আজ আমার মৃত্যু উৎসব
হাড়ভাঙা দামের নিচে
অবশিষ্ট শেকড় ও কঙ্কাল।
অর্থহীন বিনির্মিতি
শেষে পৃথিবীর অনন্ত
গুহায় ফিরে গেছে
প্রত্মমানুষ। এইখানে
অনাবশ্যক বাড়াবাড়ি
জীবনের। এইখানে
অর্বাচীন ফড়িংয়ের
লাফালাফি। এমন মৃত্যু
দিনে বসন্তবাতাস ছাড়া
আর কোনো শবযাত্রী নাই।
ধূলো হয়ে উড়েযাচিচ্ছ
দ্যাখো...
ধূলো হয়ে মিশে যাচ্ছি
বাতাসে পুনর্বার ।
গৃহ অন্ধকার। নারীটি
শিয়রে দাঁড়ায়। সাদা
মশারীর বাইরে থেকেই দু
হাত দিয়ে সাঁড়াশির মতো
আমার কাঁধ এমনভাবে চেপে
ধরে যে নিঃশ্বাস নিতে
পারি না। চিৎকার করে
কাউকে ডাকতে চাই, কেউ
আসে না। কিংবা আমার
কণ্ঠস্বর অতোদূরও
পৌঁছায় না।
ধ্বস্তাধস্তির এক
পর্যায়ে নারীটির মুখ
দেখতে পাই। চমকে উঠি।
একি! এ যে আমার মুখটাই
কেটে তার মুখে বসিয়ে
দেয়া হয়েছে! নারীটি
ফিরে যাচ্ছে। শোনো?
নারীটি আরেকবার তাকায়।
নিষ্প্রভ দৃষ্টি। ফেরে
না।
অপসৃয়মাণ ক্রম ধীরে...
ঘুম ভেঙে ফ্যাল ফ্যাল
করে ছাদের দিকে চেয়ে
থাকি। কটা বাজে ঠিক
বুঝতে পারছি না। ঘড়ির
দিকে তাকিয়ে মনে হলো
এতো দ্রুত ঘুম ভেঙে গেল
কেন? আজকাল এমনই হচ্ছে।
প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায়
ঘুম ভেঙে যায়। সমস্ত
শরীর অবশ হয়ে আসছে।
একটা চোরা ব্যথা সমস্ত
শরীরে বয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু ব্যথার উৎস
আবিষ্কার করা যাচ্ছে
না। শীত শীত লাগে।
নিজেকে টিকটিকি
প্রজাতির বোধ হতে থাকে।
রক্তহীন। বিছানা ছেড়ে
উঠতে ইচ্ছেকরে না। মনে
হয়, কেউ যদি মাথায় হাত
রেখে ডাক দিত! ওঠো আর কতো
ঘুমাও। কতো কাজ পড়ে
আছে। না, কেউ ডাকে না।
আকাশ কুসুম ভাবনা। বুঝি
না, কেন যে ভেতরে ভেতরে
এমন নির্ভরশীলতার
আকাঙ্ক্ষা জেগে আছে
এখনো! সে আমাকে বলেছে,
জীবন থেকে কামনা দুর
হোক, আকাঙ্ক্ষা দূর
হোক। অথচ আমার জীবন
থেকে কোনো আকাঙ্ক্ষাই
দূর হয় না। তাকে দেখার
আকাঙ্ক্ষা, তার সঙ্গে
রাজপথে হাঁটার
আকাঙ্ক্ষা।
ইদানিং হয়েছে আরেক
সমস্যা। আমি কি ঘুমের
মাঝে দুঃস্বপ্ন দেখি
নাকি জেগে জেগে
দুঃস্বপ্ন দেখি বুঝি
না। ইদানিং এমন সব
স্বপ্ন দেখি ঠিক
মানেকরতে পারি না।
দেখলাম, আট মাসের
অন্তঃসত্বা আমি বসে আছি
একটি মেটারনিটি
ক্লিনিকে। তীব্র গরমে
হাসফাস লাগছে। পাশে
একটিকিশোরী। কথা বলছে
না। কিন্তু তার চোখ
মুখে যেন অজস্র কথা।
জানলাম মেয়েটি বাক
প্রতিবন্ধী। কোত্থেকে
সাদা গাউন পরা মাদার
এলেন। বললেন, মেয়টি
যাকে ধারণ করছে সে তার
ভাই। আমি আতঙ্কিত হই
মেয়েটিকে নিয়ে পালাই।
এখানে যাই, ওখানে যাই।
যে কোনো উপায়ে মেযেটিকে
এই জব্ধালমুক্ত করতে
হবে।
ঘুম ভেঙে যায়..
