স্ক্রীন-জুড়ে চরকা
আঁকা তেরঙা পতাকা।
বুট-পরা পা দিয়ে পতাকা
মাড়িয়ে হেঁটে এসে,
অসহযোগ আন্দোলনে
সন্তানকে বাঁচাতে এসে
ধরা দেওয়া স্বদেশী
নেতা অজয়কে
ব্রিটিশ-অনুরক্ত মেজর
ত্রিবেদী চিবিয়ে
চিবিয়ে বলছে,
“দেখেছ? যাও হেঁটে এস।
Walk on it. হেঁটে এস, যাও!”
গলা ফাটিয়ে চীৎকার
নয়। তিরিশ কি চল্লিশের
দশকের গোড়ায়
অভিনেতাদের মত হাত মুখ
নাড়িয়ে, অতিরঞ্জিত
অভিনয় নয়। অনেকটা
হলিউডি স্টাইল। ঠাণ্ডা
মাথার খলনায়ক। যে সব
সময় শেষ হাসিটা হাসে।
হয়তো মাত্র এক পর্দা
উঠল গলা। কিন্তু মেজরের
কন্ঠস্বরের অভিঘাত
ক্রমশ ইস্পাত-কঠিন।
অনড় অজয়। নির্বাক।
কঠিন দৃষ্টিতে সেটা
দেখে দাঁতে দাঁত চিপে
মেজর বলছে,
“You won't! Alright! Then take it. Take it....”
মারের পর মার। বীভৎস
মার। তারপর, ঘাড় ধরে
মেজর নেতাকে নিয়ে গেল
পতাকার কাছে। ব্রিটিশ
অনুরাগের সঙ্গে
স্বদেশী
আন্দোলনকারীদের প্রতি
তীব্র ঘৃণা মিশিয়ে
স্টিফ্ আপার লিপে মেজর
বলল,
"Spit on it. I say, spit!”
এই ছবির নাম ’৪২’
।মুক্তি পেয়েছিল
আগস্ট ১৯৫১ তে। উনিশশো
বিয়াল্লিশের ভারত
ছাড়ো আন্দোলনের
পটভূমিকায় এই ছবির
পরিচালক ছিলেন হেমেন
গুপ্ত, যিনি নিজে ছিলেন
জেল খাটা স্বাধীনতা
সংগ্রামী। আর ক্রূর
অফিসার মেজর ত্রিবেদীর
চরিত্ররূপায়ণ বিকাশ
রায়ের। সিনেমার পর্দায়
তাঁর ক্রূরতা দেখে
দর্শক ফুঁসে উঠতো, জুতো
ছুঁড়তো বলে শোনা যায়।
একটু পিছন ফিরে দেখা
যাক।
১৯৪৭ সালের ৭ই
ফেব্রুয়ারী। কলকাতার
বীনা এবং পূর্ণ
প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি
পেলো হেমেন গুপ্তের
পরিচালিত বাংলা
চলচ্চিত্র
‘অভিযাত্রী’।
রাধামোহন ভট্টাচার্য,
নির্মলেন্দু লাহিড়ি,
কমল মিত্র, শম্ভু মিত্র,
বিনতা রায় প্রভৃতিদের
সঙ্গে বাংলার দর্শক
প্রথম পরিচয় পেলো
অভিনেতা বিকাশ রায়ের।
লম্বা। ছিপছিপে। ঋজু
কাঠামো। ভাঙা মুখ, শক্ত
চোয়াল। চওড়া কপাল,
তীক্ষ্ণ নাশা। আর গভীর,
অন্তর্ভেদী দৃষ্টি যা
ছিলো অপ্রতিরোধ্য সেই
সঙ্গে এক আশ্চর্য
দুর্লভ কণ্ঠস্বরের
জাদুময়তা। ম্যাটিনি
আইডল ছিলেন না মোটেই
বরং তার মত
চরিত্রাভিনেতার পাশে
বহু ম্যাটিনি আইডল
ম্লান হয়ে গেছে।
সময়টা ১৯৪৬। অল ইন্ডিয়া
রেডিওতে সামান্য
