী ? জবাহর ?
দেহলীসে কেয়া ?
হাত বাড়িয়ে যন্ত্রটা
নিয়ে শুনলেন । তারপর
অনেকক্ষণ নীরবে শুনে যা
বললেন তা রীতিমত
চাঞ্চল্যকর সংবাদ ।
হ্যাঁ , জাওয়াহরলাল
নেহেরুই ও-প্রান্তে কথা
বলছিলেন ; কিন্তু
দিল্লী থেকে ট্রাংক-কলে
নয় । আহমেদাবাদের
স্টেশানের
সুপারিন্টেনডেন্টের
ঘর থেকে । ওঁরা তিনজন
এইমাত্র দিল্লী থেকে
আহমেদাবাদ এক্সপ্রেসে
এখানে এসেছেন ।
অনিল চন্দ শুধু বললেন ,
ঔর দোনো কৌন ? পণ্ডিতজী
কে অলাবা ?
-আজাদ ঔর প্যাটেল । তুম
যাতে হো কাঁহা ? ব্যয়ঠে
রহো !
অনিল চন্দ এই পর্যায়ে
আমাদের বলেছিলেন ,
বাপুজি তাঁর ষষ্ঠ
ইন্দ্রিয় দিয়ে – অথবা
কোন ঐশ্বরিক ক্ষমতায় –
হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন
কেন ঐ তিনজন সর্বভারতীয়
নেতা অতর্কিতে
সেবাগ্রামে উপস্থিত
হয়েছেন । আরও বলেছিলেন ,
‘ জানি না , বাপুজি এ
কথাও ভেবেছিলেন কিনা যে
– ওঁরা তিনজন , উনি একা !
তাই কি আমাকে উঠে যেতে
বারণ করলেন ? ’
সমস্ত কথোকপথন আমার
স্মরণে নেই । এমন একটা
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে
স্মৃতির মণিকোঠা হাতড়ে
আন্দাজে কিছু লেখা ঠিক
হবে না । কথোপকথনের
দুতিনটি
পংক্তি শুধু মনে আছে ।
কারণ তা ভোলা যায় না ।
একবার শুনে আপনারাও
ভুলতে পারবেন না বাকি
জীবনে । যেটুকু মনে আছে
বিবৃত করি -
জওয়াহরলালই আলোচনা
শুরু করেন । যুক্তিতর্ক
দিয়ে তিনি মহাত্মাজীকে
বোঝাতে চাইছিলেন যে ,
মাউন্টব্যাটেন-প্রস্ত
বিত ভারত বিভাগ
স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া
দেশের সামনে আর কোনও
বিকল্প পথ খোলা নেই ।
প্রতিদিন অন্তত
একহাজার নরনারী নিহত
হচ্ছে সমগ্র ভারতে ।
মহাত্মাজী জানতে
চাইলেন এ বিষয়ে আজাদ ও
প্যাটেল কী বলেন ।
দুজনেই তাঁদের মতামত
দিলেন । ওঁদের মতে
পরিস্থিতি যা
দাঁড়িয়েছে তাতে
‘ভারত-বিভাগ’ অনিবার্য
। যতো দেরী হবে ততই
মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধি
পাবে । ওঁরা তিনজনে
একমত হয়েই বাবুজীর
আশীর্বাদ ভিক্ষা করতে
এসেছেন ।
মহাত্মাজী বেঁকে বসলেন
। তিনি রাজি নন ।
গান্ধীজীর
প্রতিক্রিয়া
সংবাদপত্রে প্রকাশিত
হয়েছিল । আমার মত
পক্ককেশ প্রবীণদের
স্মরণ হবে মহাত্মাজীর
উক্তি : ‘ ভারত যদি
বিভক্ত হয় , তবে তা হবে
আমার মৃতদেহের উপর । ’
এটা ইতিহাসস্বীকৃত ।
নতুন তথ্য যা অনিল
কুমার পরিবেশন
করেছিলেন তা এই –
গান্ধীজী বলেছিলেন ,
এবং লিংকনকেও তাঁর
ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরা এবং
তাঁর জেনারেলরা একই কথা
একদিন বলেছিল :
আমেরিকাকে দু-টুকরো করে
ভাতৃবিরোধের অবসান
ঘটাতে । লিংকন স্বীকৃত
হননি – তিনি প্রাণ
দিয়েছিলেন , কিন্তু
আমেরিকাকে
দু-টুকরো হতে দেননি !