আবার ঘুমিয়ে যাই..
ঘুমের মধ্যে জেগে থাকি,
জেগে জেগে ঘুমিয়ে
থাকি।
একটা বাসস্টপেজে বসে
আছি অনেক্ষণ। কোথায়
যাওয়ার কথা আমার?
বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে
বাসের টিকিটি দেখি ।
গাড়ি আসে, চওে যায়।
আমিবসেই থাকি, নড়ি না।
অজানা অচেনা স্টেশন।
জায়গাটির নামও জানি না।
ফিলিং স্টেশনের
সাইনবোর্ডে নামটি পড়ার
চেষ্টা করি। দেখলাম ঘষে
ঘষেজায়গাটির নামই তুলে
ফেলা হয়েছে। দীর্ঘক্ষণ
কোনো গাড়ি আসে না। কোনো
মানুষকে দেখা যাচ্ছে
না। একটা সিঁড়ির গোড়ায়
বসে থাকি। কোনমাস এখন?
অগ্রাহায়ণ না পৌষ? কেমন
শীত শীত লাগে । একটু
পরেই তো ঝুঁপ করে
অন্ধকার নেমে আসবে।
আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়
আমাকে সতর্ক করে,
অন্ধকার নেমে আসার আগেই
এখান থেকে চলে যেতে
হবে। কিন্তু কেন এসেছি
এখানে? আর যাবোই বা
কোথায়? নিজেকে প্রশ্ন
করে কোনো উত্তর খুঁজে
পাই না আমি। দ্রুত
অন্ধকার নেমে আসছে।
যেখানটায় বসে আছি
জায়গাটা কেমন ভেজা ভেজা
লাগে। কুয়াশায় ভিজে
যাচ্ছে বোধ হয়সব। একটু
পর নিজের পোশাক
অস্বাভাবিক রকম ভেজা
মনে হয়। দূর থেকে
কাওয়ালীর সুর ভেসে
আসছে। কোথাও কাওয়ালীর
আসর বসেছেবোধহয়।
বৃষ্টির ছাটের মতো
জলকণা মুখে লাগে ।
হাতের তালু দিয়ে মুখ
মুছি। শেষ বিকেলের আলোয়
দেখলাম হাতের তালুর রঙ
লাল। দ্রুত জায়গাছেড়ে
উঠি। জলপ্রপাতের মতো
লাল ধারা নেমে আসছে
বারান্দা দিয়ে। ব্যাগ
থেকে ছোট আয়নাটি বের
করি সমস্ত মুখে রক্তের
দাগ। আমারপোশাক
রক্তাক্ত। রক্তের
মধ্যে পিছলে যেতে
থাকি। এতো রক্ত কেন
চারদিকে? রক্তের সঙ্গে
নুড়ি পাথরের মতো ভেসে
আসছে খণ্ড
বিখণ্ডমানবাংশ। মানব
বংশের ধ্বংস কী তবে
আসন্ন? অন্য কোনো
প্রাণী কি এতোগুলো
মানুষ হতা করল! না।
মানুষই মানুষকে
নির্বিচারে হত্যা
করছে।পৃথিবীসুদ্ধ
মানুষ কি তবে উন্মাদ
হয়ে উঠল? মানুষ নাকি
প্রাণ দিয়ে হলেও তার
প্রজন্মকে রক্ষা করে।
তবে কী হলো তাদের? এতো
হত্যা? এতো রক্তের হোলি?
