মির্জা হাবিব
উল্লাহ্ ক্য’য়ানি
সিরাজি (১৮০৮-১৮৫৪)
মির্জা হাবিব উল্লাহ্
ক্য’য়ানি সিরাজি ১৯
শতকের ইরানের সব থেকে
দীপ্তিমান ও প্রসিদ্ধ
কবি। তাঁর প্রসিদ্ধি
ছিল তাঁর সুরেলা ছন্দের
কারণে। একজন ইরানি কবি
হিসাবে ইমাম হুসেইনের
উদ্দেশ্যে লেখা তাঁর
এলিজি ছিল সব থেকে
জনপ্রিয়। এই এলিজিটি
ইরানের মশহদে ইমাম আলি
রেজার পবিত্র সমাধির
গায়ে খোদাই করা রয়েছে।
যদিও ক্য’য়ানিকে
সর্বশেষ ক্লাসিকাল কবি
হিসাবে গণ্য করা হয়, এই
কবিতাটিতে কিন্তু তিনি
ব্যাখ্যামূলক ধ্রুপদী
ঘরানা থেকে সরে এসেছেন।
এখানে তিনি তাঁর প্রিয়
ইমামের প্রতি
সম্মানজ্ঞাপন করেছেন
প্রশ্নোত্তর বা
কথোপকথনের ভঙ্গিমায়।
এখানেই এই কবিতাটি এক
অদ্ভুত মাত্রা লাভ
করেছে, এক নতুনতর রূপ
লাভ করেছে। এখানেই
কবিতাটি হয়ে উঠেছে
স্বকীয়। উমাইয়েদ
বাহিনীর হাতে নবীর
প্রিয় পৌত্রের শহীদ
হওয়ার ঘটনার সাথে যুক্ত
নাটকীয়তা ও গভীর
ভাবাবেগকে এই
কথোপকথনের আশ্চর্য
ভঙ্গিমার মাধ্যমে
অপূর্বরূপে চিত্রিত
করে তুলেছেন কবি।
কবিতাটির প্রায় একই
ছন্দের ও প্রকারের
প্রশ্নোত্তর ধরন
কবিতাটিকে খানিক
যান্ত্রিক করে তুলেছে
হয়তো বা। অনুবাদের সময়
সেই যান্ত্রিকতাকে
যতটা সম্ভব মুছে ফেলার
চেষ্টা করা হয়েছে। এর
কাব্যময়তাকেও যতটা
সম্ভব অটুট রাখার
চেষ্টা করা হয়েছে। তার
সাথে কবিতাটির গতিশীল
ছন্দকেও ধরার
প্রচেষ্টা হয়েছে। এই
সবকিছু করতে গিয়ে খানিক
স্বাধীনতা নিতে হয়েছে।
আক্ষরিক অনুবাদ থেকে
ভাবানুবাদে বেশী
ঝুঁকতে হয়েছে। তবে,
কবিতাটির সাথে যুক্ত
বিষাদের সুরকে যতটা
সম্ভব তুলে ধরাই আমার
মূল উদ্দেশ্য এখানে।
তার সাথে আমার
ব্যক্তিগত
শ্রদ্ধাজ্ঞাপনও। শহীদ
ইমাম হুসেইনের প্রতি,
ক্য’য়ানির প্রতি, এবং
তাঁর কবিতার প্রতি।
******************
অঝরে কি ঝরে? রক্ত!
কে? সেই চোখ!
কেমন করে? দিন রাত।
কেন? শোকের কারণে।
কিসের শোক?
কারবালার রাজার শোক।
কি তার নাম? হুসেইন!
জন্ম কোন কুলে?
আলিদের।
তার মা কে? ফাতিমা।
তার পিতামহ? মুস্তাফা।
তার কি হল? তিনি শহীদ
হন!
কোথায়? মারিয়া বা
কারবালার মাটিতে।
কবে? মহরমের দশম দিনে।
একান্তে? না, জনসমক্ষে!
আঁধারে তার মৃত্যু আসে?
না, দিবালোকে!
কোন সময়? মধ্যাহ্নে!
