এখন- শব্দের সঙ্গে
শব্দের সংঘর্ষ হবে।
চমকাবে বিদ্যুৎ।
তারপর...
লোকটা তারপর বিস্ফোরণে
উন্মুখ একটা বাউন্সিং
মাইনের ওপর পড়ে যায় আর
আমি কাগজে লিখি-
পুনরুত্থান। তারপর
লিখি- একলব্য, আর আমি
সমুদ্রকে ডাকি।
হঠাৎ মনে পড়ে ওয়াটার
মিল পার্কের সেই কাঠের
বেঞ্চটার কথা, আহা, যদি
একটু গিয়ে বসা যেত এখন,
জুলিয়েট যদি তার
কুকুরগুলিকে নিয়ে
বেরিয়ে আসত, এই ঘনায়মান
সন্ধ্যায়, ক্রমশই ঘন
হয়ে আসতে থাকা
অন্ধকারে... রুমা'দি,
অন্ধকার তোমার ভাল
লাগে? আচমকা প্রশ্নটি
মাথায় আসতেই
মেসেঞ্জারে লিখে ফেলি,
আর খোলা জানালা দিয়ে
বাইরে তাকাই। নিঃসঙ্গ
লাগে। বুঝলি রঞ্জু। এই
যে বৃষ্টি পড়ছে, এই যে
তুমুল বৃষ্টি নেমেছে,
এই যে সমুদ্রকে ছুঁতে
চাওয়া উন্মাদ বৃষ্টি
পড়ছে... ঠিক এইসব অদ্ভুত
সময়ে কেন জানি বুকটা খা
খা করতে থাকে... নিজেকে
করা অন্ধকার বিষয়ক
প্রশ্নের উত্তরের
অপেক্ষা করছি, করছি আর
ঠিক তখনি বিবিসি'র
আপডেট- লন্ডন ব্রিজে
সন্ত্রাসী হামলা... নিহত
ছয়... আরও বাড়তে পারে।
পরিচয় জানতে চেষ্টা
চালাচ্ছে পুলিশ। এখন
টিভি খুললে দেখা যাবে
পুরো লন্ডন ব্রিজ
এলাকায় হাজারে হাজারে
পুলিশ আর আতঙ্কিত
মানুষের মুখ...
স্নায়ু অবশ হয়ে যায়।
তার মানে? বিচিত্র
মানুষের এই নগরীও আর
নিরাপদ নেই। তার মানে
পরস্পর অবিশ্বাস,
হিংসা, খুন... লাল রঙের
পলিটিক্স। রুমা'দি
উত্তরে লিখেছে- হ্যাঁ,
নিজেকে যাচাই করে
দেখেছি, আলো ঝলমলে
পরিবেশের চেয়ে রহস্যময়
অন্ধকারই বেশি ভাল
লাগে...
শনিবার রাত শেষ হলো।
আবার রবিবার। বুঝলি
রঞ্জু। আজ কাজ শেষে
সিঁড়ি ভেঙে উপড়ে উঠছি
যখন, রুমা'দিকে মনে পড়ে
গেল, তোর কথাও; মানে এক
সঙ্গে দুজনের কথা।
নিজের জন্য তৈরি হয়ে
থাকা এক লোনলি-লগ্ন
আকাঙ্ক্ষিত ছিল তোর।
রঞ্জু। রঞ্জু রে। আমরা
কী অদ্ভুতভাবেই না
মেমরি-মর্মরিত! আম্মার
ঘরে কী ফেলে এসেছিলি
তুই? আমরা আম্মার ঘরে কী
ফেলে আসি?
এই প্রশ্নের উত্তর আমিও
খুঁজি। কিছু একটা ফেলে
যে এসেছি সেটা বুঝতে
পারি কিন্তু সেটা কী শত
চেষ্টাতেও মনে করতে
পারি না। কী ফেলে আসি
আমরা...
... তবু, বৃষ্টি পড়ে।
বৃষ্টি। আমি ভেতরের
অন্ধকার থেকে বাইরের
দিকে তাকিয়ে থাকি,
তৃষ্ণার্ত চোখে। একটা
গল্পের লাইন মনে পড়ে
রঞ্জু। এই মনোরম
মনোটোনাস শহরে অনেকদিন
পর আজ সুন্দর বৃষ্টি
হলো... নিরুদ্দেশ যাত্রা
গল্পের শুরুর লাইন। তোর
মনে আছে? নিজের জন্য
একটা লোনলি-লগ্ন খুঁজতে
খুঁজতে তুই তো শেষ
পর্যন্ত হারিয়েই
গিয়েছিলি!
