অভাবী মানুষের শৌখিনতা
মানায় না। গান-বাজনা
ভরাপেট মানুষের জন্য।
তবুও যখন মেয়ে সাবিনা
বায়না করেছে যত কষ্টই
হোক, হারমোনিয়াম কিনে
দেবে। সাবিনা, বারো
বছরের গ্রামের মেয়ে হলে
কী হবে, ওর ভিতরে গানটা
জন্ম থেকেই এসেছে। অবাক
হওয়ার মতো ব্যাপার, যখন
সাবিনার বয়স দুই-তিন
বছর হবে কোনোরকম কথা
বলতে শিখেছে, তখন থেকেই
সবার হাত থেকে রিমোট
কেড়ে নিয়ে গানের
চ্যানেলগুলো চালাত।
কেউ ঘুরিয়ে দিলেই বিপদ!
এমন কান্না, চিৎকার করত
যে পাশের বাড়ির মানুষও
অতিষ্ঠ হয়ে যেত। কেউ
কেউ চলেও আসত কোনো অঘটন
ঘটল কিনা দেখার জন্য।
খোরশেদের সামর্থ ছিল না
টি.ভি কেনার। একবার
পাড়ায় লটারি
প্রতিযোগিতা হয়েছিল, আর
সেবারই জেতে। একেবারে
প্রথম পুরস্কার। জীবনে
এই প্রথম সে কোনো
পুরস্কার জেতে।
ছোটো থেকেই স্কুলের
নানা অনুষ্ঠানে সাবিনা
যোগ দিত।
শিক্ষক-শিক্ষিকাদের এত
প্রশংসা পেত, বলার নেই।
ওদের বংশে সাতকুলেও কেউ
ছিল না যে গান সম্পর্কে
আগ্রহ আছে। সেদিন
রবীন্দ্রজয়ন্তীতে
'দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার
গানের ওপারে' গাইতেই
সকলে ওকে জড়িয়ে ধরে এমন
প্রশংসা করে ওর চোখ
কান্নায় ভিজে যায়। হরেন
স্যার বলেই দিল, 'ভগবান
তোকে গানের জন্যই
পাঠিয়েছে। তুই কারো
কাছে না শিখে যা গান
করিস এমন গান বড়ো বড়ো
মঞ্চের শিল্পীরাও পারে
না। তুই এবার কোনো
জায়গাতে গানটা শেখ।
শিখে গাওয়াটা খুব
জরুরি। না হলে নিজের
ভুলত্রুটি বুঝতে পারবি
না।' সাবিনার গান শেখার
ভীষণ ইচ্ছে। কিন্তু
কীভাবে বলবে সংসারে নুন
আনতে পান্তা ফুরোয়
অবস্থা। কোলের ছোটো
বোনটা মায়ের দুধ ঠিকমতো
পায় না। বাপেরও
সামর্থ্য নেই যে একটু
স্যারালাক্স বা কৌটোর
দুধ কিনে খাওয়াবে।
একদিন রাস্তায়
খোরশেদের সঙ্গে হরেন
স্যারের হঠাৎ দেখা।
সেদিনই স্যার বলল,
‘খোরশেদ মেয়েকে একটা
হারমোনিয়াম কিনে দিও’।
দেখতে দেখতে সময় পেরিয়ে
যাচ্ছে। কিন্তু মেয়েকে
হারমোনিয়াম কিনে দেওয়া
আর হয় না। ওদের গ্রামেও
তেমন দোকান নেই
হারমোনিয়াম পাওয়া
যাবে। পাশের গ্রামে
একটা বড়ো বাজার আছে।
ঠিক করে ওখানেই যাবে
কিনতে। কিন্তু নগদ টাকা
নেই। খোরশেদ ভিনগ্রামে
কাজে যায়। বাড়িতে পড়ে
থাকে সাইকেল। চালানোর
লোক নেই। না চালিয়ে
চালিয়ে জং ধরে গেছে।
অবস্থাও তেমন ভালো না।
বেল বাজে না। ঘনঘন চেন
পড়ে যায়। ব্রেকের জন্য
দু'পা ভরসা। ওই সাইকেল
চালিয়েই খোরশেদ পাকা
রাস্তায় উঠেছে। সাইকেল
বেচবে। কিছুটা গেলেই
দোকান। দশমিনিটের
রাস্তা কুড়িয়ে মিনিট
পেরিয়ে গেছে। বারবার
চেন পড়ছে। হেঁটে গেলে
খোরশেদ হয়ত পৌঁছে যেত,
কিন্তু ও আজ চালিয়েই
যাবে। গ্রামেও
গাড়িঘোড়া যা বেড়েছে...