আমরাই বা পারবো না কেন ?
কংগ্রেসের ছোট ছোট
সেবাদল তৈরি করে চল ,
আমরা এক-একজন এক-একদিকে
রওনা হই ।
ওঁরা তিনজন স্বীকৃত হতে
পারেন না ।
আবার সবিনয়ে স্বীকার
করি : কে কী বলেছিলেন তা
পরপর সাজিয়ে নিয়ে বলতে
পারবো না । তার মধ্যে
আমার কল্পনার ভ্যাজাল
অনিবার্যভাবে
অনুপ্রবেশ করবে । তবে
এটুকু মনে আছে , শেষ
পর্যন্ত পণ্ডিতজী নাকি
বলেন , বাপুজী !
পার্টিশান ইজ নাউ এ
সেটল্ড ফ্যাক্ট ! আপনি
যদি আমাদের সঙ্গে একমত
না হতে পারেন তাহলে
নিরপেক্ষ থাকুন ।
গান্ধীজী মানতে রাজি
হননি । পণ্ডিতজীর কণ্ঠে
অর্ধশতাব্দী
পূর্বেকার লর্ড
কার্জনের কন্ঠস্বর
শুনতে পেয়েছিলেন কিনা
তাও বলেননি । বলেছিলেন ,
না , আমি তো নিরপেক্ষ নই !
আমি ভারতবিভাগের
বিপক্ষে ! নিরপেক্ষ
থাকতে যাবো কেন ?
প্যাটেল নাকি এই সময়ে
বলেন , সে-কথা তো আপনি
আমাদের ইতিপূর্বেও
জানিয়েছেন , বাপুজী !
আমাদের তিনজনের বিনীত
অনুরোধ – অ - কথা
প্রেসকে জানাবেন না !
গান্ধীজী এ-কথায় নাকি
বিরক্তি প্রকাশ করে
বলেন , প্রেসকে আমি কখন
কি বলবো তার নির্দেশ
আমি কি তোমার কাছে নিতে
যাব , সর্দারজী ?
এই সময় – অনিল চন্দের
স্মৃতিচারণ অনুসারে –
সর্দার প্যাটেল নাকি
একটা বেফাঁস উক্তি
করে বসেন : তাহলে তো
আমরা দেখতে বাধ্য হব ,
যাতে আপনার স্টেটমেন্ট
সংবাদপত্রে না পৌঁছায় ।
মহাত্মাজী এতক্ষণ
অর্ধশয়ান অবস্থায়
আলাপচারী করছিলেন ।
একথায় হঠাৎ সোজা হয়ে
উঠে বসলেন । প্যাটেলের
দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে
তাকিয়ে সবিস্ময়ে বললেন
: কেয়া কহা ? …. ও । ইয়ে বাত
হ্যায়! আভি সমঝ গয়া !
মুষ্টিবদ্ধ
বলিরেখাঙ্কিত শীর্ণ
দুটি হাত প্যাটেলের
দিকে বাড়িয়ে ধরে বলতে
থাকেন , মুঝে অ্যারেস্ট
করনা চাহতে হো ? তো করো !
লায়ে হো হ্যান্ডকাফ ?
আজাদ ও জওয়াহরলাল দুজনে
একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়েন :
ছি ! ছি ! ছি ! এ কী বলছেন ,
বাপুজী ! সর্দার ও কথা
বলতে চায়নি মোটেই !
