তিন নম্বর এ্যালবামের
প্রথম ছবিটাই সেই
রহস্যের জট খুললো অথবা
বাঁধলো। একটা গ্রুপ
ছবি। মায়ের দাদুর বাড়ির
সবাই। ছবির নিচে লেখা
‘১৯৩৮ খুলনা’ ।
এ্যালবামগুলো দাদুর
হলেও এগুলোর এমন
সংঘবদ্ধ সংরক্ষণের
কৃতিত্ব পুরোটাই
বড়মামার। বড়মামা
ম্যাসাচুসেটসে সিমন
কলেজে লাইব্রেরি
সায়েন্সে মাস্টার্স
করেছেন। যুদ্ধ বাঁধার
আগের বছর গ্রীষ্মের
ছুটিতে মামা দেশে
এসেছিলেন। সেইই শেষ
আসা।পুরো ছুটিটা দাদুর
লাইব্রেরি গুছিয়েই
কাটিয়েছিলেন বড়মামা।
সেই লাইব্রেরির কথা
এখনো নোয়াপাড়ার অনেকের
মনে আছে। গ্রামে তো নয়ই
এমনকি শহরেও এমন সমৃদ্ধ
এবং গোছানো ব্যক্তিগত
গ্রন্থাগার ছিল না সে
সময়ে। দাদুর সংগ্রহে
তাঁর পৈত্রিক সূত্রে
পাওয়া অনেক প্রাচীন
পুঁথি ছিল। একবার ফিলিপ
বুদ্রো নামের এক ফরাসী
ভাষা গবেষক দাদুর
লাইব্রেরিতে পুঁথি
নিয়ে কাজ করতে
এসেছিলেন। একাত্তরে
দাদুর সেই বিশাল
লাইব্রেরির প্রায়
সবটাই আগুনে পুড়ে
গিয়েছিল।
দাদুর বাড়িতে আমিও
গিয়েছিলাম; তখন অবশ্য
বাড়িটার মালিকানা
পাল্টে গেছে। মায়ের
মুখে শোনা গল্পের কোন
চিহ্নই খুঁজে পাইনি।
কেবল শান বাঁধানো পুকুর
ঘাট আর দেবদারু গাছগুলো
প্রাণপনে ডালপালা
দুলিয়ে আমাকে সেই
গল্পগাঁথা শোনাচ্ছিল।
যুদ্ধের শুরুতেই রাতের
আঁধারে দাদুর বাড়িতে
কেউ আগুন লাগিয়ে
দিয়েছিল। তখনো
পাকিস্তানীরা
নোয়াপাড়ায় ঢোকেনি।
পাকিপ্রেমীদের কাজ ছিল
সেটা। কারণও ছিল। ছোট
মামা এপ্রিলের শুরুতেই
বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল
যুদ্ধে যোগ দিতে। একথা
গোপন থাকেনি। আগুনে
প্রায় সব বইই পুড়ে ছাই
হয়ে গিয়েছিল। অনেক
চেষ্টা করেও বাঁচানো
যায়নি। দাদুর মন ভেঙে
গিয়েছিল। পরদিন এক
কাপড়েই দিদুকে নিয়ে
বাড়ি ছেড়ে শহরে চলে
এসেছিলেন আর সেখান থেকে
মা দাদাভাই শুদ্ধু
আগরতলা হয়ে কোলকাতা
পাড়ি দিয়েছিলেন। আমার
বাবা তখন যায়নি, অথবা
বলা যায় যেতে পারেনি।
আমার ঠাকুরদাদা সেইসময়
অসুস্থ, চলচ্ছক্তিহীন।
বাবা তাঁদের একমাত্র
সন্তান। তবে যুদ্ধের
মাঝামাঝি সময়ে জীবন
বাঁচাতে বাবাকেও
পালাতে হয়েছিল।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে
মাবাবা তিন বছরের
দাদাভাইকে নিয়ে ফিরে
এসেছিল। ছোট মামার কোন
খোঁজ পাওয়া যায়নি।
বাবা, দাদু মামার ছবি
নিয়ে অনেক ছুটোছুটি
করেছে, কোন খবর মেলেনি।
নোয়াপাড়ার বাড়িটা ধুধু
মরুভূমি তখন। তোলপাড়
করে লুটতরাজ করেছে ওরা।
পড়ে ছিল শুধু এই
এ্যালবাম গুলো, কাঁসার
কিছু তৈজসপত্র আর
লক্ষ্মীর দোলা। ভাঙা মন
নিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন
দাদু। বাড়িটা নামমাত্র
মূল্যে বিক্রি করে
দিয়েছিলেন। আমার
জন্মের আগেই দাদু দিদা