বিশেষ করে টোটো... শেষ
স্মৃতিটা আরও কিছুটা
সময় নিজের মধ্যে রাখতে
চায় খোরশেদ। কিছুটা পথ
যেতে না যেতেই আবার চেন
পড়ে যায়। পাকা রাস্তা
হলেও রাস্তার অবস্থা
খুব একটা ভালো না।
রাস্তার মাঝেমাঝে বড়ো
বড়ো গর্ত। গত বছরেই
রাস্তা পাকা হল। একটা
বর্ষা যেতে না যেতেই
অবস্থা খারাপ। এর দায়
যে কার কেউই যেন তা জানে
না। আসলে এটাই নিয়ম। এই
নিয়মের চাকায় মানুষ
নিজেকে বেঁধে নিয়েছে।
প্যাডেল ঘুরলে সেও
ঘুরবে। খোরশেদের
প্যাডেল বন্ধ। চেন ঠিক
করে আর পড়ে যায়।
মাঝরাস্তায় হঠাৎ থেমে
যায় তাঁর চাকা। পিছনে
দ্রুতবেগে আসা একটা লরি
পিষে দিয়ে যায় খোরশেদের
শরীর। ছিটকে যায়
সাইকেল। তাঁর স্বপ্নের
মতো, তাঁর ইচ্ছের মতো
টুকরো টুকরো সাইকেল
মালা গাঁথে মৃত
হারমোনিয়ামের।
সাবিনা একদিন বড়ো
গায়িকা হবে। কিছুতেই
আশা ছাড়েনি। টিভির
অনুষ্ঠান, নানা গানের
চ্যানেল দেখে নিজেই
নিজেই শেখে। স্বামী
মারা যাওয়ার পর
জাহানারাও হার মানেনি।
সে মেয়েকে গায়িকা
করবেই। অদম্য জেদ।
খোরশেদ মারা যাওয়ার সময়
ছোটোমেয়ে মাত্র
তিনমাসের। দেখতে দেখতে
দু'মাস পেরিয়ে গেছে।
জাহানারা অন্যের
বাড়িতে রান্না করে,
থালা বাসন মাজে। অবসরে
বাড়িতেও বিড়ি বাঁধে।
কিন্তু এই কাজে এতকম
টাকা যে এতে কী আর
মেয়েকে গায়িকা বানানো
যায়? এরপর ছোটো মেয়ে...