প্রেজেন্টার-অ্যানাউন
সারের চাকরি করছেন
বিকাশ রায়। হঠাৎ-ই
সু্যোগ এলো সিনেমায়
অভিনয় করার। সেই সময়
চিত্রনাট্যকার
জ্যোতির্ময় রায়, ততদিনে
বিমল রায়ের ‘উদয়ের
পথে’র চিত্রনাট্যের
জন্য বিখ্যাত হয়ে
গেছেন, বছর তিরিশের
যুবক বিকাশ রায়কে নিয়ে
গেলেন পরিচালক হেমেন
গুপ্তের কাছে। যুবক
বিকাশের মাথায় তখন পাক
খাচ্ছে বীরেন্দ্র
কৃষ্ণ ভদ্রের কথা।
শুনেছিলেন কিন্তু আমল
দেননি সেই সময়। একদিন
অল ইন্ডিয়া রেডিও’র
করিডোরে দাঁড়িয়ে বীরেন
ভদ্র মশাই
বলেছিলেন,’বিকাশ তুমি
বরং ফিল্মে যোগ দাও।
তোমার হবে’। কথাগুলো
মাথায় খেলে যাবার
মুহুর্তে শুনতে পেলেন
জ্যোতির্ময় রায় হেমেন
গুপ্তকে বলছে,’হেমেন,
এর নাম বিকাশ। বিকাশ
রায়। অল ইন্ডিয়া
রেডিওতে কাজ করছে। তুমি
একবার দেখে নাও...’।
কলকাতার ভবানীপুরে ছিল
বিকাশ রায়ের জন্ম ও বড়
হওয়া। ভবানিপুরের
মিত্র ইনস্টিটিউট থেকে
প্রেসিডেন্সী কলেজ
পর্যন্ত চলার মাঝে ছিল
বহুমুখী প্রতিভার
স্ফুরণ। তার মধ্যে
অভিনয়ের প্রতি তাঁর
ঝোঁক যা ছিল সেই
ছেলেবেলা থেকে যদিও
অনেকটা ঘুমিয়ে থাকা
অ্যালবামের মতো –
“ছেলেবেলায় মাচা বেঁধে
থিয়েটার থিয়েটার খেলা,
আমাদের সময়ে খুব চালু
ছিলো। এ খেলা আমিও
খেলেছিলাম আর সেই সব
পালায় আমিই ছিলাম দৃশ্য
সংস্থাপক, আমিওই মোশন
মাস্টার-পরিচালক, আমিই
মূল অভিনেতা। ছাত্র
অবস্থায় কলেজের ফাংশনে
আর ইউনিভার্সিটি
ইনস্টিটিউটের সভ্য
হিসেবেও অভিনয়
করেছিলাম”। এরপর
সহপাঠী আই এ এস অশোক
মিত্র’র কথাতে অবশ্য
আরো খানিকটা চেনা গেলো
– “গল্পগুজব, হাসি
ঠাট্টা, পত্রিকা
প্রকাশ, প্রেসিডেন্সীর
কলেজে লেখা, কলেজে
থাকতেই বৈকুন্ঠের উইল
নাটকে অভিনয় করা – সব
মিলিয়ে হি ওয়াজ জেম”।
আর সেই রত্নকে যেমন
চিনতে ভুল করেন নি
শ্রদ্ধেয় বীরেন্দ্র
কৃষ্ণ ভদ্র, তেমনি ভুল
করেননি চিত্রনাট্যকার
জ্যোতির্ময় রায়,
পরিচালক হেমেন গুপ্ত,
অভিনেতা – পরিচালক
প্রমথেশ চন্দ্র বড়ুয়া,
দেবকী কুমার বসু
প্রমুখরা।
চলচ্চিত্রে পেশাদার
অভিনেতা হবেন এমন
কল্পনা তিনি কখনো করেন
নি। প্রেসিডেন্সী
কলেজে পড়া শেষ হবার পর
আইন নিয়ে স্নাতক।
প্রথমে কোন এক
ব্যারিস্টারের সহকারী
হয়ে ভবিষ্যতে দক্ষ্
আইনজীবী হবার বিফল