আমি পাশের রুমে গিয়ে
টিভি ছাড়ি। হ্যাঁ, অনেক
পুলিশ। গিজগিজ করছে। এ
পর্যন্ত সাতজন মারা
গেছে, পুলিশ নিশ্চিত
করেছে। আরও লাশ পাওয়া
যাবে। হয়তো টেমসে পড়ে
ভেসে গেছে লাশ।
ম্যানচেস্টারে
আরিয়ানা গ্র্যান্ডির
কনসার্টের ভয়ানক
হামলার পর এবার লন্ডন।
কী হচ্ছে এসব? এবার
সত্যি সত্যি তাহলে হেইট
ক্রাইম বাড়বে। পরিচয় আর
শুধু মানুষ নয় পরিচয়
এবার গাঁয়ের রঙে,
ধর্মে। ইভলিনের কথা মনে
পড়ছে। মনে পড়ছে
অন্ধকারে ডুবে যাওয়া
ওয়াটার মিল পার্কের সেই
নিঃসঙ্গ বেঞ্চটার কথা।
ইভলিনের কুকুরগুলি
লীলাচঞ্চল, খ্যাপাটে আর
আমার অন্তর্গত তৃষ্ণা...
চোখ বন্ধ করে ফেলি। নো
ম্যান'স ল্যান্ডের
শুরুর দিকের সংলাপগুলি
হুবহু মনে পড়ে যায়।
তারপর...
আর কিছুক্ষণ পর একটা
বাউন্সিং মাইনের ওপর
পড়ে যাবে এক আহত সৈনিক!
আমাদের চোখের সামনে সেই
দৃশ্য ঘুরতে থাকবে।
ঘুরতে শুরু করবে।
দৃশ্যের জন্ম হয়। জন্ম
হতে শুরু করে।
সৈনিকটিকে এখানেই মরতে
হবে। মাইনের স্প্রিং
তাঁর শরীরের ভারে নিচে
দেবে গেছে। এখন নড়লেই
মৃত্যু। মাইনের
স্প্রিঙের ওপর থেকে ভর
সরে গেলেই ভয়ানক
বিস্ফোরণে চারপাশ
মুহূর্তে উড়ে যাবে।
ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়ার
সামনে মানুষ কত তুচ্ছ
হয়ে যায়! পৃথিবী কয়েক
কিলোমিটার জ্বলে যাবে!
তাতে কী!!
আমি একলব্য কে ডাকি।
স্মরণ করি পুনরুত্থান।
আমি সমুদ্রকে ডাকি। সময়
যেন মাতৃগর্ভ। মাটি
ফুঁড়ে আকাশের সমান উঁচু
হয়ে যায়। চোখের সামনেই
ঘটতে থাকে, যেন এক লীলা।
মায়ের পবিত্র দুধ নদীর
অন্ধকারের সঙ্গে মিশে
যেতে থাকে। অদ্ভুত সব
ঘুম ভাঙানিয়া পাখি উড়তে
শুরু করে... ডাইরি তে
কথাগুলি লিখে সিগারেট
ধরাই। ওয়াটার মিল
পার্কের এই নিঃসঙ্গতা
যেন একটা কালো পাখি।
জানি না আমার কি যে হয়।
সিগারেটটাকে দু আঙুলে
চেপে ধরে আবারও লিখতে
শুরু করি-
একলব্য।
পুনরুত্থান।
আমি সমুদ্রকে ডাকছি...
সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। আমি
আর অপেক্ষা করতে
পারছিলাম না। কিন্তু ওই
লোকটা, ওই সারবিয়ান
সৈনিকটি... গোলা বারুদে
বিশেষজ্ঞ দল ফিরে গেছে।
জাতিসংঘ ব্যর্থ তাঁকে
বাঁচাতে। আমার শরীর
থরথরিয়ে কাঁপতে শুরু
করে।
না, আমি এখানে একা আসিনি;
আরও দু'জন আছেন। একজন
আন্দ্রেই। বুড়ো।
উন্মাদ। আর একজন-
ভবঘুরে। হতাশ।
ক্রুদ্ধ।
ভার্জিনিয়া উলফ মগজের
একেবারে ভিতরে ঢুকে
খামছা মেরে ধরে বলতে
থাকেন-
জাঁক-জমক, পাতার
উজ্জ্বলাভা;
সমুদ্রস্রোতে ডুবতে
ডুবতে আর ভাসতে ভাসতে
এককোণে জড়ো হওয়া, গতির
বিপরীতে উড়ে-চলা,
রূপালি আলোর হঠাৎ
বিচ্ছুরণ, ঘর কিংবা
নিরাশ্রয়; সমষ্টি,
বিচ্ছিন্নতা, বিভিন্ন
মাত্রার অপব্যয়; উপরকে
মুছে ফেলা আর নিচকে দলা
পাকিয়ে ছিন্নভিন্ন করা;
অতঃপর ডুবিয়ে
দেয়া--তাহলে এইসবই
সম্মিলিতভাবে সত্য?
তারপর...
আমাদের ঘুম। আমাদের
ঘুমিয়ে পড়তে হবে।
আমাদের ক্লান্ত নিউরন।
আমাদের অক্লান্ত
স্মৃতিকোষ। হঠাৎ বাইরে
তুমুল হট্টগোল।
উন্মাদের চিৎকার।
জানালা খুলে দিলাম।
কী বলছে এই লোকটা! কে সে?
...মানুষ, ডেকে ডেকে বলছি,
শোনো
পৃথিবীকে যদি এগিয়ে
নিতে চাও, তাহলে অবশ্যই
আমাদেরকে
পরস্পরের হাত আঁকড়ে
ধরতে হবে
আজ কেবল শয়তানই রাজত্ব
করছে
মহান ব্যক্তিদের কেউই
আর বেঁচে নেই
কেউ একজন অবশ্যই
চিৎকারের প্রতিধ্বনি
তুলবে এই বলে যে
আমরা পিরামিড গড়তে
চলেছি
এমনকি, আমরা যদি তা না-ও
করি, তাহলেও
আমাদেরকে অবশ্যই
আমাদের
আকাঙ্ক্ষাগুলিকে লালন
করতে হবে
মানুষের চোখগুলি
অনিমেষ তাকিয়ে আছে
গিরিখাতের দিকে
মানব কল্যাণ এখন
নীতিকথা শোনাচ্ছে-
আমাদের স্বাধীনতার
প্রয়োজন নেই...
যদি তুমি কখনও সেটা
দেখবার মত আত্মবিশ্বাস
খুঁজে পাও
আমাদের চোখের গভীরে,
দেখবে-
তারা সব তথাকথিত সুস্থ
মানুষ, ভিড় করে আছে
যারা নেতৃত্ব দিচ্ছে
আকস্মিক বিপর্যয়ে
ধ্বংসের প্রান্তসীমায়
পৌঁছুনো পৃথিবীকে
মহান কল্যাণের দিন শেষ
টিকে আছে ছোটখাটো কিছু
ভাল জিনিস
সমাজকে আবারও একসঙ্গে
দাঁড়িয়ে যেতে হবে
আর বন্ধ করতে হবে
বিচ্ছিন্নকরণ
প্রকৃতিকে হৃদয়ে ধারণ
করতে হবে তাঁর-
সমগ্রতায়
যাতে উপলব্ধি করা যায়-
জীবন খুব সরল আর
সাধারণ
এবং, আমাদেরকে অবশ্যই
সেই ময়দানে ফিরে যেতে
হবে
পথ হারিয়ে ঠিক কোথা
থেকে তুমি ভুল গন্তব্যে
ছুটছ?
আমাদেরকে অবশ্যই
জীবনের উৎসভূমির কাছে
ফিরতে হবে জলকে ঘোলা না
করে
এ আবার কী ধরনের
বিশ্ব...
এখন তাকে কি তুমি
উন্মাদ আখ্যা দেবে যে
তোমাকে বলছে :
নিজেদের নিয়ে তোমরা
নিজেরা লজ্জিত হও!
এবং এখন,
বাদ্যযন্ত্রগুলি বেজে
উঠুক...