গত হয়েছেন। বড় মামাই
এখন আমার দাদুবাড়ির
একমাত্র সলতে। মামা
আমেরিকার নাগরিক। মামা
আমাদের সবার জন্মদিনে
এমনকি বাচ্চাদের
জন্মদিনেও উপহার
পাঠান। উনি আমেরিকান
বিয়ে করেছেন। তাঁর তিন
বাচ্চার সবাই সোনালি
চুলের, শাদা; মামীর মতন।
তবে ওদের বাঙলা নাম।
অর্ক, অভ্র, আর অর্ঘ্য।
মামার শেকড় ওদের নামে
বন্দি । হয়তো অন্য কোন
প্রজন্মে কারো কালো
চুলে বা রঙে কিংবা
চোখের তারায় ফিরবে
মামার বাঙাল ইতিহাস।
গতমাসে আমরা সবাই
গিয়েছিলাম চাটগাঁয় ।
অদ্রিশ আর দাদা এক
সপ্তাহ’র ছুটি নিয়েছে
অফিস থেকে। ক’দিন আগেই
বাবা অবশেষে রাজি হলেন
বাড়িটা রিয়েলটরকে দিয়ে
দিতে।আশেপাশের স ব বাড়ি
ওরা হাতিয়েছে।
সিলিন্ডারের মত
আকাশমূখি খাড়া দাঁড়িয়ে
বাড়িগুলো ‘প্রপার্টি
লেগুন’র জয়পতাকা
ওড়াচ্ছে। আমাদেরটাই
ছিল হারাধনের শেষ ছেলে।
কাল বাবাকে দেখে খুব
কষ্ট হচ্ছিলো। এ ক’দিনে
চোখ ঢুকে গেছে গর্তে।
দাদা আমাকে আড়ালে ডেকে
বললো, ‘বাবা বাঁচবে
নারে রুমকি, পিতৃহন্তা
হলাম হয়তোবা’।
আমি জানি টাকা থাকলে
দাদা বাড়িটার আগের
জৌলুস ঠিক ফিরিয়ে আনতো।
’৯৭ এর ভূমিকম্পে জোর
ধাক্কা খেয়েছিল বাড়িটা
। ওপরের তলার ব্যালকনির
একটা অংশ রাস্তায় ভেঙে
পড়েছিল। দাদা আমি
দু’জনই থাকি ঢাকায়।
বাবামা একা চাটগাঁয়।
বাড়িটা মেইন্টেইন করার
হ্যাঁপা অনেক। আজ এই
নষ্ট তো কাল ঐ। সিডিএ’র
লোকজনের সাথে
রিয়েলটরদের বাণিজ্য
আছে নির্ঘাত । দুদিন
পরপরই রিয়েলটরের টোপ
সাথে সিডিএ’র ডেমোলিশন
এড়াতে ঘুষের চাপ। বাবা
রাজি হয়ে গেলে আরও আগেই
ঝামেলা চুকতো।
সেদিন সকালে আমরা
নিচতলার তিনটা আলমারি
খালি করার প্ল্যান নিয়ে
বসেছিলাম। কত যে
অদরকারি কাগজ বাবা মা
জমিয়ে রেখেছে! লন্ড্রির
রিসিট থেকে টেলিফোনের
বিল থেকে ঠাকুরমা’র
হাতের লেখা গানের খাতা;
কী নেই? প্রথম আলমারিটা
খালি করে এক দফা চা আর
ডালপুরি হয়ে গেল।
সুমন্ত দা’ লোক দিয়ে
আলমারিটা বারান্দায়
বের করে নিয়েছে ঝাড়া
মোছার জন্যে। সুমন্ত
দা’ বাবার মুহুরী।
বিকেলে ফার্নিচার
কোম্পানির এক লোক আসবে
দেখতে। বেশির ভাগ
ফার্নিচারই বিক্রি করে
দিতে হবে। সব আসবাব
বিক্রিও হবে না। দোতলার
আরাম কেদারা কিংবা
গাব্দাগোব্দা
সোফাসেটটা তো নয়ই।
এ্যান্টিক কালেকটরের
খোঁজ লাগাতে লোক
লাগিয়েছে অদ্রীশ।
বেচারা অদ্রিশের
ধুলোতে এলার্জি।
আলমারি গুছাবার কাজে
সাহায্য করতে পারছিলো
না, যদিও মাঝে মাঝে দরজা
দিয়ে উঁকি দিয়ে
যাচ্ছিলো । দ্বিতীয়
আলমারির প্রথম তাকটা
খালি হয়ে গেল ঝটপট।আর
দ্বিতীয় তাকেই পেলাম
কার্ডবোর্ডের
বাক্সটা। কী ভারী! নিচে
নামাতে সুমন্ত দা’কে
ডাকতে হলো। ঢাকনাটা
খুলতেই এ্যালবামগুলো।
আমি বা দাদা কখনই এগুলো