প্রচেষ্টা। তারপর
মোক্তারি ছেড়ে আশি
টাকার মাস মাইনে নিয়ে
অল ইন্ডিয়া রেডিওতে
যোগদান। মাঝখানে
রেডিও’র চাকরী ছেড়ে ডি
জে কীমারের বিজ্ঞাপন
সংস্থাতেও বেশ
কয়েকদিনের জন্য ঢুকে
পড়েছিলেন, পরে আবার
রেডিওতে ফিরে আসা। আর
সেখানে কাজ করতে করতেই
চলচ্চিত্র অভিনয়ে
পদার্পন। বাংলা
সিনেমা্র এক
মাহেন্দ্রক্ষণে
ভবিতব্য তাঁকে টেনে আনল
স্পটলাইটের
তলায়।এরপর চার দশক ধরে
বাংলাকে তিনি দিয়ে
যাবে্ন অসামান্য কিছু
ছবি ও কিছু অবিস্মরণীয়
মুহূর্ত। মোশন পিকচারে
প্রথম অভিনয় করার
অনুভূতি রোমন্থনের
মুহুর্তে বিকাশ রায়ের
কথা যেন ঘুমিয়ে থাকা
অ্যালবামের কথাই মনে
করিয়ে দেয়, “আমার সেই Gene,
অস্থি, মজ্জা, মাংস,
হৃদয়ের পরতে পরতে
পূর্বপুরুষ থেকে
ইনজেক্ট করা যে অভিনয়
আকাঙ্ক্ষা, যে এতদিন
ঘুমিয়ে ছিল আমার
মধ্যে, সেই Gene এতদিন বাদে
তার সাগরসঙ্গমে গিয়ে
ভিড়লো। আমি অভিনেতা
হলাম’।
অভিযাত্রী’তে কাজ করার
বহুপূর্বে প্রমথেশ
বড়ুয়া অফার দিলেন বিকাশ
রায়কে দেবদাস ছবিতে
পার্বতীর সৎ ছেলে
মহিমের ভূমিকায়।
বিকাশবাবু রাজী হন নি
তখন। তার প্রায় পনের
বছর পর আবার যখন
মুখোমুখি বড়ুয়া মশাই
তখন অস্তগামী। বললেন –
‘বিকাশ সেই ফিল্মে
এলে, তবু আমার ডাকে এলে
না’।
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ
আন্দোলনকে কেন্দ্র করে
গড়া হেমেন গুপ্ত
পরিচালিত ‘ভুলি নাই’
(১৯৪৮) ছিল বিকাশবাবুর
দ্বিতীয় ছবি। এই ছবিতে
বিশ্বাসঘাতক
মহানন্দের চরিত্রে
অভিনয় করেছিলেন
বিকাশবাবু। দাপিয়ে
অভিনয় করলেন, ‘ভুলি নাই
আমাকে যথেষ্ট
প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। ...
সত্যি কথা বলতে কী,
‘ভুলি নাই’-এর পর আমাকে
পিছন ফিরে তাকাতে হয়
নি। শিল্পে স্বীকৃতি
পেলাম। দর্শকদের কাছে
পেলাম ভালোবাসা’।
নায়ক হবার সু্যোগ
পেলেন তাঁর তৃতীয়
ছবিতে। সেটি ছিল
শ্রীমতী পিকচার্সের
‘অনন্যা’। ১৯৪৮ সালে
রিলিজ। সেই প্রথম
সিনেমার পর্দায় এক
সঙ্গে বিকাশ রায় ও
অনুভা গুপ্তা কমবয়সী
রোমান্টিক
নায়ক-নায়িকা সুকান্ত
ও উমার ভূমিকায়।
সিনেমায় প্রধান
‘অনন্যা’ চরিত্রে
অভিনয় করেছিলেন কানন
দেবী আর কমল মিত্র হয়ে
ছিলেন ভিলেন রাঘব
ডাক্তার। চিত্রগ্রাহক
ছিলেন অজয় কর।
