প্রত্যেকটি মুহূর্ত
আসবার পেছনে কোন না কোন
ঘটনা থাকে। মানুষ এর
সবকিছু জানতে পারে না,
হয়ত জানতে চায় না- আবার
হয়ত কিছু কিছু মানুষ
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে
সবকিছু জেনে নিতে চায়।
মুহূর্ত ধারণাটা
মানুষের মস্তিষ্কে
কীভাবে প্রবেশ করল তা
জানা নিশ্চয় একজন
গল্পকারের কাজ হতে পারে
না। একজন গল্পকার সময়কে
শব্দ বন্দী করার জন্য
মুহূর্তকে তাড়া করে।
আবার কখনও কখনও
মুহূর্তই গল্পকারের
পেছন পেছন হন্যে হয়ে
ছুটে বেড়ায়। আর
মানুষ’রা এসব থেকে একেক
ধরণের অভিজ্ঞতা আহরণ
করতে থাকে।
এই যে, এই মূহুর্তে
যাত্রা বিরতি। আমি বাস
থেকে নামব। আমার পেছন
পেছন নামবেন একজন নারী
। সদ্য জন্ম হওয়া
বাছুরকে দুগ্ধ পান
করানোর পরে একটা গাভীর
চেহারা যেমন সুন্দর হয়,
তেমনই অসাধারণ সুন্দর
একজন নারী। আশপাশের
মানুষ’রা এই মুহূর্তের
দিকে হঠাৎ তাদের মনোযোগ
নিক্ষেপ করবে। আমার
কয়েক ধাপ পেছনে পেছনে
হেঁটে আসতে থাকবেন
নারী। এমন সময় একজন শসা
বিক্রেতার আবির্ভাব
ঘটবে ‘মুহূর্ত-মঞ্চে’।
শসা বিক্রেতা আমার দিকে
তাকাবে এবং তার ইঙ্গিত
ছুঁড়ে মারবেন আমার পেছন
পেছন হেঁটে আসা নারীটির
দিকে। তিনি মনে মনে
ভাববেন, কেমন স্বামী
আমি? এক সাথে না হেঁটে
নিজের স্ত্রী-কে পেছনে
ঠেলে দিয়েছি? শসা
বিক্রয় করা থেকে তার
মনোযোগ উড়ে আসবে আমার
হীনমন্যতার দিকে। তবে
সেটা আমাকে ছুঁতে পারবে
না। একটা ইটের সাথে
হোঁচট খেয়ে তার সমস্ত
ইঙ্গিত ধুলোবালিতে
মাখামাখি হয়ে যাবে। আমি
ব্যাপারটা আগেই আঁচ
করতে পারব, কিন্তু কিছু
বলতে পারব না, আমার কাজ
মুহূর্তকে বন্ধী করা।
হাঁটতে হাঁটতে আমি
দাঁড়িয়ে যাব, আমার দেখা
প্রয়োজন, হোঁচট খেয়ে
সমস্ত ইঙ্গিত এবং শসা
সমেত হুমড়ি খেয়ে মাটিতে
পড়ে যাবার পর শসা
বিক্রেতার চেহারাটা
কেমন হবে দেখতে! আমার
নতুন কোন গল্পে ব্যবহার
করার জন্য দৃশ্যটা হয়ত
লিখে রাখা যেতে পারে
কিনা তা নিয়ে আমার ভেতর
যোগবিয়োগের ধারণা
হাসাহাসি করতে থাকল।
আমাদের পেছনে পেছন আরও
কিছু মানুষ নেমে আসবে।
এ সকল মানুষের অধিকাংশই
এগিয়ে যাবে স্নায়ুর
উত্তেজনায় পানি ঢালতে।
আমার পাশের সিটের বসা
মানুষটি স্নায়ুর
উত্তেজনায় পানি ঢালতে
গিয়ে তার প্যান্ট
ভিজিয়ে ফেলবেন।