আমাদেরকে অবশ্যই
জীবনের উৎসভূমির কাছে
ফিরতে হবে জলকে ঘোলা না
করে
আমাদেরকে অবশ্যই
জীবনের উৎসভূমির কাছে
ফিরতে হবে জলকে ঘোলা না
করে
আমাদেরকে অবশ্যই
জীবনের উৎসভূমির কাছে
ফিরতে হবে জলকে ঘোলা না
করে
... উন্মাদের চিৎকার
থামছে না।
আমার সৈন্যরা উড়ে
যাচ্ছে;
গ্যুটেনবার্গের
সৈন্যরা। ক্রমশ ঘন হয়ে
নামতে থাকা অন্ধকারের
দিকে... আজ শরীর কেঁপে
উঠল- স্মৃতি ও গল্পের
কথাগুলির অভিঘাতে।
দ্রুত, খুব দ্রুত খুঁজে
খুঁজে বের করলাম উলফের
'বাতিঘরের দিকে'। এই
উপন্যাসের শেষ দিকের
কিছু কথা এখন এই অস্থির
সময়ে পড়ে ফেলা যাক।
হ্যামশায়ারের রাত শেষ
হচ্ছে। এখনই ঘুমিয়ে
পড়তে হবে। তার আগেই পড়ে
ফেলতে হবে বাতিঘরের শেষ
পাতার কথাগুলি...
তারপর?
মুখের একটা আদল।
শিশুটি জলে ডুবে আছে।
কতটুকু জল। কতটুকু
আশ্রয়! এই পৃথিবী কি
তাঁর সন্তানদের জন্য
নিজেকে উন্মুক্ত করে
রাখেনি?
মুখ আর জল। মরে গেছে
বাচ্চাটি।
এবার মাটি তাকে খাবে।
ভবঘুরে লোকটি হতভম্ব।
ভূমিপুত্রেরা মাটি
খুঁড়ে গভীর গর্ত
বানাচ্ছে।
গর্তে লুকিয়ে রাখবে
তাঁদের পূর্বপুরুষের
হাড়।
সেই উন্মাদ হাঁটছে।
অন্ধকার।
ক্রমশ ঘন হয়ে নামতে
থাকা অন্ধকারে একটি
শিশুর মৃত দেহ।
কেউ গান গাইছে- জানলার
কাচে বাতাস ধাক্কা
দিচ্ছে... একটি চড়ুই
এক্কা দোক্কা খেলছে।
মৃত দেহ জলে। মাটি এবার
খাবে। হে আমার
বিস্মৃতি। হে কাগজের
নৌকো। পলকা।
ও সাগর। সাগরের ঢেউ হে।
ও সাবমেরিন। আত্মারা
ফিরে আসছে। থিংস ফল
অ্যাপার্ট। থিংস ফল
অ্যাপার্ট। থিংস ফল
অ্যাপার্ট। থিংস ফল...
একটি হলদে রঙের
প্রকাপতির চক্কর।
বিলুপ্তির থেকে উদ্ধার
করা একটা মুখ। আমি শেষ
দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে
থাকি। কলিঙ্গ যুদ্ধ
শেষে অখণ্ড ভারত
নির্মাণের স্বপ্নে
বিভোর সম্রাট অশোক-
স্তব্ধ। এত মৃত্যু কি
চেয়েছিলেন তিনি? এত
বিসর্জন। কলিঙ্গ আজ
মহাশ্মশান। নদীর কিনার
ধরে হেঁটে যাচ্ছেন ভারত
সম্রাট অশোক! হায়...
আর এক আলোর খেলা। আর
শুধু রঙ। রঙের আলোয়
দাঁড়িয়ে থাকলে তুমি।
বাঁচতে ভুলে গেলে...
এবার বাজো তুমি বেহালা,
একা একা। বাদকেরা সব
অস্ত্র কারখানায়- কাজে।
বেহালা বাজবে এবার। একা
একা। একা একাই আমরা
গাইতে থাকব গান। আর
শুনব পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ
একজন মানুষের আর্তি...