‘দিনের পর দিন’ ছবিতে
বিকাশ রায়ের অভিনয়
দেবকী কুমার বসুর নজরে
পড়লো। মনস্থির করলেন
‘ফুটপাতে’ বিকাশ রায়কে
দিয়ে নায়কের চরিত্রে
অভিনয় করাবেন। ছবিটা
তৈরী হলোনা। তার বদলে
দেবকী বসু যখন
‘রত্নদীপ’ ছবিটি করলেন
নায়ক রাখালের এক
অনবদ্য চরিত্রচিত্রন
করলেন বিকাশ, ‘আমি তো
মনে করি, আঙুলে গোনা যে
কটি চরিত্রে আমি ভালো
অভিনয় করতে পেরেছি,
তার মধ্যে ‘রত্নদীপ’
বোধহয় সবার উপরে। আমরা
সকলে প্রাণ দিয়ে
দেবকীবাবুর নির্দেশ
পালন করেছিলাম—ছবি
প্রচণ্ড বক্স অফিস হিট
করেছিল’।
রত্নদীপের পরেই মুক্তি
পেয়েছিল ‘জিঘাংসা’,
শার্লক হোমসের
গোয়েন্দাকাহিনী
‘হাউন্ড অফ
বাস্কারভিলস্” এর
ছায়া অবলম্বনে।
পরিচালক অজয় কর। বিকাশ
রায় ছিলেন প্রধান
কুচক্রী এক
প্রতিহিংসাপাগল
বটানিস্ট-এর চরিত্রে।
ছবিতে গলার আওয়াজ ও
মডিউলেশন ছিল অসাধারণ।
অভিনয়ের পাশাপাশি এই
ছবির অন্যতম প্রযোজক
ছিলেন তিনি।
স্মৃতিচারণায় বলেন,
‘কাজ চলে, নাম যশ হয়,
কিন্তু মন খুশি হয় না।
কী যেন আমার করা হল না,
কী যেন আমার দেবার আছে।
মন ছটফট করে। একটা
ছবিতে শুধু অভিনয়
ছাড়া আমার আর তো কিছু
করার থাকে না। তবু মনে
হয় আমার আরও কিছু করার
আছে। … কিছু একটা করা
ঠিক করলাম। অজয় কর,
তখনকার দিনের খুব
নামজাদা আর্ট ডিরেক্টর
বীরেন নাগ, আমি আর সুবোধ
দাস নামে আমাদের একটি
বন্ধু, চারজনে এক
কোম্পানী করলাম।
নিজেরা ছবি করবো। আমরা
তিনজন খাটবো। কোনান
ডয়েলের ‘হাউন্ড অফ
ব্যাস্কার ভিল’
অবলম্বনে ‘জিঘাংসা’
ছবি শুরু করা গেল। …
‘জিঘাংসা’ ছবি
সম্বন্ধে আজও প্রশংসা
শোনা যায়। একটি অপরাধ
ও রহস্যমূলক ছবি হিসেবে
‘জিঘাংসা’ অতুলনীয়।
অজয়বাবু পরিচালক ও
চিত্রশিল্পীরূপে কাজ
করেন। বীরেন নাগের
শিল্প-নির্দেশনা মনে
রাখবার মত হয়েছিল।
আমার অভিনয়ও দর্শকদের
খুশি করেছিল। আমার এবং
আরো দু-একজনের মেকআপ
করেছিলেন প্রাণানন্দ
গোস্বামী। সকলে অবাক
হয়ে গিয়েছিল। ছবি
চলেছিল ভালো’।
সিরিয়াস ভূমিকায়
অভিনয় করতে করতে
একসময় ক্লান্তি বোধ
করছিলেন তিনি। তাঁর মতো
অভিনেতাকে যদি বহুমুখী
চরিত্র না দেওয়া হয়
তাহলে এটাই বোধহয়
স্বাভাবিক। ১৯৫২ সালে
এক ফিল্ম পত্রিকা
তখনকার অভিনেতাদের
জিজ্ঞাসা করেছিল,
শরৎচন্দ্রের