তার কণ্ঠনালী
বিচ্ছিন্ন হয়? না,
স্কন্ধ থেকে বিচ্ছিন্ন
হয়।
মৃত্যু আসে তৃষাহীন
অবস্থায়? না।
কেউ তাকে তৃপ্ত করে নি?
করেছে।
কে? শিম্র!
কোন ঝর্না হতে? মৃত্যুর
ঝর্না।
সে কি এক নিষ্পাপ শহীদ?
হ্যাঁ!
তার কোন অপরাধ ছিল? না।
তার কাজ কি ছিল?
পথপ্রদর্শন!
তার বন্ধু কে? ভগবান!
এই পাপ করল কে? য়াজিদ।
য়াজিদ কে? হিন্দের এক
সন্তান।
সে নিজে করেছে এই কাজ?
না, সে একটি চিঠি
পাঠায়।
কাকে? মারজানার
মিথ্যাচারী পুত্রকে।
মারজানার পুত্র কি
ইবন্-এ-জিয়াদ? হ্যাঁ!
সে অমান্য করে য়াজিদকে?
না!
এই পাপিষ্ঠ স্বহস্তে
মৃত্যু দেয় হুসেইনকে?
না, সে কারবালায়
সৈন্যদল পাঠায়।
তাদের সেনাপতি কে ছিল?
উমর ইবন্ সাদ।
সেই কি ফাতিমার
প্রিয়জনের মৃত্যুদূত?
না, নির্লজ্জ শিম্র।
তার শিরশ্ছেদে তরবারি
কেঁপে ওঠেনি লজ্জায়?
কেঁপে উঠেছিল।
তবে কেন সে রোখে নি
নিজেকে? অদৃষ্টে তাই
ছিল।
কেন? যাতে সে হয়ে ওঠে
মানবজাতির
মধ্যস্থতাকারী!
তার মধ্যস্থতার কি
অবস্থা? বিলাপ ও
কান্না।
তার পুত্রও কি হয়েছে
বলি? হ্যাঁ, দুজন।
আর কে? নয় ভাই।
আর কে? আত্মীয়স্বজন।
তার কি কোন পুত্র ছিল না
আর? হ্যাঁ, ছিল।
সে কে? ‘পূজারী’
(সাজ্জাদ)।
সে এখন কেমন আছে?
দুঃখে-কষ্টে
নিমজ্জিত।
সে তার পিতৃভূমি
কারবালাতেই ছিল? না, সে
সিরিয়ায় গমন করে।
গৌরব ও সম্মানে? না,
অপমানে ও কষ্টে।
একা? না, তার পরিবারের
স্ত্রীলোকদের নিয়ে।
তাদের নাম কি ছিল?
জাইনাব, সাকিনা, ফাতিমা
এবং দুখী-দরিদ্র
কুলহুম।
তার বসন ছিল? হ্যাঁ,
রাস্তার ধুলো।
মাথায় পাগড়ী ছিল? হ্যাঁ,
শয়তানদের লাঠি!
সে কি অসুস্থ ছিল?
হ্যাঁ!
কি ওষুধ ছিল সাথে? তার
অশ্রুজল।
ওষুধের পরে আর কি আহার
ছিল? তার আহার ছিল বুকের
রক্ত।
কেউ কি তাকে সঙ্গ
দিয়েছিল? হ্যাঁ,
পিতৃহীন সন্তানেরা।
আর কে ছিল? জ্বর, যা তার
সঙ্গ ছাড়ে নি কখনো।
কি ছিল স্ত্রীলোকদের
অলঙ্কার? দুটি বস্তু।
গলায় অত্যাচারের
গলাবন্ধ আর পায়ে
অপমানের পায়েল!
কোন অধার্মিক এত নৃশংস
হতে পারে? না।
কোন মেজাই বা ইহুদী? না।
কোন হিন্দু? না।
কোন মূর্তিপূজারী? না।
হায়! কি নিষ্ঠুরতা!
ক্য’য়ানি কি এই রচনায়
পটু? হ্যাঁ!
তার যাচনা কি? মার্জনা!
কার কাছে? ঈশ্বরের
কাছে।
কখন? দেনাপাওনার
অবশেষে।