দেখিনি। বউদির তো
প্রশ্নই ওঠেনা। মাকে
রান্নাঘর থেকে টেনে
আনলাম। কত ছবি! মা নিজেও
ভুলে গিয়েছিল। কোলের
ওপর এ্যালবামগুলি পেতে
ছবির সাথে পেছনের
দিনগুলোতে ফিরে গেল যেন
মা। বড়মামার সেই
লাইব্রেরি গোছানোর
গল্প অসংখ্যবার শুনেছি,
জানলাম সেই সময়ই পুরোনো
সব ছবি গুছিয়েছে
বড়মামা। অদ্বয় আর
কুনালও এলো দেখতে। ওরা
আমাদের মা বাবার
পারিবারিক ইতিহাস তেমন
জানে না। আমরাও ঘটা করে
বলিনি। এই ছবিগুলো দেখে
দুজনের মুখ ঝলমলে।
প্রথম এ্যালবামের
অনেককেই মা চেনেনা।
বিদেশীদের সাথে মায়ের
দাদু এবং ঠাকুরমা’র
ছবি। লর্ড তমুক সমুকের
নাম লেখা ছবির নিচে।
মায়ের ঠাকুরমা ভীষণ
স্টাইলিশ ছিলেন।
কপালের কাছে চুড়োচুড়ো
চুল আধঢাকা ঘোমটার
ফাঁকে বের করা। কুনাল
আর অদ্বয় ফেইস বুকে
ফটাফট আপলোড দেয়া শুরু
করলো। অদ্বয় তো এক কাঠি
সরেস। আমার মায়ের দাদু
ডিসি ছিলেন ব্রিটিশ
আমলে। লিখলো ‘দ্য
প্রাইড অফ বেঙ্গল’। মা
বাবার বিয়ের ছবিগুলো তো
অসাধারণ! আমার মা এখনো
দারুণ দেখতে। তবে তখন
সুচিত্রা সেনকে হার
মানানো রূপ ছিল মায়ের।
মা বাবার বিয়ের ছবি
আমাদের কাছেও আছে । এই
ছবিগুলো সব মায়ের দিকের
আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে
তোলা আর এত সুন্দর করে
সন্নিবেশ করেছে মামা যে
‘হিন্দু বিয়ের আচার’
নামে একটা ডকুফিল্ম করা
যায় অনায়াসে। তিন
নম্বর এ্যালবামটা
ধরতেই মা তাড়া লাগালো,
‘পরে দেখিস বেলা বেড়ে
যাচ্ছে। কবে কী করবি
তোরা!’ দুপুরের
খাবারের জোগাড় হয়নি।
বাবা আর অদ্রিশ ওপরে
স্পোর্টস চ্যানেলে
গ্রাঁ প্রি দেখছে।
কাজের মাসি জানিয়ে গেল
বাবার খিধে লেগেছে।
বউদি ততক্ষণে ঝুঁকে
পড়েছে ছবির ওপর। ১৯৩৮
ভাবা যায়! সামনের
সারিতে বসে সেই বড়দিদা
মানে মায়ের ঠাকুরমা।
লম্বা হাতা ব্লাউজ
গায়ে, মাথায় অল্পঘোমটা।
বাঁ কাঁধের কাছে ব্রুচ
দিয়ে পাট করে আঁচল ভাঁজ
করা। প্রথম নজর তাঁকেই
টানে। কী ফ্যাশন
দুরস্ত! তাঁর এক পাশে
মায়ের বাবা মানে আমার
দাদু আর সেজ দাদু অন্য
পাশে ন’দাদু আর ছোট
দাদু। মা পরিচয়
দিচ্ছিলেন। ছোট দাদু
ছাড়া সবাই কালো স্যুট
পড়া। ছোট দাদু
গান্ধীবাদী ছিলেন।
খদ্দরের পাঞ্জাবী আর
ধুতি পরা, পায়ে খড়ম আর
ঝাঁটার মত শলাশলা গোঁফ।
দাদা বললো ‘সুকুমার
রায়ের আবোলতাবোলে
বইয়ের মডেল’! পেছনে
দাঁড়ানো সুবেশী
মহিলারা তাঁদের
স্ত্রী। আমার দিদুও আছে
ওখানে। হঠাৎ আমার নজর
পিছলে গেল কিশোরির পাশে
দাঁড়ানো ছোট মেয়েটার
ওপরে । বুক ধক করে উঠলো।
মায়ের ঠাকুরমার পায়ের
কাছে পা মুড়ে বসা সেই
কিশোরি হলো মায়ের
পিসিমা। পিসির কাঁধ
ছুঁয়ে দাঁড়ানো ঝাঁকড়া
চুলের বছর তিনেকের
মেয়েটা? পৃথিবী থমকে
গেল যেন! আমার মগজে গা
ঝাড়া দিয়ে সিধে হচ্ছে