‘শ্রীকান্ত’ নিয়ে সেই
সময় কোনো ছবি তৈরী করা
হলে কে কোন ভূমিকায়
অভিনয় করতে ইচ্ছুক।
বিকাশ রায় বলেছিলেন -
“একটি ‘লবেজান’ snob role
করিবার ইচ্ছা আমার
অনেকদিন হইতে আছে। Character
acting করিয়া করিয়া আমার
এমন অবস্থা
দাঁড়াইয়াছে যে
নিজেকে অত্যন্ত Serious
ছাড়া কল্পনা করা নিজের
পক্ষেই দুষ্কর হইয়া
গিয়াছে। অথচ, আমি যে
serio-comic role কত দক্ষতার সহিত
করিতে পারি তাহার খোঁজ
বোধ করি আমার গৃহিণী
ছাড়া কেহই খবর রাখেন
না (কথাটা তাঁর কাণে না
পৌঁছাইলেই ভালো হয়)।
সত্যসত্যই
“নতুনদাদার” চরিত্র
বিশ্লেষণ করিতে গিয়া
যেন একটা নূতন উদ্যম
পাইলাম। এখন একটা departure
–এর জন্য প্রাণটা ছটফট
করিতেছে – আপনারা
বিশ্বাস করিবেন কিনা
জানিনা।” (শারদীয়া
চিত্রবাণী ১৩৫৯)।
তো ’৪২-এর পর একদিকে
শাপমোচন (১৯৫৫) ছবির
পৌরুষমদগর্বী অথচ মূঢ়
কুমারবাহাদুরের
ভূমিকা থেকে শুরু করে
জীবনতৃষ্ণা (১৯৫৭) ছবির
সমাজ-পরিত্যক্ত অনাথ
দেবকমল চরিত্র পর্যন্ত
সব ভূমিকাকেই বিকাশ
রায় অপ্রতিরোধ্য এক
একটি বাস্তব রূপ দিয়ে
চলেছেন। যদিও ওই
অপ্রতিদ্বন্দ্বী
কণ্ঠস্বর আর মার্জিত
উচ্চারণভঙ্গী, বিশেষ
করে ইংরেজী উচ্চারণের
কারনে বিকাশ রায়কে
শিক্ষিত মানুষের
ভূমিকাতেই মানাতো
বেশী। সন্ধ্যাদীপের
শিখা (১৯৬৪) ছবিতে মেজর
অনুপম ব্যানার্জী রূপে
বিকাশ রায়ের ছোটো
কিন্তু উজ্জ্বল অভিনয়
যথেষ্ট সমীহ আদায় করে
নিতে পেরেছিল।
উত্তরফাল্গুনীতে (১৯৬৩)
ব্যারিস্টার মণীশ রায়
হিসেবে বিকাশ রায় যে
এক স্বতঃস্ফূর্ত ও
সাবলীল চরিত্রচিত্রণ
করেছিলেন, তাতেই
সন্ধ্যাদীপের শিখা
ছবিতে তাঁর অভিনয়ের
পূর্বাভাস ছিল যেন। পরে
ছদ্মবেশী (১৯৬৫) ছবিতে
খামখেয়ালী কিন্তু
আদরণীয় ব্যারিস্টার
প্রশান্ত ঘোষের
ভূমিকায় অন্যরকম আর
"আরোগ্য নিকেতন"
ছবিতে (১৯৬৯) এক গ্রাম্য
কবিরাজ জীবনমশায়ের
ভূমিকায় বিকাশ রায়ের
অসামান্য অভিনয়
প্রতিভার চিরন্তন
সাক্ষর। জীবনমশায়
তাঁর ঐতিহ্য ও সংস্কার
থেকে পাওয়া প্রাচীন
শাস্ত্রের বাহক, রক্ষকও
বলা যায়। পশ্চিমী
বিজ্ঞানের আগ্রাসনে
তিনি মানসিক ভাবে
বিপর্যস্ত তবুও তার
প্রতিরোধে তিনি অচঞ্চল
ও দৃঢ়চিত্ত। এই
প্রতীকী
চরিত্রচিত্রণে তিনি artist
par excellence.!