ধীরে ধীরে, মঞ্চের দিকে
এগিয়ে যাচ্ছে চার্লি
চ্যাপলিন। দ্য গ্রেট
ডিক্টেটর। জীবনের শেষ
ভাষণটি দিতে চলেছেন
তিনি-
['দ্য গ্রেট ডিক্টেটর',
চার্লি চ্যাপলিনের
প্রথম সবাক চলচ্চিত্র,
নির্মিত হয়েছিল ১৯৪০
সালে, ছবিটি আখ্যায়িত
হয় নাৎসিবাদের
বিরুদ্ধে প্রবল
প্রতিবাদী ছবি হিসেবে।
মূলত স্যাটায়ার।
চ্যাপলিনের
স্যাটায়ারের লক্ষ্যে
পরিণত হন জার্মান
একনায়ক হিটলার। এই
ছবিটির আগের, অর্থাৎ,
তার সেই নির্বাক
ছবিগুলিতে ছিল
দারিদ্র্যপীড়িত
ভবঘুরেদের হতাশা,
দুর্দশা, গ্রেফতারবরণ,
জেল, পুলিশের সঙ্গে
লুকোচুরি, ঠাট্টা,
হাস্যরস, বিদ্রুপ। এক
কথায়- পুরোটাই
স্যাটায়ার। তবে,
ছবিগুলোতে রাজনৈতিক
বক্তব্য তেমন একটা ছিল
না।
অনূদিত লেখাটি
চ্যাপলিন অভিনীত
বিখ্যাত ছবি ‘দ্য গ্রেট
ডিক্টেটর’-এর একদম
শেষের দৃশ্য; যা মূলত
একটা ভাষণ; আর সেই
ভাষণটি ছিল মানুষ
হিসেবে আমাদের যে
জীবনটিকে যাপন করার কথা
ছিল আমরা যেন সেই
জীবনের পটভূমিতে এসে
দাঁড়াই- তার আহ্বান।
জীবনের মৌল ভিত্তিটিকে
খুঁজে বের করার এক অমোঘ
আহ্বান ছিল চ্যাপলিনের
সেই ভাষণটিতে।]
............................
আমি অত্যন্ত ব্যথিত
হয়েই বলছি, না, আমি এখানে
সম্রাট হতে আসিনি, আর
এটা আমার অভিপ্রায়ও নয়।
আমি কাউকে শাসনের ইচ্ছা
পোষণ করি না কিংবা
ক্ষমতাবলে কাউকে আমার
আজ্ঞাবহও করতে চাই না।
আমি আমার সাধ্যমতো সবার
পাশে দাঁড়াতে চাই, সে
ইহুদি হোক কিংবা অন্য
জাতের- শাদা কিংবা কালো
মানুষ। আমরা তো
প্রত্যেকেই
প্রত্যেকের পাশে
দাঁড়াতে চাই। এই
দাঁড়াতে চাওয়াটাই
হচ্ছে প্রকৃত মানুষের
পরিচয়। মানুষ তো ঠিক
এরকম একটা জীবনকেই যাপন
করবে। আমরা পরস্পরের
আনন্দের জন্যই বেঁচে
থাকব, কারও শোচনীয়
দুর্গতিতে নয়। আমরা আর
কাউকেই ঘৃণা করতে চাই
না, আর, হ্যাঁ, আমরা আর
কাউকে অবজ্ঞা কিংবা
উপহাসও করব না। এই
পৃথিবী তার সন্তানদের
জন্য এক বিশাল আশ্রয়, এই
মাটিপৃথিবীর
উর্বরাশক্তিও অনেক
বেশি। সে তার সন্তানদের
জন্য অফুরন্ত
প্রাণশক্তি নিয়ে
অপেক্ষা করে, আর সে
নিজেকে উন্মুক্ত করে
রেখেছে সকলের জন্য।
জীবনকে যাপনের
পন্থাগুলি আমাদের জন্য
কী মুক্তই না ছিল, আর কী
সৌন্দর্যময়; কিন্তু
আমরা, সেই সুন্দর মুক্ত
পথগুলি হারিয়ে
বিলুপ্তির স্মৃতিতে
ভুগছি।
লোভ আর লালসা মানুষের
আত্মাকে বিষিয়ে
ফেলেছে। পরস্পরের
প্রতি আমাদের ঘৃণা এই
পৃথিবীতে স্থানে
স্থানে ব্যারিকেড তৈরি
করেছে, জন্ম দিয়েছে এমন
এক অসাম্য অবস্থার, যার
কারণে আজ আমরা পতিত
হয়েছি দুর্দশায়, মেতে
উঠেছি নিজেরাই নিজেদের
বিরুদ্ধে খুনোখুনিতে।
হ্যাঁ, আমরা গতির
অভাবনীয় বিকাশ ঘটাতে
সক্ষম হয়েছি কিন্তু
আমরাই আমাদেরকে প্রতি
পদে অবরুদ্ধ করে
রেখেছি। আমাদের বানানো
যন্ত্রপাতিগুলি কোথায়
আমাদেরকে ঐশ্বর্যশালী
করবে, তা না, তারা যেন
তাদের সেই উদ্দেশ্যই
হারিয়ে ফেলছে। আমাদের
অর্জিত জ্ঞান
আমাদেরকেই করে ফেলছে
নৈরাশ্যবাদী। আমরা
নিজেরাই নিজেদের সঙ্গে
চালাকি করছি, যা হয়ে
যাচ্ছে কঠিন আর নির্দয়।
আমরা ভাবছি অনেক বেশি