সেই ঘটনা। অনেক কষ্টে
মুখ দিয়ে বেরুলো,
‘অজিতা মাসি!’ মা অবাক।
দাদা অবাক। বউদি বোঝার
চেষ্টা করছে।
আমি স্পষ্ট দেখছি
বাচ্চাটার কোলে জামার
সাথে প্রায় মিশে আছে
একটা পাখি।পাখিটা আমি
চিনি। ছবির ক্ষয়াটে
বাদামি রঙের মধ্যেও
পাখিটার কালো শাদা
তীক্ষ্ণ চোখজোড়া আমায়
দেখছে। অদ্রিশকে ডাকি
চিৎকার করে। আমার
চিন্তা আর কথা সমান
তালে এগোচ্ছিলো
না।‘স্পিক্জ, অজিতা
মাসি’। আমি আঙুল শক্ত
করে চেপে রাখি মেয়েটার
ওপরে যেন আঙুল সরালেই
মিলিয়ে যাবে ও। অদ্রিশ
ঝুঁকে দেখতে থাকে
ছবিটা।
বছর পাঁচেক আগের কথা ।
আমরা সবে নতুন ফ্ল্যাটে
উঠেছি। দিন পনেরো মাত্র
পার হয়েছে। কলোনীতে
ছিলাম। সবার সাথে বেশ
মিলমিশ ছিল। ফ্ল্যাটে
এসে আমার দম বন্ধ হবার
জোগাড়। আমাদের ফ্ল্যাট
চার তলায়। প্রতি তলায়
চারটে করে ফ্ল্যাট।
পনেরো দিনে কেউ আমাকে
হাই হ্যালো করতেও এলো
না। যদিও লিফটে
ওঠানামার সময় হরদম
দেখছি লোকজন। নয় তলা এই
বিল্ডিঙে ছত্রিশ খানা
ফ্ল্যাট অথচ পাশাপাশি
থেকেও কেউ কারো পাশে
নেই।
নতুন ফ্ল্যাট থেকে
কুনালের স্কুল বেশ
কাছেই। আগে যেতে আসতেই
বেলা কাবার হতো।
অদ্রিশের অফিস অবশ্য
আগের চেয়ে দূরে তাও
কুনালকে নামিয়ে ঠিক
সময়েই পৌঁছায় ও কেবল
ভোরে জাগাতে আমার দম
ফুরোয়। দুপুরে আমিই আনি
কুনালকে । ফ্ল্যাট
কেনার অর্ধেকের বেশি
টাকা দিয়েছেন অদ্রিশের
দাদা। উনি কুয়েতে
থাকেন। ইঞ্জিনিয়ার এবং
অকৃতদার। বলেছিলেন,
‘রিটায়ারম্যান্টের
পরে তোদের কাছেই এসে
থাকবো’। সব কিছুর দাম
বাড়ছে হুহু করে । এর পরে
হয়তো ছুঁতেও পারবোনা।
আমাদের নিজের একটা ঠাঁই
চাই। ফ্ল্যাটটা আমিই
জোর করে কিনিয়েছিলাম।
অদ্রীশের দাদা সাহায্য
না করলে অবশ্য সম্ভব
হতো না।
এই ফ্ল্যাটে ঢোকার আগেই
অদ্রিশের প্রমোশন
হওয়ার কথা ছিল। হঠাৎ
জানতে পারলাম ওর নামে
কেউ অভিযোগ করেছে
ওপরতলায়। অদ্রিশ কাজে
চৌকস। পরিশ্রমী আর সৎ
বলেও সুনাম আছে।হঠাৎ
করে কার বাড়া ভাতে ছাই
পড়লো! মনটা খুবই খারাপ
ছিল আমাদের। সেদিন
বৃহস্পতিবার অদ্রিশকে
সকালে এই ব্যাপারেই কথা
বলতে ডেকেছিলেন ওর বস।
কুনালকে নামিয়ে দেবার
দায়িত্বটা আমাকেই নিতে
হলো। সকাল সাড়ে ছটায়
বেরিয়েছিলাম টেক্সি
করে। কুনালকে স্কুলে
নামিয়ে ফেরার পথে ধরা
খেলাম। সেকি জ্যাম!
ঘন্টা খানেক
ট্যাক্সিতেই কাটলো।
যখন বাড়ি পৌঁছুলাম তখন
ঘেমে নেয়ে ঝোল। মিনতিকে
চা দিতে বলে স্নানে
ঢুকেছিলাম। ফিরে এসে
পেপারটায় চোখ
বুলাচ্ছিলাম। মিনতি
বেরোলো রান্নাঘরের
এঁটোকাঁটা ফেলতে। চায়ে
ঠোঁট ছোঁয়াবো অমনি
চেয়ার ঠেলে কেউ একজন
বসলো আমার পাশে। এতটাই
আচমকা যে আমার হাত থেকে
চা ছলকে পড়লো। সামলে
নিয়ে চোখ তুলতেই দেখি
ভদ্রমহিলা। ‘কে আপনি?’