১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল
পর্যন্ত বিকাশ রায়ের
দুশো আটচল্লিশটি ছবি
রিলিজ হয়েছে, সংখ্যাটা
উপেক্ষেণীয় নয়। বিশেষ
করে ১৯৫০ থেকে ১৯৭০
(তাঁর নিজের মতে ১৯৬০-৭০)
পর্যন্ত সিনেমার
পেশাদার অভিনেতা
হিসেবে তাঁর সবচেয়ে
ভালো সময়। একদিকে
সূর্যতোরণ ছবির
স্যুটবুট পরা
ইংরেজী-আওড়ানো অভিজাত
রাজশেখর বা
শ্রীকান্ত-ইন্দ্রনাথ-অ
্নদাদিদি ছবির
নেশাখোর সাপুড়ে শাহজী
সবেতেই তিনি
স্বতস্ফূর্ত, সাবলীল।
ইন্দ্রনাথ-শ্রীকান্ত-অ
্নদাদিদিতে তিনি
ধূর্ত, চক্রান্তকারী,
চরিত্রহীন সাপুড়ের
বেশে, শুধু মাত্র
দৃষ্টিভঙ্গিমা দিয়েই
তাঁর স্ত্রী অন্নদাকে
ঘর ছাড়া করেন।
"সাঁপের খেলা দেখবে"
কথায় বিশেষ বাচনভঙ্গি
আর চোখের দৃষ্টির
মিশ্রণ ছিল ভয়ানক।
সাপের চোখকেও হার
মানায় । ছবিতেই সাপের
কামড়ে মৃত্যুর
মুহুর্তে সাপটিকে টেনে
ছিঁড়ে মেরে ফেলার সময়
তাঁর অভিনয় ওই
অপ্রতিরোধ্য, দুর্লভ এক
অভিজ্ঞতা। বধূ ছবিতে
হাত কচলে-কচলে কি
পরিমাণই না বিষ
ছড়িয়েছিলেন। না
ছবিতে একটি সহজ সরল
মানুষ কি ভাবে ধীরে
ধীরে একটি অমানুষে
পরিণত হয়ে যাচ্ছে তাও
সহজে ফুটিয়ে তুলছেন
অবলীলায়। রত্নদীপে
তিনি একধারে প্রতারক
অন্য দিকে প্রেমিক।
ছবিটি বক্স অফিস হিট
হয়েছিল। তিনি ছিলেন
জাত শিল্পী।
অনস্বীকার্য।
বহুমাত্রিক বিকাশ রায়
অভিনয়ের সঙ্গে-সঙ্গে
ছবির প্রযোজনা,
পরিচালনা, কাহিনী-রচনা
ও চিত্রনাট্য রচনাও
করেছেন। বিকাশ রায়
প্রোডাকশন -এর ছবি গুলি
বিভিন্ন আঙ্গিকের।
অর্ধাঙ্গিনী ও
সূর্যমুখী পারিবারিক
ছবি, বসন্ত বাহার
সংগীতবহুল। মরুতীর্থ
হিংলাজ মানুষের মনের
নানান
ঘাত-প্রতিঘাত-প্রেম
নিয়ে একটি নিটোল ভ্রমণ
কাহিনী। ঐতিহাসিক
উপন্যাস কেরিসাহেবের
মুন্সী অবলম্বনে তৈরী
ছবির চিত্রনাট্য,
পরিচালনা ও প্রযোজনা
তিনিই করেন। নতুন
প্রভাত ও উত্তমকুমার
অভিনীত রাজা-সাজা ছবির
কাহিনী রচনা করেন বিকাশ
রায় । কাজললতা,
বিন্দুর ছেলে, দুই
পুরুষ –এর চিত্রনাট্য
তাঁর।
ওর সম্বন্ধে মৃণাল সেন
বলছেন: "খুব সিরিয়াস
মানুষ। শটের ডিটেল্স
খুব মনোযোগ সহকারে শুনে
নিতেন। তারপর
সহশিল্পীদের সঙ্গে
সংলাপ উচ্চারণ করে
নিতেন। এরপর ক্যামেরা
মুভমেন্টের সঙ্গে
দু’-একটা মনিটর হবার পর
ফাইনাল টেকিং হত। ওঁর
সঙ্গে কাজ করতে কোনো