এতক্ষণ যা লিখেছি –
কখনও ‘ ডাইরেক্ট
ন্যারেশনে ’ কখনো ‘
ইনডাইরেক্ট ’ – তার
অনেকটাই
স্মৃতিনির্ভর , কিছুটা
আন্দাজে , হয় তো বা
কিছুটা কল্পনানির্ভর ।
কিন্তু এবার যে কয়টি
পংক্তি লিপিবদ্ধ করছি
তা তিন দশকের উপর আমার
স্মৃতিপটের
মণিমঞ্জুষায় সযত্নে
সঞ্চিত হয়ে আছে – ছেনি ,
হাতুড়ি দিয়ে খোদাই -করা
শিলালিপির মত !
মহাত্মাজী সখেদে বলে
ওঠেন , হাঁ ! অব তুম তিনো
ইয়ে কহ সকতে হো , কিঁউ কি
মেরা বেটা তো ইঁহা নেহী
হ্যয় না ?
জওয়াহরলাল সবিস্ময়ে
প্রশ্ন করেন , কিসকি বাত
কোর রহেঁ হ্যঁয় , বাপু ?
-“ ওয়হ বেটা ! যো হমপর
অভিমান করকে ঘর ছোড়কে
চলা গয়া থা ! অব সুনা
হ্যয় কি ওয়হ
বার্তানিয়াকা সাথ লড়াই
করতে হুয়ে শহীদ বন চুকা
। অগর ওয়হ রহতা , তো ম্যয়
ভি দেখ লেতা , ক্যায়সে
তুম তিনো ……. ”
নারায়ণ সান্যালের
দেওয়া এই তথ্যটা চমকে
দেওয়ার মত সন্দেহ নেই ।
দেশভাগ হবার প্রাক
মুহূর্তের রক্তাক্ত
রাত আর মৃত্যু মিছিল
দেখে গান্ধীজী ফিরে
তাকিয়েছিলেন কি অতীতের
দিকে ? সশস্ত্র
বিপ্লবীরা অথবা
সন্ত্রাসবাদীরা যে
নামেই আজ ডাকা হোক না
কেন , তাঁরা তখন
রাজনীতির কমান্ডে
কোথায় ? তাঁর
নিয়মতান্ত্রিক অহিংস
নীতিতেই আসন্ন
স্বাধীনতা , অথচ , কিন্তু
, এবং , অতএব সবটা মিলিয়ে
একটা জিজ্ঞাসা চিহ্ন ,
একটা অতৃপ্তি যেন ঘিরে
ধরেছিল তাকে । সুভাষকে
বিরোধিতা করে যাদের
কাঁধে ভর দিয়েছিলেন
সেখানেই কি ভুলের
সূত্রপাত বলে মনে
হয়েছিল তাঁর ? নাকি আরও
অনেক গভীরে খুঁজছিলেন
দেশের এমন এক
পরিস্থিতিতে পৌঁছানোর
কারণ , কিংবা ভুলের
উৎসমুখ ! ভুলের উপলব্ধি
নাকি পাওয়ার
পলিটিক্স-এর লড়াইতে
হেরে যাওয়ার আক্ষেপ ?
বিচার পাঠক করুন ।
দেখুন তো এই ভুলটা ঠিক
কোন গোত্রে পরে ?
নির্বাক কাঁটাতার আর
বর্তমান সময়ের
সাম্প্রদায়িক
রাজনীতির চালবাজি
প্রমাণ করে মাঝরাতের
অন্ধকারে স্বাধীনতা
পাবার জন্য যে রাজনৈতিক
বীজ বপন হয়েছিল সেটা আজ
কত বড় আকার ধারণ করেছে ।
ক্ষমতা হস্তান্তরের
আবছা আলোয় আসুন খুঁজে
দেখি সন্ত্রাসবাদী (
পাঠ্য বই এর ভাষায় )
বীরেন ফাঁসির দড়ি পড়বার
সময় এই স্বাধীনতাই
চেয়েছিলেন কিনা ? সময় না
থাকলে চলুন স্রোতে গা
ভাসাই আরও অনেক অনেক
ভুলের জন্য , যে সব
ট্র্যাডিশন আমরা
সজ্ঞানে সমানে বহন করে
চলেছি ।