আমার নিজের গলা নিজের
কাছেই অচেনা ঠেকছিলো।
এমন ভয় আমি জীবনে
পাইনি। ভদ্রমহিলা যুত
করে বসেন। ‘চিনতে পারছো
না আমি তোমার অজিতা
মাসি?’ –‘কে ?’ উনি
মিষ্টি করে হেসে বলেন,
‘অজিতা বসু গো! তোমার
মায়ের পিসতুতো বোন’।
আমার মায়ের পিস্তুতো
বোন! আমার মায়ের একটাই
পিসি। নিঃসন্তান
বিধবা। মুখুজ্জে।
জীবনের ওপারে যাওয়ার
বয়েস এখন তার।
কস্মিনকালেও মায়ের কোন
পিসতুতো মাসতুতো তো ছাড়
কোন বোনের কথাই শুনিনি।
আমার হাতের রোম ততক্ষণে
খাড়া দাঁড়িয়ে।
ভদ্রবেশি ডাকাত নয়তো!
ঢোক গিলে বলি, ‘আপনি
কোথাও ভুল করছেন। আমার
মায়ের কোন পিসতুতো বোন
নেই।'
ভদ্রমহিলাকে দেখতে বেশ
বনেদি। অফহোয়াইট
জমিনের ওপর শ্যাওলা
সবুজ কাজের জামদানি
পরেছেন। কানে শাড়ির
সাথে মিলিয়ে সবুজ
পান্নার টপ। হাতের
ব্যাগটাও ঘন দুধের সরের
মত বাদামি শাদা। কখন
ঢুকলেন? পায়ের আওয়াজই
পেলাম না! এই ফ্ল্যাটের
ম্যানেজমেন্ট আসলেই
যাচ্ছেতাই। ভিখারি
কিংবা বুয়া গোছের কেউ
না হলে সিকিউরিটি সহজে
আটকায় না। উনি মিটিমিটি
হাসছেন, ‘আজকালকার
ছেলেমেয়েরা নিজেদের
ভাই বোনদেরই চেনেনা’।
তারপরেই হঠাৎ উনি
উল্টো দিকের দেয়ালের
ছবিটার দিকে অপলক কয়েক
সেকেন্ড তাকিয়ে
থাকলেন। নিজের মনেই
বিড়বিড় করলেন যেন,
‘স্পিক্জ আর দেখা যায়
না।’। স্পিক্জ আবার কী?
ছবিটা একটা জাপানী
ক্যালেন্ডারের পাতার,
আমার খুব পছন্দ হয়েছিল
বলে বাঁধিয়েছিলাম।
আগের বাড়িতে লিভিং রুমে
ছিল, এখানে ডাইনিঙে
ঝুলিয়েছি। নীল আকাশ
জুড়ে রঙধনুর মত এক ঝাঁক
লাল,সবু্জ, নীল, শাদা,
রঙিন পাখির মেলা। ওদের
স্পিক্জ বলে? আমি বুঝে
ওঠার চেষ্টা করি। উনি
হঠাৎ আমার দিকে ঘুরে
বলেন, ‘দেয়ালের রঙ
পাল্টাও। কী বিচ্ছিরি
রঙ! সারা বাড়িতে নীলের
বিভিন্ন শেড লাগাও।
সমুদ্র নীল কিংবা বরফ
নীল তবে ধূসর নীল
সবচেয়ে ভালো।
স্পিক্জের পালকের মত।
এক সপ্তাহের মধ্যে সব
মুশকিল আসান হবে’। শেষ
কথাটায় আমি ভড়কে গেলাম।
কীসের মুশকিল আসান? উনি
কি জানেন কিছু? উনি তখনো
বলে চলেছেন,
‘ক্যাটক্যাটে নীল দিও
না আবার। অসহ্য। চায়ের
দোকানের মত লাগে।’ এবার
আমার মেজাজ চড়ে যায়।
আরে চেনা নেই জানা নেই
গুছিয়ে বসে জ্ঞান দিয়ে
যাচ্ছে তখন থেকে!
যথাসম্ভব শান্ত গলায়
বলি, ‘আপনি কার বাড়িতে
এসেছেন?’ সাথে সাথে উনি
চুপ হয়ে যান। আমার দিকে
অদ্ভুত ফাঁকা চোখে
তাকান। আর ঠিক এই সময়
মিনতিও ঢোকে দরজায়
আওয়াজ তুলে। ও ডাইনিঙে
পা রাখতেই আমার বুকে
জোর ফিরলো। ওমা উনিও
উঠে দাঁড়ালেন! আমি এবার
বেশ জোরেই বললাম, ‘কার
কাছে এসেছেন বললেন
নাতো?’। উনি কিছু না বলে
চেয়ার ঠেলে ডাইনিং থেকে
বেরিয়ে গেলেন। মিনতি
পেছন থেকে বললো, ‘খালা
আফনে তিন তলায় থাকেন
না?’ অজান্তেই ভ্রূ
কুঁচকায় আমার। এরই
মধ্যে মিনতি দোতলা
তিনতলা চিনে ফেললো! উনি
উত্তর না দিয়ে দরজাটা
নিজেই খুলে বেরিয়ে
গেলেন। আমি আর মিনতি
বোকার মত চেয়েচেয়ে
দেখলাম। দরজাটা উলটো
দিকে টান খেতেই আমার
টনক নড়লো। ছুটে গেলাম
দেখতে। আমাদের দরজার
পাশেই লিফটের খাঁচা।
লিফটের সংকেতে জানলাম
নিচে নামছেন। আমার মাথা
কাজ করতে শুরু করলো
এবার। সিকিউরিটিকে ফোন
দিলাম তুড়ন্ত। ওরা
জানালো নজর রাখছে।
মিনতির কথামত বাড়তি
জানালাম তিনি তিন তলার
কেউ হতে পারেন। মা’কে
ফোন দিলাম। নাহ্ অজিতা
বসু নামে কাউকে মা চেনে
না। কুনালকে স্কুল থেকে
আনার পথে আবার গেলাম
সিকিউরিটির কাছে। তিন
তলায় চারটে ফ্ল্যাট;
কোন বসু পরিবার নেই। কী
আশ্চর্য!