সময়েই আমাকে সমস্যায়
পড়তে হয়নি।" আর তপন
সিংহ’র মতে, " বিকাশ
রায় বরাবরই খুব
মেথোডিক্যাল। একবারের
বেশি দুবার তাঁকে কোনো
কথা বলতে হত না।
ফিল্ম-সেন্সটা ছিল
প্রখর।" দুই প্রথম
শ্রেণীর পরিচালকের এই
মত থেকে বোঝাই যায় যে
তাঁকে নিয়ে কাজ করে
পরিচালকেরা বেশ
স্বচ্ছন্দই থাকক্তেন।
অন্য কলাকুশলীরা, যথা
ক্যামেরাম্যান বা
শব্দযন্ত্রীরাও এই
ধরণের কথা বলেছেন। এটা
অবশ্য আশা করা যায়
কেননা বিকাশ রায়ের
নিজের লেখা থেকে জানছি
যে তাঁর পেশায় দক্ষ
হবার জন্য তিনি বিশেষ
চেষ্টা করতেন। যেমন,
তাঁর কণ্ঠস্বরের খুব
নাম ছিল। তিনি লিখেছেন
রেডিয়োতে কাজ করার
সময় তিনি অনেক খেটে
মাইক্রোফোন ব্যবহারের
কৌশল শেখেন। আবার
সিনেমা শুরু করেই তিনি
সমস্ত ব্যাপারটা
জানবার জন্য সামান্য
পারিশ্রমিকে পরিচালক
হেমেন গুপ্তের সহকারী
হয়ে শিক্ষানবিশী করেন
৪২ ছবিতে। আর তাঁর
প্রচুর পড়াশোনা তাঁকে
চরিত্রের গভীরে প্রবেশ
করার কাজে সাহায্য করত।
নায়কের বিপরীতে
খলনায়ক। সে এমন এক
চরিত্র, যে নায়কের
ক্ষতি করার চেষ্টা করে।
নায়ক সাদা, আর খলনায়ক
কালো। কিন্তু এতটাই কি
সহজ-সরল ব্যাপারটা?
সাদা-কালোর মাঝামাঝি
নানা ধূসর শেডস্ কি
থাকেনা অন্য কোন
চরিত্রে ? থাকে
নিশ্চয়ই। তাই সে
অভিনয়ের কোনও স্বীকৃত
ব্যাকরণ থাকে না যেমন
তেমনি প্রোটোটাইপ
অভিনয় দিয়ে দর্শকের
মনও জয় করা যায় না।
কখনো মেথড্ অ্যাক্টিং,
আবার কখনো নিজস্বতার
ছোঁয়াতে তৈরী হয় সেই
চরিত্রের ব্যক্তিত্ব।
সেই নির্মানে থাকে
অধ্যাবসায়, সাধনা,
‘অভিনেতার পক্ষে অবশ্য
সংগ্রহণীয় আর একটি
কথা......সেটা হল অভিনেতার
ব্যক্তিত্ব
প্রতিষ্ঠা। সাধারণ
জীবনে আমরা বহু মানুষের
সাক্ষাৎ লাভ করি যাঁদের
স্বতঃস্ফূর্ত
ব্যক্তিত্ব আছে – দশের
মাঝে তাঁরা একক। এটা
বহু সময় জন্মগত, কেউ
কেউ এই ব্যক্তিত্ব
নিয়েই জন্মান।
অভিনেতার পক্ষেও তাই।
এমন অনেকে আছেন যাঁরা
স্টেজে, ফিল্মে এসে
দাঁড়ালেই, রেডিওতে
একটি কথা উচ্চারণ করলেই
এই জন্মগত ব্যক্তিত্ব
বোঝা যায়। অভিনয়ের
ব্যাপারটা তাঁদের কাছে
অনেক সহজ হয়ে যায়।
কিন্তু যাঁদের এই
জন্মগত ব্যাপারটা নেই?
তাঁদের দ্বারা কি
অভিনয় হবে না? আমি বলি,
না হবে, ব্যক্তিত্ব
অর্জন করা যায়। নিরলস
সাধনায় এই ব্যক্তিত্ব
অর্জিত হয়’।