প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলা
একজন মানুষ আমাদের সাথে
একই বাসে যাবেন এটা
জেনেও তাকে সাবধান করা
হবে না আমার। ভেজা
প্যান্ট এবং মানুষটির
কথা ভেবে খারাপ লাগা
ছাড়া আমার আর কিছু করার
থাকবে না। কিছু করার
থাকবে না এই জন্য যে, আমি
যদি বলতে যায় যে, আপনি
বাথরুম ব্যবহার করতে
গিয়ে প্যান্ট ভিজিয়ে
ফেলবেন তাহলে
মুহূর্ত-মঞ্চের
চরিত্রগুলো আমাকে
ভবিষ্যৎবক্তা ভাবা
আরম্ভ করবে। তারা আমার
সম্পর্কে এমনটা ভাবুক,
তা আমি কোনভাবেই চাইবো
না।
হাতমুখ ধুয়ে এসে এক কাপ
চায়ের নেশায় একটা
টেবিলে বসে পড়ব আমি। চা
আসার আগের সময়টুকুতে
আমি সেই নারীকে খুঁজব,
যাকে দেখতে- সদ্য জন্ম
দেওয়া বাছুরকে স্তন পান
করানোর পর অসাধারণ
চেহারার গাভীর মত মনে
হয়েছিল। তাকে দেখতে না
পেয়ে আমি কিছুটা
উদ্বিগ্ন হয়ে যাব।
নারীটি একজন মানুষের
সাথে বসে থাকবে, সবজী
দিয়ে পরোটা খাবে। আমি
ভাবব, পরোটা খাওয়া
নারীটির জন্য কোন ভাল
ফল বয়ে আনবে না, কারণ
নারীটি গর্ভবতী থাকবে।
নারীটিকে নিয়ে এত সব
ভাববার কারণ খোঁজার
চেষ্টায় ব্যস্ত থাকব?
মুহূর্ত-মঞ্চের
চরিত্রগুলোর উপর খুব
রাগ হবে আমার। একজন
গর্ভবতী নারীর স্ফীত
চেহারার দিকে এভাবে
তাকাতে হবে? তারা কি
জানে না, সেই শসা
বিক্রেতার শোচনীয়
অবস্থার কথা?
যে ছেলেটি আমার টেবিলে
চা সার্ভ করবে, মিনিট
দুয়েকের ভেতরে সে আচমকা
একটা থাপ্পড় খাবে। আমি
তার থাপ্পড় খাওয়াকে
ঠেকাতে পারবো না
কিছুতেই। থাপ্পড়টা
আমাকেই মারতে হবে, আমার
অনিচ্ছা সত্বেও।
হোটেলের একজন
কর্মচারীকে মাত্র এক
কাপ চা খাওয়া মামুলী
একজন ক্রেতা
অন্যায়ভাবে থাপ্পড়
মারবে, তা নিয়ে একটা
তুমুল উত্তেজনা দেখা
দেবে। কর্মচারীরা আমার
দিকে তেড়ে আসবে আমাকে
প্রতিশোধের কড়াইয়ে
নিক্ষেপ করার জন্য। আমি
ভেতরে ভেতরে মার খাওয়ার
প্রস্তুতি নিতে থাকব।
এসব করতে করতে আমাদের
বহন করা বাস পুনরায়
মহাসড়কে উঠতে কিছুটা
বেশি সময় নেবে। বাকি
যাত্রীরা আমার উপর
ক্ষেপে গিয়ে আমাকে রেখে
চলে যেতে চাইবে। বাসের
সমস্ত যাত্রীর মধ্যে
দুইজন যাত্রী আমার
প্রতি সহানুভূতিশীল
হবে, কিন্তু আমার প্রতি
তারা সেই সহানুভূতি
প্রকাশের সুযোগ পাবে
না। এদের একজন হলো
প্রস্রাব করতে গিয়ে
প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলা
মানুষটি, অন্যজন একটা
পুরো পৃথিবী গর্ভে নিয়ে
মুহূর্ত-মঞ্চের
নারীটি।
মুহূর্ত-মঞ্চের
চরিত্রগুলো আমাকে খুব
তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করবে,
কেউ কেউ গালাগাল দেবে,
কর্মচারীরা তখনও
মারমুখো থাকবে।
‘মুহূর্ত’ যখন ঘটতে
থাকবে, ঠিক তখনই
হোটেলের কিচেনের দিক
মুহূর্ত-মঞ্চে
আবির্ভাব ঘটবে অতীত তাল
গাছের মত একজন বয়োবৃদ্ধ
মেয়েমানুষের। তিনি
মুহূর্ত-মঞ্চে দাঁড়ানো
মাত্র আমি দৌড়ে গিয়ে
তার পা দুইটা জড়িয়ে
ধরব। তিনি হেসে বলবেন,
‘ওকে ছেড়ে দে, ওর কোন
সক্ষমতা নেই
মুহূর্ত-মঞ্চে ঘটতে
থাকা ভাবীকালকে
ঠেকানোর।’ এ কথা বলে
মেয়েমানুষটি আমার হাত
থেকে নিজের পৃথিবীর
সমবয়সী সুদীর্ঘ পা দুটি
ছাড়িয়ে নিয়ে সেই
গর্ভবতী নারীটির দিকে
এগিয়ে যাবেন এবং
নারীটির স্ফীত শরীরে
হাত বুলিয়ে দেবে- বলবেন,
তোর পেটের পৃথিবীটা
দেখতে খুব সুন্দর হবে
বেটি! তুই কি প্রস্তুত
বেটি? আমি হাউমাউ করে
চিৎকার করে উঠবো, দৌড়ে
যেতে চাইব অতীত
তালগাছের মত লম্বা
মেয়েমানুষটির দিকে,
কিন্তু আমার পা দুটি
মৃত সাপের মতো স্থির
হয়ে পড়বে। আমি হামাগুড়ি
দিয়ে মেয়েমানুষটির
কাছে পৌঁছানোর
প্রচেষ্টা অব্যাহত
রাখবো। এর পূর্বেই
মুহূর্ত-মঞ্চ থেকে নেমে
মেয়েমানুষটি উধাও হয়ে
যাবে।
আগে থেকেই আমি জেনে যাব
যে, আমাকে চড় থাপ্পড়
খাওয়া লাগবে না। ঘটনার
আকস্মিকতা বাকি
চরিত্রগুলোকে মানুষ
হিসেবে ফিরিয়ে দেবে
পৃথিবীকে।
আমি সেই গর্ভবতী নারীর
বাসে না ওঠা পর্যন্ত
বাসের দরজার সামনে
দাঁড়িয়ে থাকব। পান খেয়ে
সিগারেটের গন্ধ নেভাতে
সচেষ্ট ড্রাইভার
স্টিয়ারিং এ বসে বাস
স্টার্ট দেবে। এর আগে
তিনি পৃথিবীর মুখে তিন
বার কফ ছুঁড়ে মারবেন।
আমার নির্ধারিত আসনে
বসে যাব ।
মুহূর্ত-মঞ্চের
চরিত্রগুলো আবার বাসে
উঠবে, যার যার আসনে বসে
পড়বে। কেউ কেউ মোবাইল
ফোনে দ্রুতই গন্তব্যে
পৌঁছে যাবার আনন্দ
সংবাদ দেবে।
মুহূর্ত-মঞ্চ আমার দিকে
তীব্র উপেক্ষার
দৃষ্টিতে তাকাতে
থাকবে। আমি দেখবো,
গর্ভবতী নারীটি ভ্রমণ
জনিত ক্লান্তিতে তার
আসনে হেলান দিয়ে ঘুমোতে
থাকবে আর তার গর্ভের
নতুন পৃথিবীটি আনন্দে
পৃথিবীর নিরাপদ তম
মুহূর্ত-মঞ্চে
খেলাধুলা করতে থাকবে।
মুহূর্ত-মঞ্চের সঙ্গে
বিবাদে জড়িয়ে পড়ব আমি।
এক পর্যায়ে সেই বিবাদ