অন্যকে হত্যা এবং
নিজেকে হত্যার উৎসব কেন
তাদের মাঝে? আমি ভয়
পাই।
শীত নিদ্রায় চলে যাবো
তীর্থঙ্কর।
তোমাকে তো আগেই
বলেছিলাম। চলে যাবো।
এবার সত্যিই চলে যাবো।
হেমন্ত বসন্ত কোনো ঋতুই
দেখবো না। ব্যাঙের
দীর্ঘ বাকলের নিচে
ক্রমতরঙ্গ দৈর্ঘ্যে
নিশ্চুপ শুয়ে থাকব।
নিভৃতে-নৈঃশব্দ্যে।
এতোদিন যাই যাই করেও
নিজেকে গুছিয়ে উঠতে
পারিনি। এবার নিশ্চিত
পারবো। দ্যাখো, শহরের
বড় বড় বিলবোর্ড,
আকাশমুখি দালানগুলোর
দেয়ালে দেয়ালে সবার
রক্তাক্ত মুখ।
আমি যাই।
ঝড়ের তাণ্ডবে একেকটি
বৃক্ষের পাতা উল্টে
যাচ্ছে। সেই বৃক্ষের
পাতায় পাতায় কবিতা লিখে
রাখছি। কবিতাগুলো লেখা
হয়ে গেলেই চলে যাবো
শীতনিদ্রায়...
নির্জন রাস্তাটি হঠাৎ
আলোকিত হয়ে ওঠে।
যে নিস্তব্ধ পথের পাশে
বসে ছিলাম। তাই এখন হয়ে
ওঠেছে মহানগরীর
আলোকোজ্জ্বল পথ। বড় বড়
দালান। আলোকসজ্জা।
আমাকে ধাক্কা দিয়েদিয়ে
পেরিয়ে যাচ্ছে
রক্তাক্ত মানুষ।
মোমবাতি প্রজ্জ্বলন
করে শিশুরা হাঁটছে সড়ক
জুড়ে- কোথাও কোনো শব্দ
নেই..
সড়কের একপাশে কুঁকড়ে
বসে পড়ি। কে একজন সজোরে
লাথি মারে পাঁজর
বরাবর।
ওঠে দাঁড়াই।
তার দীর্ঘ অবয়বের সামনে
নিজেকে নিতান্ত
ক্ষুদ্র প্রাণী মনে
হচ্ছে। সশস্ত্র
প্রাণীটিকে মানুষের
মতোই দেখায়। এরকম
মানুষের অবয়ব
দেখেছিলামকোনা এক
বৈশাখে। দৃশ্যটি ভুলি
নি। ভুলবওনা। মৃত্যুর
পূর্ব মুহূর্ত
পর্যন্ত। মনে হচ্ছিল
কোনো সিনেমার
ক্রাইমসিন দেখছি। তারা
আসে। অনেকটা মাটি
ফুঁড়ে। সন্ধ্যার প্রাক
মুহূর্তে সুন্দরকে
লুণ্ঠিত করতে। রক্ত
পিপাসু ড্রাকুলার মতো
ঢুকে পড়ে ওরা সভ্য
নগরীতে। তাদের অঙ্গ
ভঙ্গি বিভৎস।গায়ে যেন
আসুরিক শক্তি। দৈত্যের
মতো তারা সুন্দরকে হরণ
করে। ওরা অপমান করে
নারীকে। ওরা অপমান করে
প্রকৃতিকে।
লোকটি আমার পায়ের আঙুলে
বুট দিয়ে মাড়িয়ে দিয়ে
প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, কে
তুমি?
তীব্র বিবমিষা হয় আমার।
তার কথার কোনো উত্তর
দিতে ইচ্ছে হয় না..