বের্টোল্ট ব্রেশ্ট
(১৮৯৮ - ১৯৫৬)
বের্টোল্ট ব্রেশ্টের
শৈল্পিক সত্তার আবরণ ও
আভরণ মূলত তাঁর দৃঢ়
রাজনৈতিক চেতনা।
কিন্তু তাঁর সেই
আপাতকঠিন রাজনৈতিক
সত্তার খোলসের ভিতরে
লুকিয়ে আছে বেশ কিছু
কবিতা যেগুলি নিছকই
প্রেম-বিষয়ক। তাঁর বেশ
কয়েকটি সনেট
‘অ্যান্টিরোমান্টিক
রোমান্টিসিজমকে’
উপস্থাপিত করে। ১৯ নং
সনেটটিও সেরকমই এক
কবিতা। গভীর রাজনৈতিক
বোধের অন্তঃস্থলে
দাঁড়িয়েও এখানে
ব্রেশ্ট সহজ-সরল ভাষায়
কিছু সাদামাটা ও
সর্বজনীন প্রাত্যহিক
যাপনকথার কাব্যিক অবয়ব
আঁকেন এক অনায়াস
ভঙ্গিমায়। এই যাপনকথায়
‘তুমি-আমির’
ব্যক্তিচেতনা পেরিয়ে
এক সঙ্ঘবদ্ধ ‘আমাদের’
কথা উচ্চারিত হয়, এক
সঙ্ঘবদ্ধ ‘আমাদের’ বোধ
জাগরিত হয়।
তবে, সনেটটিতে এই
একরৈখিক অর্থরোপণ পাঠক
হিসাবে আমার ব্যক্তিগত
অভিমত। আদতে যে কোন
সৃজন হল বহুমাত্রিক।
যদি ব্রেশ্টকে
চিরাচরিত রাজনৈতিক
বীক্ষণ যন্ত্রের
মাধ্যমেই পর্যবেক্ষণ
করা হয় তাহলে এই
সঙ্ঘবদ্ধ ‘আমাদের’
ধারণাই আবার পাঠান্তরে
হয়ে উঠতে পারে ‘কনসেপ্ট
অফ কমিয়্যুন’! আদতে
লেখকের অভিসন্ধি এবং
পাঠকের অর্থনিরূপণের
মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব
নেই। কারণ ভিন্ন পাঠে
ভিন্ন অর্থরোপণের
দায়িত্ব ভিন্ন ভিন্ন
পাঠকের ব্যক্তিগত
অধিকার! ফরহাদ
মাঝহার-এঁর কবিতা থেকে
ধার করে বলাই যায় “সব
ভাষাই আদতে উপমা, অর্থ
হয় পাঠের গৌরবে”। এখানে
অনুবাদকের ভূমিকাও
নিছকই এক কথকের। সেই
ভূমিকা পেরিয়ে কোন
অর্থপ্রদানের প্রয়াস
আমার মধ্যে একেবারেই
নেই।
বছর দুয়েক আগে বার্লিনে
১৯ নং সনেটটি অনূদিত
হয়। অনুবাদকের দায়িত্ব
অনুসারে মূল জার্মান
সনেটটিকে বাংলায়
অভিরোপণকালে আমার
প্রয়াস ছিল কবিতাটিকে
‘নিরসঃ তরুবর ভাতি’ করে
তোলার। সেই প্রচেষ্টায়
এখানে সর্ববৃহৎ
সাহায্যকারী কবি স্বয়ং!
মূলত নাট্যকার ব্রেশ্ট
তাঁর কবিতাটিকেও
আশিরনখর এক কথোপকথনের
সুরেই বেঁধেছেন। যেন
প্রেমিক তার প্রেমিকার
কানে কানে কিছু কথা
বলছে! কবিতাটি পাঠকালে
পাঠকই যেন কথকের সেই
প্রেমিকায় রূপান্তরিত
হয়! এই রূপান্তর, অথবা এই
উত্তরণ এক অনায়াস ও
সাবলীল উড়ান। এখানেই এই
সনেটটির সার্থকতা।
১৯ নম্বর সনেট
বের্টোল্ট ব্রেশ্ট
অনুবাদ: সুদীপ্ত
চট্টোপাধ্যায়
এ আমার পছন্দ নয় মোটে:
যেভাবে তুমি পালিয়ে
বেড়াও আমার কাছ থেকে।
শুনতে চাই তোমায়, না
হয় খিটখিটই করলে।
হও যদি বধির, জানতে চাই
কী বললে।
যদি মূক হও, আমার জানা
প্রয়োজন কখন-কী তোমার
নজরে এসে ঠেকে।
হতে যদি অন্ধ তুমি,
তোমাকেই চাইতাম আমি
আমার দৃষ্টিতে
তুমিই তো সেই সেপাই,
দাঁড়িয়ে আছো আমার
পাশটিতে:
দীর্ঘ এ যাত্রায় আমরা
তো সবে অর্ধ-পথের
যাত্রী,
মনে রেখো, এখনও আমাদের
ঘিরে রেখেছে রাত্রি।
'ক্ষতগুলোকে সারাতে
দাও' এ অজুহাত আর চলবে
না।
আর বলতে পারবে না,
'যেখানে খুশি থাকবো'
(এখানে নয়)
বললে হয়তো আরাম পাবে,
মুক্তি কিন্তু পাবে না।
জানো তো, যাকে কারো খুব
প্রয়োজন, সে কখনোই নয়
মুক্ত
বিশেষ করে তার প্রয়োজন
যখন আমারই সাথে যুক্ত!
'আমি-আমি' করছি বটে, আসলে
'আমরা' বললেই অর্থ হয়।