কিন্তু দিনে দিনে আমরা
যেন আমাদের অনুভূতি আর
স্পর্শকাতরতা হারিয়ে
ফেলছি। ভাবনাগুলিকে
আমরা হৃদয়ে অনুভব করছি
না। যন্ত্রপাতির
কৃতকৌশলের চেয়েও এখন
জরুরি হলো মানবতার
জয়যাত্রা। চালাকি আর
চাতুরীর চেয়েও আমাদের
জন্য উদারতা এবং
সুহৃদয়তা জরুরি। আজকের
দিনে এই বিষয়গুলি ছাড়া
আমাদের জীবন হয়ে পড়বে
সহিংস, আর তাতে
মানবজাতি হানাহানিতে
মত্ত হয়ে বিলুপ্তই হয়ে
যাবে।
উড়োজাহাজ এবং
বেতারতরঙ্গ আমাদের
মধ্যকার দূরত্ব কমিয়ে
কাছাকাছি নিয়ে এসেছে।
এই আশ্চর্য
আবিষ্কারগুলি মানুষের
কল্যাণের জন্য যেন
উচ্চকণ্ঠে আহ্বান করছে,
বিশ্বভ্রাতৃত্বের
জন্য মুখর হয়ে উঠেছে-
আমরা যেন একে অন্যের
হাতে হাত রেখে ঐক্যবদ্ধ
হই। এই এখনই আমার কণ্ঠ
তরঙ্গায়িত হয়ে কয়েক
মিলিয়ন মানুষের কাছে
পৌঁছে যাচ্ছে, হ্যাঁ,
মিলিয়ন মিলিয়ন নারী,
পুরুষ এবং ছোট্ট
শিশুদের কাছে, যারা
ইতোমধ্যেই গভীর হতাশায়
নিমজ্জিত, যারা একটি
ব্যবস্থার ভিকটিমে
পরিণত হয়েছে, সেই
ব্যবস্থা- মানুষকে যা
নির্যাতন করছে।
নিরাপরাধ মানুষ আজ
কয়েদখানায় বন্দি।
হ্যাঁ, আমি তাদেরকেই
বলছি, এই মুহূর্তে আমার
কথা যারা শুনছেন- আর
হতাশা নয়। একদিন সমস্ত
ঘৃণার অবসান হবে।
মানুষের লোভ আর লালসার
মানসিকতায় পরিবর্তন
আসবে। মানুষ আজ যে
দুর্দশাগ্রস্ত
অবস্থার ভিতর দিয়ে
যাচ্ছে, যে লোভ, যে লালসা
তার আত্মাকে আকীর্ণ করে
রেখেছে, কলুষিত করেছে,
এসব মানুষেরই তিক্ত
অভিজ্ঞতার এক সমন্বয় আর
এ কারণেই আমরা আজ
মানবতার আগ্রগতি
সম্পর্কে ভীত,
সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছি।
মানুষ এখন ঘৃণা করতে
ভুলে যাবে আর ভুলে
যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে
পৃথিবীর একনায়কদেরও
মৃত্যু হবে। একনায়কেরা
যে-ক্ষমতাটি জনতার কাছ
থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল,
সেই ক্ষমতা আবারও জনতার
হাতে ফিরে আসবে।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আর
কেউই তার স্বাধীনতা
কেড়ে নিবে না।
সৈনিকগণ! নিজেদেরকে
পাশবিক শক্তির কাছে
বিকিয়ে দিও না, যারা
তোমাদেরকে-
তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে;
যারা তোমাদেরকে
ক্রীতদাসে পরিণত করে,
তোমাদেরকে দিয়ে
রেজিমেন্ট গড়ে তোলে;
তোমাদেরকে বলে দেয়-
তোমরা কী করবে, কী
চিন্তা করবে, কী অনুভব
করবে! তোমাদেরকে দিয়ে
তারা কুচকাওয়াজ করায়,
এমনকি তারা তোমাদের
খাদ্যও নির্দিষ্ট করে
দেয়, তোমাদেরকে
গৃহপালিত পশুর মতো গণ্য
করে আর মনে করে- তোমরা
হলে যুদ্ধের ময়দানে
তুচ্ছ, অপচয়যোগ্য এক
একজন সৈনিক। এসব
অপ্রকৃতস্থ বন্য
লোকদের কাছে নিজেদেরকে
সঁপে দিও না; তারা এখন
যন্ত্রের মানুষ, তাঁদের
মন ও হৃদয় এখন যন্ত্রের
দখলে। কিন্তু তোমরা তো
যন্ত্রও নও, গৃহপালিত
পশুও নও- মানুষ। এখনও
মানুষের জন্য তোমাদের
হৃদয়ে প্রেম আছে! তোমরা
কখনওই কাউকে ঘৃণা করো
না। ঘৃণা করবে তারাই
যারা ভালোবাসা থেকে
বঞ্চিত ছিল, এবং যারা
অপ্রকৃতিস্থ। সৈনিকগণ!