অদ্রিশ অফিস থেকে এলো
মুখ ভার করে। উড়ো চিঠির
কথাটা সত্য। আমাকেই
দুষতে লাগলো, ‘বলেছিলাম
ফ্ল্যাটটা এখন না কিনি।
এবার বোঝ’। ‘কী আশ্চর্য
ট্যাক্স রিটার্ণে তো
উল্লেখ আছে ফ্ল্যাটের!
করতে দাও তদন্ত।
যত্তসব’। আমি রাগে
ফুঁসতে থাকি। ‘উড়ো চিঠি
সত্য নয় বলেই তো ওড়ে।
তোমার বসদের মগজ কি হাড়
দিয়ে তৈরি? টাকা খাওয়ার
ফন্দি’। অদ্রিশ বাথরুম
থেকে বলে চলে, ‘ভারতেও
নাকি বাড়ি আছে আমার’।
‘তো এখানে কী করছি
আমরা?’ ফাজিল সব। মনটা
ভার হয়ে গেল। সকালের
ঘটনাটা বলার সুযোগ হলো
না। সন্ধ্যায় কুনালকে
নিয়ে হোমওয়ার্ক করাতে
বসেছি, টেবিলের কাছেই
দেখি একটা পালক। ধূসর
নীল। কোত্থেকে এলো?
পালকটা হাতে নিতেই কী
একটা যেন ছুঁয়ে গেলো
আমাকে! ছুটে গিয়ে
অদ্রিশকে দেখাই।
অদ্রিশ সব শুনে প্রথমে
অবাক তারপরে বকা,
‘এতক্ষণ পরে বলছো?
বুদ্ধিশুদ্ধি সব গেছে!’
পালক নয় অচেনা মহিলা
ফ্ল্যাটে ঢুকে বাকোয়াজ
করেছে এটাই ওর চিন্তার
কারণ আর তখনই আমার মনে
হলো দেয়ালের রঙটা আসলেই
যাচ্ছেতাই। অদ্রিশ যখন
ফ্ল্যাটের
ম্যানেজমেন্টকে ঝাড়ছে
ফোনে আমি তখন ল্যাপটপে
ঘাড় গুঁজে পড়ছি
স্পিক্জের যত কথা। এরা
বিরল ম্যাকাউ পাখি।
ধুসর নীল রঙ। আকারে
ছোট। চোখ জোড়া অসাধারণ,
ধবধবে শাদা পুকুরে কালো
চাঁদ যেন। ডাইনিঙে
দেয়ালের ছবিটা এই প্রথম
ভালো করে দেখি। অবাক
হয়ে আবিস্কার করি নীল
আকাশে মেঘকে পেছনে রেখে
উড়ছে সব নানা রঙের
ম্যাকাউ। সেখানে ঠিক
তিনটে ধুসর নীল
স্পিক্জ। আমার গায়ে
কাঁটা দিয়ে ওঠে। যে
চেয়ারে উনি বসেছিলেন
সেখান থেকে দেখার
চেষ্টা করি। রঙধনুর মত
বেঁকে গেছে পাখির ঝাঁক।
আলাদা করে স্পিক্জ দেখা
যায় না তো!