নিজের বুকের দুধ তাও
ঠিকমতো পায় না। বেশি
টাকা উপার্জন করতে হলে
মেয়ে না পুরুষ হতে হবে।
অর্থাৎ, পুরুষদের কাজ
করতে হবে। কারণ, আমাদের
সমাজে মেয়েদের কাজের
পারিশ্রমিক আত্মীয়দের
দিয়ে যাওয়া শিশুর হাতের
সাম্মানিকের মতো।
বর্ষাকাল। পাড়ায় পাড়ায়
লোকে পাট জাগ দিয়েছে।
নদী, নালা, গর্ত, খাল, বিল
সব জলে ভর্তি। বাড়ি
থেকে একটু বেরোলেই
চারিদিক পাটপচার গন্ধ।
এইসময়টা লোকে দেশি মাছ
খেতেই চায় না। বাজারে
ভীষণ সস্তা মাছ। পুঁটি,
তেলাপিয়া, পোনা খুব কম
দামে পাওয়া যায়। গরীররা
রোজ দিন মাছ না খেলেও এই
বর্ষার সময়টাতে প্রায়ই
খায়। বড়োলোকেরা খেতে
চায় না। পাটপচা গন্ধে
বমি আসে। মোড়লবাড়ির
প্রায় দু'বিঘা জমির পাট
ছিলবে। মুনিশ কিছু কম
পড়ছে। পাড়ার একজন বলল,
'জাহানারা তুই কি
পাটকাঠি আর পাট বইতে
পারবি? তিনশো টাকা দেবে?'
সারামাস লোকের বাড়ি কাজ
করে জাহানারা
হাজার-বারোটা টাকা পায়।
এখানে একদিনেই তিনশো
পাবে। সঙ্গে সঙ্গে রাজি
হল। ওর টাকা দরকার। বড়ো
মেয়েকে হারমোনিয়াম
কিনে দেবে। ছোটোমেয়েকে
মানুষ করবে। ওদের নিয়ে
অনেক স্বপ্ন।
জাহানারা কাজে গেলে
ছোটোমেয়েকে সঙ্গে নিয়ে
যায়। পাঁচমাসের মেয়ে।
এখনও বুকের দুধ খায়।
দুধ খুব বেশি পায় না।
এমনিতেই রোগাপাতলা
শরীর। জাহানারা ভেজা
পাট বইছে। তেমন অভ্যেস
নেই। তারপর টিপটিপ করে
বৃষ্টি পড়ছে। পাট বওয়া
কতটা কষ্টের যে বয়েছে
সে জানে। খালের পাশেই
একটা বাড়িতে মেয়েকে
রেখে এসেছে জাহানারা।
শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ সব
ভিজে একসা। হঠাৎ করে
মেয়ে কেঁদে উঠেছে।
খাওয়াতে হবে। সারা গা
পাটপচা জলে ভিজে। দুই
বুকও ভিজে গেছে।
জাহানারা একটু আড়াল
করেই ব্লাউজের হুক খুলে
মেয়ের মুখে ঢুকিয়ে দেয়।
অপুষ্ট দুধ। মেয়েটি তার
বোঁটা ধরে চুক চুক করে
টানছে। একটু আধটু যা
পাচ্ছে তাতেই শান্ত।
মা, গোয়ালার দুধে জল
মেশাতে পারে না। কিন্তু
আজ আশ্চর্য, পাটপচা জল
আর বুকের দুধ মিশে যেন
বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছে
মা। দূর থেকে দেখছে
মোড়ল বাড়ির ছেলে।
শান্তির তৃপ্তিতে
সমস্ত খিদে জল হয়ে
যাচ্ছে। কোনো পাটপচা জল
খিদেকে সরিয়ে দিতে
পারছে না।
সাবিনা স্কুল থেকে ফিরে
সোজা চলে আসে খালপাড়।
দূর থেকে উচ্চস্বরে
বলে, 'মা আমি স্কুলে
গানের প্রতিযোগিতায়
প্রথম হয়েছি। স্কুল
থেকে আমায় একটা
হারমোনিয়াম দেবে।'
জাহানারার একবুক খোলা।
ছোটোমেয়ে তাতেই মুখ
গুঁজে। মেয়েকে কোলে
নিয়েই এগিয়ে আসে
জাহানারা। মানুষের
দিকে। কোনো লজ্জা নেই।
কোনো দুঃখ নেই। সব যেন
জল, জল মনে হচ্ছে।
সারাদিনের গুমোট আকাশ
থেকে শুরু হয়ে গেছে
ঝিরঝির বৃষ্টি।