দাসত্বের জন্য আর যুদ্ধ
করো না। যুদ্ধ হোক
মুক্তির।
সন্ত লুক-এর সপ্তদশ
অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ আছে-
ঈশ্বরের দেশ আর কোথাও
নয়, মানুষের ভিতর। সেই
মানুষ কোনও একজন বিশেষ
মানুষ নয়, বিশেষ কোনও
গোষ্ঠীও নয়, সেই মানুষ-
সম্মিলিত মানুষ। সকল
মানুষ। তোমার ভিতরে।
তোমাদের সকলের ভিতরে।
তোমরা। তোমরাই সেই জনতা
যাদের আছে এক আশ্চর্য
ক্ষমতা, যে-ক্ষমতার
দ্বারা মানুষ
কলকারখানা গড়ে তোলে, আর
আছে সেই ক্ষমতা যার
মাধ্যমে মানুষ সুখী
হবার উপায়গুলিকে
আবিষ্কার করে। তোমরা তো
সেই মানুষ, যাদের আছে এই
জীবনটিকে মুক্ত আর
সৌন্দর্যময় করার
ক্ষমতা; আর সেই ক্ষমতা
যার মাধ্যমে এই
জীবনটিকে করে তোলা যায়
এক বিস্ময়কর
অভিযাত্রা।
তাহলে চলো, গণতন্ত্রের
নামে শপথ করে, এবার আমরা
সেই ক্ষমতাটিকে
ব্যবহার করি। তাহলে
চলো, আমরা সবাই
একতাবদ্ধ হই। নতুন এক
বিশ্ব গড়ে তুলতে যুদ্ধ
করি যে বিশ্ব হবে এমন এক
প্রীতিপূর্ণ বিশ্ব যে
মানুষকে কাজের সুযোগ
করে দেবে। তারুণ্যকে
দিবে একটা ভবিষ্যৎ আর
বয়স্কদের দেবে
নিরাপত্তা। আমাদেরকে
অবশ্যই মনে রাখতে হবে
যে এসব দেবার
প্রতিশ্রুতি দিয়েই
কিন্তু নির্দয় বন্য
লোকগুলি ক্ষমতায় আরোহণ
করেছিল, কিন্তু পরে
প্রতারণা করেছে, মিথ্যা
বলেছে। তারা কথা
রাখেনি, কথা রাখবেও না।
একনায়ক সমস্ত কিছুর
অধিরাজ হয়ে বসে আছে আর
জনতাকে করেছে
ক্রীতদাস। তাহলে চলো,
সেই প্রতিশ্রুতিগুলি
পূরণ করতে তৎপর হই।
বিশ্বকে মুক্ত করতে
যুদ্ধ করি। বাধা দেবার
দেয়ালগুলি ধ্বংস করি।
লোভ-লালসা আর
অসহিষ্ণুতার অবসান
করি। গড়ে তুলি এক
যৌক্তিক বিশ্ব যেখানে
মানুষের সকল আনন্দের
প্রধান উৎস হবে বিজ্ঞান
ও প্রগতি। সৈন্যগণ!
এসো। এক হই- জনতন্ত্রের
নামে।