ক’দিন পরে কুনালকে নিয়ে
ফিরেছি অমনি কলিং বেল।
অনন্যা, তিন তলায়
থাকেন। আমার সাথে
পরিচিত হতে এসেছেন।
ম্যানেজমেন্ট তবে খবর
করেছে! উনিও ভণিতায়
গেলেন না সরাসরি বললেন
ওর খালাম্মা সম্ভবত
এসেছিলেন আমার বাড়িতে।
মোবাইলে ছবি দেখালেন।
হ্যাঁ তিনিই। ওঁর নাম
জান্নাতুল ফেরদৌস।
‘তবে যে বললেন অজিতা
বসু!’ অনন্যা বললেন এই
ধাঁধার উত্তর উনিও
খুঁজছেন। কিছুটা
মানসিক সমস্যা আছে
খালাম্মার। বর্তমান
অতিত তালগোল পাকান মাঝে
মাঝে কিন্তু নাম নিয়ে
এমন ঘাপলা হয়নি কখনও।
জানালেন গত এক বছর ধরে
উনি অনন্যার কাছেই
আছেন। শিক্ষকতা করতেন,
এখন রিটায়ার্ড । খুব
অল্প বয়েসে বিধবা
হয়েছিলেন। একমাত্র
ছেলে বুয়েট থেকে বেরিয়ে
ফুল রাইডে আমেরিকা যায়।
সেখানেই কার ক্র্যাশে
অপমৃত্যু। উনি খুব শক্ত
মনের মানুষ ; সবাই
ভেবেছিল শোকের ভার বইতে
পারবেন। স্বাভাবিকই
ছিলেন। কিন্তু বছর
দুয়েক পরে হঠাৎ একদিন
খুলনা থেকে সরাসরি ঢাকা
এয়ারপোর্টে চলে
এসেছিলেন। সারারাত
এয়ারপোর্টে বসে ছিলেন
একা। এরপরেই অনন্যা
তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন
নিজের কাছে। অনন্যার
মাও থাকেন ওর সাথে। উনি
খুব ভালো ছবি আঁকেন।
আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো
তক্ষুনি যাই। কিন্তু
অনন্যার সাথে কথা বলে
বুঝলাম কৈফিয়ত নয় উনি
যাচাই করতে এসেছেন
আমাকে। লিফটের কাছেই
আমার দরোজা, ভুলে ঢুকে
পড়াটা অস্বাভাবিক নয়
কিন্তু নাম পাল্টাবেন
কেন তাও আবার হিন্দু
নাম! ওর বলার ধরণ আমার
পছন্দ হলো না। আমি নীল
পালকটার কথা চেপে গেলাম
। সেদিন তিনি অনেকক্ষণ
বসেছিলেন। অদ্ভুত!
যাওয়ার সময় তার বাড়িতে
যাবার জন্যে একবারও
বললেন না।
এক বিকেলে চলে গেলাম
তিন তলায়। বেল টিপতেই
দরোজা খুলে দিলেন
অনন্যাই। আমাকে দেখে
একটু থমকালেন। ‘আসেন’
বলে ড্রইংরুমে নিয়ে
এলেন। ভদ্রমহিলা টিভি
দেখছেন। অনন্যা পরিচয়
করিয়ে দিলেন। আমার
আদাবের প্রতিউত্তরে
বসতে বললেন। জি টিভিতে
তখন বাচ্চা একটা ছেলে
মুকেশের গান গাইছে
বললেন, ‘ওল্ড সোল,
এইটুকুন বাচ্চা কেমন
ওস্তাদের মত গাইছে দেখ?
আত্মার বিনাশ নেই
শাস্ত্রে বলে। কোন
ওস্তাদ আত্মা ঠিক ঢুকে
পড়েছে ওর শরীরে। জানো
তো এনার্জি
রিসাইক্লবেল?’ আমি হা
করে তাকিয়ে থাকি। হঠাৎ
চোখে পড়ে দেয়ালে একজোড়া
নীল ম্যাকাউ সরাসরি চোখ
মেলে দেখছে আমায় ।
কাকতালীয়? উনি লাজুক
হাসলেন, ‘ঠিক মত আঁকতে
পারিনি। মন থেকে এঁকেছি
তো’। আমি জিজ্ঞেস
করলাম, ‘স্পিক্জ?’
‘তুমি পাখি চেন?’ আমি
চেপে যাই। জিজ্ঞেস করি,
‘আপনার ছিল?’ ‘নাহ্
ছেলেবেলায় হয়তো দেখেছি
কোথাও। মনে নেই। এই
পাখি বিরল প্রজাতির।
অনেক দাম’। আমি সাহস
করে বলি, ‘অজিতা বসুর
হয়তোবা’। উনি অবাক হয়ে
জানতে চান ‘অজিতা বসুটা
কে?’ অনন্যা এবার জানান
আমার আসার কারণ। উনি
ভ্রূ কুঁচকে দেখেন
আমাকে।‘কী বল এসব?