চূড়ান্ত পর্যায়ে
পৌঁছুবে। মুহূর্তের
গতি বৃদ্ধি পাওয়া মাত্র
আমি চুপসে যেতে থাকব।
কিছু সময়ের জন্য
মুহূর্ত-মঞ্চ থেকে
বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে
পৃথিবী। আমি মনে করার
চেষ্টা করব হোটেলের
কিচেন থেকে বেরিয়ে আসা
সেই মেয়েমানুষটির কথা।
কিছুতেই তার মুখ মনে
করতে পারবো না আমি।
আমার মনের মধ্যে লেগে
থাকবে গর্ভবতী নারীটির
মুখ।
মুহূর্ত-মঞ্চের সঙ্গে
যখন পুনরায় আমাদের
সংযোগ ঘটবে, তখন
চরিত্রগুলো ভয়ার্ত এক
মুহূর্ত-মঞ্চের
মুখোমুখি হবে।
পরিবর্তিত
মুহূর্ত-মঞ্চে প্রথমেই
আমি খুঁজতে থাকবো
গর্ভের ভেতর পৃথিবী
নিয়ে ঘুরতে থাকা
নারীটিকে। বিগত কয়েক
ঘণ্টায় ঘটে যাওয়া
মুহূর্তগুলোকে আমি
আমার দৃশ্যের পর্দায়
তুলে ধরব। গর্ভবতী
নারীটিকে খুঁজে না
পেলেও আমি নিজেকে
খুঁজতে থাকব । নারীটিকে
খুঁজে পাবো না এবং
নিজেকেও না। আমরা অন্য
আমাদের আবিষ্কার করব,
প্রচণ্ড আঘাতে আমার চোখ
অন্ধ হয়ে যাবে, চোখ হীন
দৃষ্টি দিয়ে পৃথিবী’কে
হাতড়াতে থাকব আমি,
কল্পিত দৃশ্যের
অপ্রত্যাশিত দৃশ্যায়ন
দেখতে হবে আমাকে।
মুহূর্ত-মঞ্চের পর্দার
সম্মুখে দাঁড়িয়ে
দাঁড়িয়ে মুহূর্ত
উদযাপন করতে থাকবে
চরিত্রগুলো।
অবশেষে দেখবো গর্ভবতী
নারীটির পাশে বসা তার
স্বামীর মত দেখতে
মানুষটির মাথার ঘিলু
বেরিয়ে এক বীভৎস
মুহূর্ত তৈরি হয়েছে।
প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলা
মানুষটির ডান পা তার
দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে
মৃত্যুর দিকে এগিয়ে
যেতে থাকবে। প্রায়
ছত্রিশ জন মানুষ তাদের
নিজেদের ধ্বংসাবশেষের
উপর দাঁড়িয়ে শ্বাসের
জন্য হাত পাতবে আশপাশের
মুহূর্তের কাছে। কেউ
কেউ এগিয়ে আসবে, কেউ
হতাহত যাত্রীদের পকেট
হাতড়াতে থাকবে, হতাহত
যাত্রীদের বাঁচানোয়
সচেষ্ট থাকবে কেউ কেউ।
মুহূর্ত-মঞ্চ তার নিজের
মত করে মঞ্চায়িত করতে
থাকবে মুহূর্তকে।
খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে
সেই নারীটিকে পেয়ে যাব,
দেখবো নারীটির স্ফীত
গর্ভ থেকে সমস্বরে
চিৎকার করতে করতে নেমে
আসবে একটা নতুন
‘পৃথিবী’, নারীটি
মিলিয়ে যাবেন। আমি সদ্য
প্রসূত পৃথিবীকে আমার
দুই হাতের অপ্রশস্ত
তালুতে তুলে নেব আর চোখ
হীন দৃষ্টি দিয়ে
পর্যবেক্ষণ করতে থাকব
তাকে।