পঁচাত্তর বছর ধরে
জান্নাতুল ফেরদাউস
নামেই তো দিব্যি কাটিয়ে
দিলাম এখন অজিতা বসু
হবো কেন?’ আমি
অপ্রস্তুত হই, তাড়াতাড়ি
বলি, ‘আমারই ভুল হচ্ছে
কোথাও’। কথা আর এগোয় না
। উনি বুঁদ হয়ে গানের
অনুষ্ঠান শুনতে থাকেন।
চলে আসার সময় আমার
আদাবের উত্তর দেয়া দূরে
থাক ফিরেও তাকান না।
বাড়িতে ঢুকেই মনে হয়
সারা বাড়ি যেন অশুভ
কিছু ঘটার অপেক্ষায়
আছে। ভেতরের অস্থিরতা
কাটেনা। অদ্রিশ বাড়ি
ফিরলেই রীতিমত ঝগড়া করে
বাধ্য করি রঙের
মিস্ত্রিকে ডাকতে।
পরের এক সপ্তাহ্
জিনিসপত্র সরিয়ে ঘরের
রঙ পাল্টে ফেলি। ধূসর
নীল। স্পিক্জের পালকের
মত। শেষদিন রঙের
মিস্ত্রিকে টাকা
দিচ্ছি হঠাৎ অদ্রিশের
ফোন। প্রমোশনের অর্ডার
হয়ে গেছে। সকালে
সার্কুলেশন হবে। আমার
সব কেমন অলৌকিক মনে হয়।
পালকটা বার করি। প্রথম
দিনের মতই শিহরন খেলে
যায় শরীরে। বাড়ি ফিরলে
অদ্রিশকে মনে করাই সেই
‘রঙ পাল্টালেই মুশকিল
আসান’ বাণী। অদ্রিশ হো
হো হাসে, ‘ঝড়ে কাউয়া মরে
আর ফকিরের কেরামতি
ফলে’।
অদ্রিশের প্রমোশনের
মিষ্টিটা নিয়ে আমি
নিজেই গিয়েছিলাম
তিনতলায়। কেমন যেন মনে
হলো অনন্যা আমাকে এড়াতে
চাইছেন। জানলাম ওঁর মা
আর খালা দুজনেই খুলনায়
গেছে বেড়াতে। সেদিনের
পরে আমি আর অনন্যার
সাথে যোগাযোগ করিনি।
আমাদের জীবনও ক্রমশ
ব্যস্ত হয়ে যায়। একদিন
হঠাৎ মিনতির কাছে শুনি
অনন্যারা ফ্ল্যাট
বিক্রি করে বিদেশে পাড়ি
দিয়েছেন। কী আশ্চর্য
একটু জানিয়ে যাওয়ার
সৌজন্য দেখালো না!
পাঁচ বছর আগের সেই ঘটনা
ক্রমে ফিকে হয়ে অনেক
ঘটনার নিচে চাপা
পড়েছিল। পাঁচ বছর পরে
সেদিন বাবার নিচ তলায়
ছবিটা দেখে সেই সকালটা
আবার উসকালো। এই ছবির
সবাই মায়ের চেনা কেবল
মেয়েটাকে মা চিনতে
পারলো না। মা ভরসা দিল
বড়মামা জানতে পারে। ছবি
তো বড় মামাই লাগিয়েছে।
অদ্বয়, কুনাল তখন
‘ব্যোমকেশ বক্সী’!
আমেরিকার সময় মিলিয়ে
দেখে মামার রাত দুটো।
মামার স্কাইপ অফ। তাও
ওদের বুদ্ধিতে ছবিটা
পাঠিয়ে মেসেজ করি
মামাকে। বিকেলেই মামা
ফোন দেয়। মামাও সবাইকে
চেনে কেবল পাখি কোলে
মেয়েটা ছাড়া। তবে
অসুবিধা নেই পিসিমাকে
জিজ্ঞেস করে জানা
যাবেই। পিসিমার স্মৃতি
এখনো টনটনে। মামা সবার
সাথে যোগাযোগ রাখে।
পিসিমা থাকেন মায়ের সেই
গান্ধিবাদী ছোটকাকার
ছেলের কাছে, ধানবাদে।
ফোন নম্বর দেন বড়মামা।
আমাদের সাথে যোগাযোগ
নেই হঠাৎ ফোন করে ছবির
কথা জিজ্ঞেস করতে কেমন
সংকোচ হয়। তাও লজ্জা
ঝেড়ে দু’দিন পরে ফোন
করি আমি। বুড়ি পিসিমা
কিছুই শুনতে পান না।
আমরা কথা বলি মায়ের
খুড়তুতো ভাইয়ের সাথে।
মামা আগেই বলে রেখেছিল।
ছবিটা পাঠাবার উপায় নেই
তাই মুখে মুখেই বর্ণনা
করি। তিনি আশ্বাস দেন
পিসিমা’র সাথে কথা বলে
জানাবেন। আমরা ঢাকায়
ফিরি। একটা ফোনের
অপেক্ষায় আমি কান খাড়া
করে থাকি রাতদিন। প্রায়
দু’ সপ্তাহ পরে খুব
ভোরে তারস্বরে ল্যান্ড
ফোন বাজে। বড় মামা।
গলায় উত্তেজনা।
মেয়েটার কথা মনে পড়েছে
পিসিমার। খুলনায়
বড়দাদুর পোস্টিং ছিল।
এরা প্রতিবেশি পরিবার।
মেয়েটা পিসিমা’র
ন্যাওটা ছিল। পোলিওতে
মারা যায়। নীল টিয়ে ছিল
একটা। মেয়েটা যেদিন
মারা গেল সেই বিকেলে
টিয়েটাও মারা যায়।
কিন্তু ওর নাম কী
পিসিমা কিছুতেই মনে
করতে পারেননি।
ফোনটা রেখে চুপ করে বসে
থাকি। কানের কাছে
ফিসফিসিয়ে কেউ বলে
‘অজিতা বসু’ ।
------------------------------------------------------------
-----